সারাদেশ

চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি, মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ

ডেস্ক রিপোর্ট: ‘রিপোর্ট করে লাভ কি ডিজিটাল কিছু করুন। সব ডিজিটাল হচ্ছে এটা কেন বাদ যাবে। ঝাঁকায় করে বিদ্যুৎ বিক্রি হচ্ছে সংসদে। গ্যাস দেখি না, কিন্তু বিল ঠিকই দিচ্ছি। এই টাকা যাচ্ছে কোথায়? কষ্টের টাকা সবার’ আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মিরপুরে বসবাস করা উম্মেহানি নিপা।

মিরপুরের মত রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় দেখা দিয়েছে গ্যাসের সংকট। তার মধ্যে সবচেয়ে তীব্র গ্যাসের সংকট নারিন্দা, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, যাত্রাবাড়ি, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মানিকদি, ডেমরা, লালবাগ, শনিরআখড়া, গোবিন্দপুর, মাতুয়াইল মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গীচর, মহাখালী, পল্লবী, কাফরুল, শেওড়াপাড়া, রায়েরবাগ, ভূতের গলি, গ্রিনরোড, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, মগবাজার, বাসাবো, আরামবাগ, পোস্তগোলা, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা ও মুগদা সহ রাজধানীর আরও বেশ কিছু এলাকায়।

রাজধানীর ডেমরায় পরিবারসহ থাকেন জুবায়ের হোসেন, চাকরি করেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। চার সদস্যের পরিবারের দুই ছেলে মেয়ে সকালে স্কুলে যায়, নিজে অফিসের জন্য বের হন তবে গ্যাস না থাকায় সকালে না খেয়েই বের হতে হয় প্রায় সময়। তবে শীত আসায় সে সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

গত চার বছর যাবত এ সমস্যায় ভুগছেন জানিয়ে বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, ‘১ম দিকে সকাল ৮-৯ দিকে যেত আবার দুপুর ২-৩ টার মধ্যে আসত। কিছুদিন পর, সকালে গেলে আসত সন্ধ্যায়। তারও কিছুদিন পর। রাত ১১-১২ টার দিকে আসত আর চলে যেত সকাল ৫ টার দিকে। এখন আর আসে না। তবে আলহামদুলিল্লাহ বিল ঠিকই নিচ্ছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারিন্দার এক বাসিন্দা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘হারাদিন গ্যাস থায় না। ভাত-তরকারী রান্ধন তো যায়ে না, এক্কেনা হানি গরমও করণ যায় না। গত এক হপ্তা বাজারতুন ভাত-তরকারী কিনি খাইয়ের। গ্যাস ছাড়া রান্ধনের আর কোনো হত খোলা নাই। আমগো বাঁচি থাকতি অইলে গ্যাস দরকার। এমনে করি আর চরন যার না। মাইনষ্যের জীবন এমনে চইলতো হারে না। সরকারের এত উন্নয়ন আমগো এই অবস্থা চাইবো কত্তে?’

এছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলেন বার্তা২৪.কম এর প্রতিবেদক। তারাও অনেকটা একই কথা জানান, তবে সব এলাকায় গ্যাসের তীব্র সংকট না থাকলেও গ্যাসের চাপ কম থাকছে বলে জানান বাসিন্দারা। অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, রাতে গ্যাস থাকলেও ভোর হবার আগেই গ্যাসের চাপ কমে যাচ্ছে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই তাদের ভোরে উঠে রান্নাবান্না করতে হচ্ছে। আর যদি ঘুম থেকে কোন কারণে উঠতে না পারেন, তাহলে তাদের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।

এতো গেলো বাসা-বাড়িতে দেওয়া গ্যাসের কথা। স্বস্তিতে নেই সিএনজি ও শিল্পকারখানার মালিকরাও। তাদেরও পড়তে হচ্ছে গ্যাস সংকটে, ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন, অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে মালিকদের। গ্যাসের সংকট এভাবেই চলতে থাকলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবারও শঙ্কা দেখা দিচ্ছে।

গ্যাসের সমস্যার কারণে ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ আছে জানিয়ে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বার্তা২৪.কমকে বলেন, গ্যাসের সমস্যার কারণে আমাদের ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ আছে। গ্যাসের সংকটের যদি কোন সমাধান না হয় তাহলে হয়তো আমাদের ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। সরকারের কাছ থেকে আশ্বাস তেমন কিছু পাইনি, বলেছে ২০২৬ সালের আগে সংকট সমাধানের সম্ভাবনা কম। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাস সংকটের উন্নয়ন হবার আশ্বাস দিয়েছে।

গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বাড়ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, উৎপাদন হলে খরচ বাড়বে, উৎপাদন না হলে কি হবে? আমার ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করতে পারছি না, শ্রমিকের বেতন দিতে পারছি না, সংকট গভীর থেকে আরও গভীরে যাচ্ছে।

জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩,৭১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। তবে সে পরিমাণ গ্যাসের যোগান দিতে পারছে না গ্যাস কোম্পানিগুলো। যে কারণে এখন প্রায় প্রতিদিন দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন জ্বালানী বিশেষজ্ঞরা। তবে পেট্রোবাংলা বলছে গড়ে প্রতিদিন এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতিতে আছে দেশে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাসের চাহিদা বিদ্যুৎ খাতে। পেট্রোবাংলার হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চলতি বছরে গ্যাসের চাহিদা হবে দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। তবে উৎপাদন সক্ষমতা আছে ২২৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। তার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র সাড়ে সাতশ-আটশ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। যা মোট উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ।

বাংলাদেশের একমাত্র গ্যাস কোম্পানি পেট্রোবাংলার সূত্রে জানা যায়, দেশে আবিষ্কৃত বর্তমান কূপে মোট মজুদ গ্যাসের পরিমাণ ৮.৬৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। যা আগামী দশ বছর গ্যাসের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। অন্যদিকে দেশের ২২টি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন কমবেশি দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে আমদানি করা ছাড়া কোন রাস্তা নেই সরকারের সামনে।

এমন অবস্থায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সংকটের স্থায়ী সমাধানে সাগরে ও স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিতে হবে। বাপেক্সের সে সক্ষমতা না থাকলে প্রয়োজনে বিদেশি কোম্পানিগুলোকেও গ্যাস অনুসন্ধানে সম্পৃক্ত করতে হবে। যদি নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার না করা যায় তাহলে এই সংকট কখনোই উত্তরণ করা যাবে না।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, গ্যাস সংকটের প্রধান কারণ জ্বালানীর উৎপাদন কমা ও আমদানি নির্ভরতা। যে কারণে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন আবার ডলার সংকটের ফলে আমদানিও বাড়াতে পারছে না সরকার। ফলে বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে জ্বালানি সংকটকেই প্রধান করে দেখছেন তারা।

এ বছরই সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এবার ৪৬টা কূপ খনন করবো দুই বছরে। আরো একশ কূপ খনন করবো পঁচিশ সালের মধ্যে। তাতে আমি আশাবাদী যে দুই বছরের মধ্যে আমরা আরো ৫শ মিলিয়ন যোগ করবো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড.বদরূল ইমাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, গ্যাস সংকটের প্রধান কারণ চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো হয়নি বরং কমে গেছে। বেশ কয়েকবছর ধরে আমাদের উৎপাদন কমের দিকে গেছে। আমাদের এলএনজি আমদানী করা জাহাজ দুটো খারাপ হবার ফলে তারাও পর্যাপ্ত পরিমাণ সাপ্লাই দিতে পারছে না। এই সব কিছু মিলিয়ে গ্যাসের সাপ্লাই কমে গেছে ফলে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, এর ফলে শিল্পে গ্যাস পাচ্ছে না, বাসা বাড়িতে চুলায় অনেকে গ্যাস পাচ্ছে না। তবে আগামী গ্রীষ্মকালে আরও বড় আকারে দেখা দিবে যদি গ্যাস সাপ্লাই বাড়ানো না যায়। কারণ অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তো গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। তখন লোডশেডিং অনেক বেড়ে যাবে। ফলে আগামী গ্রীষ্মকাল অনেক ক্রিটিকাল হতে পারে।

গ্যাসের সংকট কাটাতে উৎপাদন বাড়াতে হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, উৎপাদন দুইভাবে বাড়ানো যায়, হয় নতুন কূপ খনন করতে হবে, নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করতে হবে আর যেখানে কূপ আছে সেখানে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *