আন্তর্জাতিক

ফিলিস্তিনের গণহত্যার নেপথ্যে ‘পশ্চিমা গণমাধ্যম ও নারীবাদ’

ডেস্ক রিপোর্ট: সম্প্রতি টকটিভির হোস্ট জুলিয়া হার্টলি-ব্রুয়ার ফিলিস্তিনের সংসদ সদস্য ডক্টর মোস্তফা বারঘৌতির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সাক্ষাৎকার চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে হার্টলি-ব্রুয়ারকে চিৎকার করতে দেখা গেলেও এমন অস্বস্তিতেও বেশ শান্ত থাকতে দেখা গেছে বারঘৌতিকে। তারপরেও মুস্তাফা বারঘৌতির বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির ও বর্ণবাদীর অভিযোগ এনেছেন জুলিয়া হার্টলি-ব্রুয়ার। 

সাক্ষাৎকারটিতে দেখা যায়, যখনই বারঘৌতি গাজায় ইসরায়েলের অনবরত হামলার প্রসঙ্গে কথা বলতে যাবেন, তখনই অপ্রাসঙ্গিকভাবে চিৎকার করেন ব্রুয়ার।  রাগান্বিতস্বরে তিনি বারঘৌতিকে বলেন, হয়তো আপনি নারীদের সাথে কথা বলতে অভ্যস্ত নন!

ডাঃ মোস্তফা বারঘৌতির বিরুদ্ধে  ‘নারীদের সাথে কথা বলতে অভ্যস্ত নয়’- এমন অভিযোগ কোনো নতুন ঘটনা নয়। হার্টলি-ব্রুয়ারের এমন বিস্ফোরক মন্তব্য ফিলিস্তিনি পুরুষদের প্রতি পশ্চিমা মূলধারার মনোভাবকে প্রকাশিত করে এবং পশ্চিমা নারীবাদের নেতিবাচক প্রভাবকে পুরোপুরি চিত্রিত করে যার ফলে ফিলিস্তিনি পুরুষদেরকে নেতিবাচকভাবে দেখার প্রবণতা বাড়ে। পশ্চিমা নারীবাদ আরব ও মুসলিম পুরুষদের ‘সন্ত্রাস ও অমানবিক’ হিসেবে পরিচিত করে তোলার অস্ত্র হিসেবে এমন মিথ তৈরির ইতিহাস দীর্ঘদিনের।

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই ফিলিস্তিনি পুরুষদের ইসরায়েলি সহিংসতার শিকার হিসেবে দেখানোর পরিবর্তে হিংসাত্মক বা অসামাজিক হিসেবে চিত্রিত করা হয়। ফিলিস্তিনি পুরুষদের বিরুদ্ধে আনা এমন অহরহ শ্লীলতাহানি ও বর্ণবাদীর অভিযোগ তাদের ভিক্টিম হিসেবে না দেখার এক মনস্তাত্বিক স্বীকৃতি আদায় করে।

অপর আরেকটি ঘটনা- ২০২৩ সালের ২২শে অক্টোবর ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় তার পরিবারের ২১ সদস্যকে হারিয়েছেন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আহমেদ আলনাউক। গুড মর্নিং ব্রিটেনকে তিনি তার সাথে হওয়া মর্মাহত ঘটনা প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে আলনাওককে তার গল্প বলার এবং তার দুঃখ প্রকাশ করার জন্য বলা হলেও দ্রুতই এ সাক্ষাৎকার হামাস এবং একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে হামাসের ৭ অক্টোবরের অতর্কিত হামলার ভয়াবহতার বর্ণনার কথোপকথনে পরিণত হয়। আলনাউককে কোনোধরনের ক্ষোভ প্রকাশ করার অনুমতিও দেওয়া হয়নি।

এই ১০৪ দিনের গণহত্যায় ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনি পুরুষদের অপহরণ, নির্যাতন এবং হত্যা করেছে। অসংখ্য বেসামরিক পুরুষ ফিলিস্তিনিকে কোনও প্রমাণ ছাড়াই হামাস যোদ্ধা হিসাবে চিত্রিত করেছে। ইসরায়েলের প্রচারিত এসব নিহত ফিলিস্তিনি পুরুষের  ছবি এবং ভিডিও থেকে প্রিয়জনরা তাদের বেসামরিক হিসেবে শনাক্ত করেছেন। তারা নিশ্চিতও করেছেন প্রকৃতপক্ষেই অনেকেই ছিল বেসামরিক।

প্রায় ১০ বছর আগে, জাদালিয়ার একাডেমিক এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা মায়া মিকদাশি, ‘ফিলিস্তিনি পুরুষ কি ভিকটিম হতে পারে?’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন লিখেছিলেন। এতে মিকদাশি ব্যাখ্যা করেছেন, পশ্চিমা ভিত্তিক গণমাধ্যমে যেসব বেসামরিক মৃত্যুর সংবাদ জোর দিয়ে প্রচারিত হয়েছে অনুপাতিকভাবে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে এমন প্রতিবেদনেরই পুনরাবৃত্তি হয় বারবার। এতে ইসরায়েলের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনি যেসব পুরুষ নিহত হয় তাদের প্রতি জনসাধারণের শোকের স্পষ্ট অভাব দেখা যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো যে সবসময় স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনা বিগত বহু সংঘাত তার প্রমাণ। সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমগুলো নিজ প্রতিষ্ঠান ও দেশের স্বার্থের পক্ষেই বরাবর ব্যবহৃত হয়ে আসছে । ইরাকে মার্কিন ও ব্রিটিশদের হামলায় পশ্চিমা গণমাধ্যম যেভাবে কাভার করেছে, সেটি এখনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। সাদ্দামের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে- এমন অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমারা ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা চালায়। পরে অবশ্য সেই অস্ত্র মজুদের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ছিল না জাতিসংঘের অনুমতিও। একচেটিয়া যুক্তরাষ্ট্র একপ্রকার গায়ের জোরেই ইরাকে হামলা চালায়। পশ্চিমা গণমাধ্যমের নিরুঙ্কুশ সমর্থন এই হামলাকে এক মহান পদক্ষেপের মর্যাদা দেয়। গণমাধ্যমের ইতিবাচক প্রচারের কারণে যুদ্ধের আগে যেখানে পক্ষে পঞ্চাশ শতাংশের একটু বেশি সমর্থন ছিল, সেখানে যুদ্ধের পর সমর্থন দাঁড়ায় ৭২ শতাংশে।

ছবি: ইসরায়েল-হামাস সংঘাত সংশ্লিষ্ঠতায় বিক্ষোভকারীর পোস্টার

 

একই মনোবৃত্তির চিত্রায়ন এই ইসরায়েল-হামাস সংঘাতেও। ইসরায়েলি হামলায় বহু ফিলিস্তিনি বেসামরিক নিহত হওয়ার পরেও যুদ্ধবিরতির বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অনড় সমর্থন রয়েই গেছে। তারা বারবার ইসরায়েলের এ গণহত্যাকে ‘আত্মরক্ষার লড়াই’ বলে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে। এমন প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোও।পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর এমন ফিলিস্তিনবিরোধী প্রচারণা ইসরায়েল বাহিনীর পরিচালিত গণহত্যাকে শুধু ন্যায্যতাই দেয়না, বরং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনও ঘটাচ্ছে। 

৭ই অক্টোবর থেকেই ইসরায়েলপন্থীরা হামাস যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি নারীদের ধর্ষণের নানা বর্ণনা দিয়ে এসছিল। কিন্তু সাময়িক যুদ্ধ বিরতি চলাকালীন সময়ে হামাস যেসব জিম্মিদের মুক্তি দেয় তাদের কাউকেই এমন অভিযোগ করতে দেখা যায় না। বরং জিম্মিদের নিরাপত্তায় হামাসের ইতিবাচক পদক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে। শুধুমাত্র গাজাবাসীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত চলমান গণহত্যাকে একটি আইনি ন্যায্যতা দেওয়াই কি তাহলে এমন প্রচারণার উদ্দেশ্য!

যদিও পশ্চিমা গণমাধ্যমের এমন প্রচারণা গণহত্যার ন্যায্যতাই তৈরি করেনি, বরং ফিলিস্তিনি পুরুষদের হিংসাত্মক মিসজিনিস্ট এমনকি ধর্ষক হিসেবেও পাঠক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। 

সিএনএন প্রতিনিধি প্রমিলা জয়পাল বলেছেন, আমাদের ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিষয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সিএনএন প্রতিনিধি ডানা বাশ উত্তরে বলেন, আপনি দেখতে পাচ্ছেন না যে ইসরায়েলি সৈন্যরা ফিলিস্তিনি নারীদের ধর্ষণ করছে?

গাজায় পরিবারের সাথে নিরাপদ স্থানে স্থানাস্তরিত হওয়ার সময় সমস্ত পোশাক খুলে ফেলতে বাধ্য করার ভয়ঙ্কর সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন যে তাদের লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। এমনকি একজন গর্ভবতী নারীসহ ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধের সময় শুধুমাত্র ফিলিস্তিনি নারীরাই যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন না, বরং ফিলিস্তিনি পুরুষদের বিরুদ্ধেও মিথ্যে শ্লীলতাহানীর অভিযোগ আনা হচ্ছে বলে একাধিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে।

ফিলিস্তিনি রিটার্ন সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনী ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি পুরুষকে তাদের অন্তর্বাস খুলে, চোখ বেঁধে এবং উত্তর গাজার একটি রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখে। এরপর থেকেই মূলত ক্রমবর্ধমানভাবে যৌন নির্যাতনের রিপোর্ট  প্রকাশিত হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর এমন কর্মকাণ্ডের ছবি এবং ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এদিকে ৭ই অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি পুরুষদের নির্যাতন ও অপব্যবহারের সম্মুখীন হওয়ার অনেক বিবরণও রয়েছে বলে জানায় সেন্টারটি।

ফিলিস্তিনি শিশুদের অধিকার সংস্থা ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল প্যালেস্টাইন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে একটি ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি কিশোরীকে ধর্ষণের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সাবেক পরিচালক জোশ পলের কাছ থেকে একটি চমকপ্রদ প্রমাণ পাওয়া যায়। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এ ধরনের মামলার বিষয়ে খোঁজখবর নিলে, মানবাধিকার সংগঠনটিকে আরও ৫টি সামাজিক গ্রুপের সাথে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে বর্ণনা করা হয়।

পাবলিক কমিটির পরিচালিত ইসরায়েলে নির্যাতন-বিরোধী একটি গবেষণায় যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন সহিংসতার শিকার নির্যাতিত হাজার হাজার ফিলিস্তিনি পুরুষদের সাক্ষ্য সংগ্রহ করা হয়। রিপোর্টটিতে দেখা যায়, পদ্ধতিগত যৌন সহিংসতা পরিচালনা করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ।

ফিলিস্তিনি গণহত্যার ‘জেন্ডার ছাঁচিকরণ’ করার নেপথ্যে রয়েছে- ফিলিস্তিনি পুরুষদের ভিক্টিম হিসেবে পরিচিত হতে না দেওয়ার প্রয়াস। তাদের সাথে হওয়া সহিংসতাকে গোপন রাখা এবং তাদের ওপর হওয়া নির্যাতনকে রুটিন অনুশীলন হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করাই এমন নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির রাজনৈতিক অর্থনীতি।

একটি সংঘাত মানে শুধুমাত্র নারী এবং শিশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, বরং গোটা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতও তেমনি সকল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এবং প্রতিটি ফিলিস্তিনি সংস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রচারণা করে এমন মানবাধিকারবিরোধী কার্যক্রমকে মদদ দেওয়া তাই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পরিপন্থী কাজ। সংঘাত দীর্ঘায়িত হওয়ার পেছনে পশ্চিমা গণমাধ্যমের দায় তাই এড়ানোর সুযোগ নেই। 

সূত্র: দ্য নিউ আরব

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *