পার্বত্য চট্টগ্রামে ভোট বিমুখতা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?
ডেস্ক রিপোর্ট: সদ্য অনুষ্ঠিত (৭ জানুয়ারি ২০২৪) বাংলাদেশের আলোচিত জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে যতটা চর্চা আমরা লক্ষ্য করেছি, তা যেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বর্ণিত ‘গরীবের ভাউস’ গল্পটিই স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ‘গরিবের ভাউসে’ পরিণত হয়েছে। সবাই তাকে দু’কথা শুনিয়ে দেয়। গেল বছরের পুরোটা সময় যদি বিবেচনায় না-ও নিই, অন্ততঃ গত ২৮ অক্টোবর (২০২৩) বাংলাদেশের সরকার বিরোধী দল বিএনপি’র রাজধানী ঢাকায় আহুত সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে আট-ঘাঁট বেধে বাংলাদেশ বিষয়ক চর্চা আমরা লক্ষ্য করেছি।
রাজনীতিতে আর তার জের ধরে গণমাধ্যমে। আর সুক্ষ্ম বলা চলে না, এক্ষেত্রে গোটা পূর্ব-পশ্চিমকে অনেকটা মোটা দাগেই পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দেখেছি। প্রাচ্য-প্রতিচ্যের এই চর্চায় আমরা শিখেছি, বাংলাদেশের নির্বাচন কেমন করে হওয়া উচিত, বাংলাদেশের রাজনীতি, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে আমাদের কি কি দুর্বলতা রয়েছে-এমন অজস্র বিষয়। কারো কাছে ভালো কারো কাছে মন্দ। কিন্তু চর্চা সকলের মধ্যেই বর্তমান। ঠিক বাংলার ‘গরিবের ভাউসের’ সঙ্গে যেমনটা হয়।
দশকের পর দশক ধরে যারা বিশ্বময় ঔপনিবেশিক শোষণ চালিয়ে মানব সভ্যতাকে দাসত্বের শেকল পরিয়ে রেখেছেন সেইসব দেশ ও তাদের ‘মহামতি’ শাসকগণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের খবরদারির পরম্পরা বজায় রেখে আসছিলেন। কুটনৈতিক শিষ্টাচারের থোরাই কেয়ার করে ওইসব ঔপনিবেশিক শক্তির হালামলের প্রতিভূরা তাদের দূতদের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে লাগাতার চাপে রাখছিলেন। বলা চলে এখনো রাখছেন। তার মধ্যেই সার্বভৌমত্বকে অটুট রাখার লড়াইয়ে বলীয়ান থেকে শেখ হাসিনার সরকার তার নির্ধারিত ছকে একটি নির্বাচনের দিকেই এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু নির্বাচনের সময় যতই এগিয়েছে, বিদেশিদের এহেন চাপকে ক্রমাগত বেড়েছেই।
আর এই চাপে বাতাস দিয়েছে দেশের ভেতরের রাজনৈতিক শক্তি। দেশীয় রাজনীতির কৌশলে পরাভূত শক্তিগুলো বিদেশি শক্তির ওপর ভর করতে চেষ্টা করেছে। তাতে ব্যবহার করতে চেয়েছে বিদেশি গণমাধ্যম। অর্থব্যয়ে কি- না হয়? বড় অংকে পশ্চিমা লবিস্ট নিয়োগ করে পশ্চিমা রাজনৈতিক শক্তিকে যে সহজেই যে কোন স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করা যায়, আর পশ্চিমা দেশে তা যে এক বৈধ ও বহুল চর্চিত তাও এখন আর কারো অজানা নয়। ফলে সেটাই হয়েছে। বড় অংকের কাছে বড় মাথা তথা বড় মাধ্যম উভয়ই ধরা দেয়!
রাজনৈতিক কৌশল ও নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা বা ব্যর্থতার যে অভিযোগ দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র বিরুদ্ধে রয়েছে, সেই দলটির ভাষ্যে ভর করে এসব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যেভাবে বাংলাদেশ ও এদেশের নির্বাচনকে নিয়ে একধরণের ‘পারসেপশন’ সৃষ্টির প্রয়াসে মরিয়া হয়ে উঠে তাতে তাদের নিয়ে আমাদের প্রশ্ন তোলারও নিশ্চয়ই অবকাশ আছে।
এসব গণমাধ্যম পাশ্চাত্যের ভাবাদর্শ ফেরি করে যেভাবে অত্যন্ত সুক্ষ্ণভাবে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশের গণতন্ত্র, মানাবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদির বয়ান শেখায়, যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন তোলা যায়, সাম্প্রতিক দশকগুলোকে ধীরে ধীরে যেভাবে বাংলাদেশ দারিদ্র বিমোচন, গ্রামোন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবার আধুনিকায়ন, অভূতপূর্ব যোগাযোগ অকাঠামোর উন্নয়নসহ অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের বহুমুখি সূচকে অনবদ্য সাফল্য অর্জন করেছে, তা কি এরা দেখতে পায় না?
এক দশক পূর্বে আইনি মীমাংসায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিলোপ সাধন করে নির্বাচনী পরিকাঠামোর যে পরিবর্তন আদালতের মাধ্যমে আসে সেই পদ্ধতি ওইসব পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বিদ্যমান থাকলেও তারা কেন ‘গরীবের ভাউস’কে নিয়ে এত তৎপর? আমরা যদি পরিসংখ্যান দেখি তবে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই যে পরিমাণ আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, বিশ্বের সবচেয়ে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রেও এত হত্যাকাণ্ড হয় কিনা তা নিয়েও সন্দেহ থেকে যাবে।
কিন্তু আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় কি তাদের এমন চর্চার কারণ? আমাদের অখণ্ড জাতীয়তাবোধের বিরাট সংকট আছে, রাজনৈতিক অনৈক্যও বিরাজমান কিন্তু আমাদের অদম্য নাগরিকরা এই দেশটিকে গড়ে তুলতে যেভাবে নিরলস কাজ করে চলেছেন, আমাদের পোশাক শ্রমিক, আমাদের নিষ্ঠাবান কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী, বিভিন্ন খাতের কর্মঠ কর্মীগণ, অভিবাসী শ্রমিকরা-এই দেশকে উন্নত করতে নিরলস রয়েছেন।
এই দেশটিতে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই অবিনাশী চেতনার সঙ্গে একটি অংশ যাঁরা সেই ১৯৭১ সালে বিরোধিতা করেছিল তারা সেই পরম্পরাকে আজও লালন করেন। আমরা মনে করি না, এই দেশের বিদ্যমান শাসনকাঠামো নিরঙ্কুশভাবে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারছে। এখানে মানবমর্যাদার সব সূচক রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারছে তা আমরা দাবি করি না। কিন্তু এই সব আকাঙ্খাকে বাস্তব করে তোলার জন্য বাংলাদেশের মানুষদের একটি বৃহৎ অংশের আন্তরিক প্রচেষ্টা বিরাজমান।
কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রচারণায় বাংলাদেশ বিরোধী নেতিবাচকতা এতটাই প্রকট যে অনেক বাংলাদেশিই আর এসব পারসেপশনকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। বাংলাদেশের সংকটকে যদি তারা তুলে ধরতে চান তবে একই সঙ্গে সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরার একটি দায়িত্ব থেকে যায়। তবেই তাদের সত্যিকারের নিরপেক্ষতা মূর্ত হবে, তা না হলে সেসব গণমাধ্যমের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে সবার মত আমাদেরও প্রশ্ন থাকবেই।
আমরা যদি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে গত কয়েক দিনের কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরের দিকে দৃষ্টিপাত করি তবে স্পষ্ট করা যাবে তাদের বাংলাদেশকে নিয়ে বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি আসলে কেমন।
বার্তা২৪.কম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আমরা দেখব…মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন লিখেছে, ‘প্রধান বিরোধীদলের বর্জনের মুখে বাংলাদেশে রোববার সাধারণ নির্বাচনের ভোট শুরু হয়েছে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশটির নেত্রী শেখ হাসিনা- বিশ্বের দীর্ঘতম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার টানা চতুর্থ মেয়াদে জয়ী হতে যাচ্ছেন।’
দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ‘‘প্রধান বিরোধী দলকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ আখ্যায়িত করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পঞ্চম মেয়াদে ক্ষমতায় বসানোর গ্যারান্টিযুক্ত একটি নির্বাচনে রোববার ভোট শুরু করেছে বাংলাদেশ।’’
আল জাজিরা লিখেছে, ‘প্রধান বিরোধী দল বর্জন করা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চম মেয়াদে, টানা চতুর্থবার জয়ী হতে চলেছেন।’
ভয়েস অব আমেরিকা ভাষ্যে, ‘ভোটের সূচনা হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের বিতর্কিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’
এপি লিখেছে, ‘সহিংসতা এবং প্রধান বিরোধী দল বর্জনের মুখে রোববার বাংলাদেশের ভোটাররা ভোট দিচ্ছেন, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দর আওয়ামী লীগকে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্ত করেছে।’
সাংবাদিকতার চর্চায় সংবাদ পরিবেশনায় মন্তব্য করার সুযোগ রাখা হয়নি, কিন্তু উপরে উল্লেখিত সবক’টি সংবাদ পরিবেশনাই মন্তব্যসম্মৃদ্ধ এবং সমালোচনাভিত্তিক মস্তিষ্কপ্রসুত, তাতে সন্দেহমাত্র নেই।
হ্যাঁ সম্পাদকীয়তে মন্তব্য চলে। আর আমরা গেল কয়েক সপ্তাহ ধরে এসব গণমাধ্যমে প্রকাশিত সম্পাদকীয় কিংবা উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ দেখে আসছি তাতে এটি স্পষ্ট যে তারা বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার পাল্লাই ভারী।
তবে দায় কার? ঘরের দ্বন্দ্বে পরকে ডেকে আনার চর্চা বাঙালির মধ্যে প্রকট। একটি দলকে ভীষণভাবে তা করতে দেখা গেছে। দেশের নিন্দায় আন্তর্জাতিক লবিস্ট তথা মিডিয়ায় পয়সা ঢালতেও তার পিছপা হয়নি। কিন্তু সরকার? তারও কী দায় নেই। একটি যোগ্য সরকার কিংবা একজন যোগ্য সরকার প্রধান তিনিই যিনি ঘরের সঙ্কটগুলোর সুষ্ঠু সমাধান করতে সক্ষম। যে সঙ্কট অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যা মিটিয়ে নেওয়ার সক্ষমতায় কিংবা সদিচ্ছায় সরকারের নিজেরও যে অনীহা কিংবা অক্ষমতা তা স্পষ্ট হয়েছে। আর একমাত্র আপনার দুর্বলতায় অন্যকে দেবে আপনার ঘরে ঢুকে পড়ার সুযোগ। সেটাই হয়েছে। নির্বাচনে আগেই সকলে একমত হয়ে যদি একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন করা সম্ভব হতো তাহলে হয়তো বিদেশি নাকগুলো এর মধ্যে এতটা গলানো সম্ভব হতো না। সেটি হয়নি। সে দায় সরকারকেও নিতে হবে।
সাম্প্রতিক দশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে নিকট ভবিষ্যতে সেই দেশটি উন্নত একটি দেশে রূপান্তরের পথেই হাঁটবে, এই প্রত্যয় ও প্রত্যাশা আমাদের রয়েছে। রাজনৈতিক পালাবদলে যে দলই এই ভূখণ্ডকে শাসন করুক না কেন বাংলাদেশের এই অমিত সম্ভাবনাকে দাবিয়ে রাখার সাধ্য কারোর নেই। আমরা সেদিনের অপেক্ষায় থাকবো, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পাশাপাশি আমরা রাজনৈতিকভাবেও হবো পারষ্পরিক সহনশীল। দেশের প্রশ্নে এক পায়ে হাঁটবো। তাতে বিদেশি শক্তি আর নাক গলানোর সুযোগ পাবে না।
সম্পাদনা; মাহমুদ মেনন খান, এডিটর এট্ লার্জ, বার্তা২৪.কম
সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।