আন্তর্জাতিক

ইরান-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি হামলার নেপথ্যে কী?

ডেস্ক রিপোর্ট: পাকিস্তানের বেলুচিস্তান জঙ্গিঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল ইরান। সেই হামলায় দুই শিশুর মৃত্যুর পাশাপাশি বেশ কয়েকজন শিশু আহত হয়। এই ঘটনার দুইদিন পর ইরানে পাল্টা হামলা চালায় ইলামাবাদ। একে অপরের মাটিতে হামলা চালানো নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এখন চরমে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল এবং ইরান সমর্থিত হামাসের মধ্যে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার মধ্যে এই হামলা পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলবে।

তাদের মত, পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ, অন্যদিকে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় বলে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন, এই সংঘাত এমন দুই প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনাকে উস্কে দিচ্ছে।

মুসলিম প্রধান দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৯০০ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তে পাকিস্তানের দিকে রয়েছে বেলুচিস্তান প্রদেশ। অপর পাশে রয়েছে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশ। পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটেছে এ অঞ্চলে সীমান্তের দুই পাশে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, সিস্তান-বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের হামলায় ৯ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে তিন নারী ও চার শিশু রয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবার পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে প্রথম হামলা চালায় তেহরান। তাতে অন্তত দুই শিশু নিহত হয়।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্কে সুসময় ও দুঃসময়-দুটোই ছিল। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তেহরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার সময়ে এই সম্পর্কের কিছুটা উন্নতিও হয়। তবে ক্ষমতা থেকে ইমরান খানকে অপসারণের পর, এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পশ্চিমাদের সমর্থনপুষ্ট রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় আসার পরে সেই ধারাবাহিকতা আর থাকেনি।

পাকিস্তান-ইরান উত্তেজনা

ইরানই প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং বিদেশে পাকিস্তানের প্রথম দূতাবাসও ইরানে স্থাপন করা হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুই দেশ পরস্পরকে সহায়তা করেছে এবং ভূ-রাজনীতিতে তারা ব্যাপকভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তেহরান ইসলামাবাদকে সমর্থন দিয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র লড়াই ১৯৬৫ সালের অগাস্টে শুরু হয়ে ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলেছিল।

যাই হোক, ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব এবং পাকিস্তানে সৌদি-অনুপ্রাণিত ওয়াহাবি ধারার ইসলাম চর্চা বাড়তে থাকলে ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়তে থাকে।

১৯৯০ এর দশকে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা এবং শিয়া ছায়াযুদ্ধে উসকানি দেওয়ার জন্য ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়। অন্যদিকে এই সময়ে কাবুল ভিত্তিক তালেবান সরকারকে ইসলামাবাদের সমর্থন দেওয়া নিয়ে অস্বস্তি ছিল তেহরানের।

ভারতের সঙ্গে ইরানের সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে পাকিস্তানের কৌশলগত মিত্রতা বাড়ানোর বিষয়টি দুই দেশকে পরস্পর থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

২০১৮ সালে ইরান যখন চাবাহার নামে দেশটির সমুদ্র বন্দরের একাংশের নিয়ন্ত্রণ নয়াদিল্লির হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে, তখন ইসলামাবাদ এটি নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছিল।

পাকিস্তানে এই বিষয়টিকে গোওয়াদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব কমিয়ে আনতে ভারত ও ইরানের একটি পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে গোওয়াদার বন্দর।

এত সব অবনতির মধ্যেও দুই দেশ বড় কোন দ্বন্দ্বে জড়ায়নি। আবার তারা তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কখনো ব্যবহারও করেনি।

ইরানের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ সিস্তান-বেলুচিস্তানের রাস্ক শহরে একটি থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ১১ জন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়। যার দায় স্বীকার করে জইশ আল-আদল (আর্মি অফ জাস্টিস) নামে একটি গোষ্ঠী। গোষ্ঠীটিকে ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠী হিসেবে ইরানের কালো তালিকায় রয়েছে। ওই হামলার নিন্দা জানায় পাকিস্তান।

২০২৩ সালের জুনে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের কেচ জেলার সিংওয়ান এলাকায় একটি চেকপয়েন্টে হামলার ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণমাধ্যম শাখা ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর) এক বিবৃতি জানায়, সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দুই পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেছে। হামলাকারীরা যাতে ইরানে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য পাকিস্তান ইরানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

ইরানের যে সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে পাকিস্তান বৃহস্পতিবার হামলা চালিয়েছে, ২০০০ সাল থেকে সেখানে সক্রিয় রয়েছে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি। বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন যা দীর্ঘ দিন ধরে পৃথক বেলুচিস্তানের দাবিতে লড়ছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, পাকিস্তানকে এই হামলার মূল্য চোকাতে হবে। বেলুচ লিবারেশন আর্মি চুপ থাকবে না। আমরা এর প্রতিশোধ নেব, শেষ দেখে ছাড়ব। আমরা পাকিস্তানে বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছি। এই আবহে ইরানও যে পাক হামলাকে ভাল চোখে দেখছে না, তা তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থানেই স্পষ্ট।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *