সারাদেশ

মধু ও মধু তৈরির কারিগর

ডেস্ক রিপোর্ট: মধু প্রকৃতির এক অসাধারণ সৃষ্টি। এর চেয়ে সুমিষ্ট ও বিশুদ্ধ কোন প্রাকৃতিক খাদ্য আছে কি-না সন্দেহ? চাক ভাঙা মধুর মৌ-মৌ গন্ধই আলাদা। এই গন্ধে পিঁপড়ে-মাছিদের মন নেচে ওঠে। ভালুকের জিবে আসে জল। আর মানুষের মনে জাগে আনন্দ। মধু পানে আসে তৃপ্তি। স্বাস্থ্য হয় সবল। মন হয় সতেজ। সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মধু ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কি এর কোন বিকল্প তৈরি করতে পেরেছে? পারেনি। আর তাই এই সোনালি তরল মধু মানুষের কাছে আজও রহস্যই রয়ে গেছে।

মধুর কথা বলতে গেলে মৌমাছিদের কথাও এসে পড়ে। কারণ, এরাই হচ্ছে মধু তৈরির কারিগর। কীটপতঙ্গের মধ্যে মৌমাছিরাই আমাদের সবচেয়ে উপকারী বন্ধু। এরা একদিকে যেমন পরাগায়নের মাধ্যমে ফল-ফসল উৎপাদনে সাহায্য করে, অন্যদিকে তেমনি অমৃত সুধা মন প্রাণ ভরিয়ে দেয়। তাই মৌমাছির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। মৌমাছি পৃথিবীর অত্যন্ত প্রাচীন অদিবাসী। আদিম মানুষের উদ্ভবেরও প্রায় পাঁচ কোটি ষাট লাখ বছর আগে এদের আবির্ভাব ঘটে। মানুষের সঙ্গে মৌমাছির ঘনিষ্ট সম্পর্কের কথা জানা যায় প্রাচীন সংস্কৃতির বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যমে। মৌমাছি সম্পর্কে মিশরীয়দের আগ্রহের কথা জানা যায় জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদদের আবিষ্কারের মাধ্যমে। তারা মিশরের আবুসির-এ কতকগুলো পুরনো ধর্ম গ্রন্থ আবিস্কার করেন, যাতে মৌমাছি পালনের কথা উল্লেখ রয়েছে। সূত্র মতে, মৌমাছি পালন ও মধু আহরণের প্রথা মানব সভ্যতার মধ্যে প্রায় ৫,০০০ বছর ধরে বিদ্যমান। মিশরের ফারাও তুতানখামুন-এর কবরে সংরক্ষিত অবস্থায় প্রায় তিন হাজার বছরেরও আগের পুরনো মধু পাওয়া গেছে। গবেষণাগারে এ মধু বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা রীতিমতো ভড়কে গেছেন, কারণ এ মধু ছিলো সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ।

স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ার কাছে ’কুয়েভাস দে লা আরানা’-এ মধু সংগ্রহের ৮,০০০ বছরের পুরনো গুহা চিত্র। সূত্র: ইন্টারনেট। মধু ও মৌমাছি সংক্রান্ত সবচেয়ে প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি পাওয়া গেছে স্পেনে। এটি ১৯১৯ সালের ভ্যালেপিয়ার বাইকার্পের কাছে অবস্থিত কৃভ্যা দ্য লা আরোনা-তে (মাকড়সার গুহা) আবিষ্কৃত হয় যা ছিল লাল রঙে আঁকা মধু সংগ্রহকারিদের একটি প্রস্তরচিত্র। প্রস্তরচিত্রটি এরকম- দুজন লোক ঘাসে পাকানো দড়ি বেয়ে পাহাড়ের খাড়া ঢালের একটি প্রাকৃতিক কোটর বরাবর উঠেছে। কোটরটিকে শিল্পী স্পষ্টত বুনো মৌমাছিদের আবাস্থল হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। লোক দু’জনের একজন কোটর থেকে মৌচাক বের করে নিচে নামানোর জন্য থলে বা ঝুড়িতে রাখতে ব্যস্ত। বিক্ষুব্ধ কিছু মৌমাছি অনাহুত আগন্তুকের চারপাশে গুঞ্জন করে করে উড়ছে। তবে, চিত্রে মৌমাছিগুলোকে লোকটির আকৃতির অনুপাতে বেশ বড় করে আঁকা হয়েছে। যদিও প্রস্তরচিত্রটির বয়স নিয়ে বিজ।হানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, তবে এটি প্রায় ৮,০০০ বছরের পুরনো বলে ধারনা করা হয়।

প্রাচীনকালের মানুষ মৌমাছিকে অন্যান্য কীট-পতঙ্গ ও পশু-পাখির থেকে বেশি মর্যাদা দিয়েছে। বহু পৌরাণিক কাহিনী, উপকথা, গল্প, কুসংস্কার ও রূপকথার জন্ম দিয়েছে এই মৌমাছি। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে আনত মাথা ও স্বল্পোথিত ডানাযুক্ত মৌমাছি ছিল প্রাচীন দক্ষিণ মিসরের প্রতীক। ফারাও-এর প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করতে প্রতীক হিসেবে মিসরীয়রা আবেদনপত্রে মৌমাছির একটি ছবি এঁকে দিত। মৌমাছি ছিল তাদের কাছে নিঃস্বার্থ ও নির্ভরতার প্রতীক এবং বিপদ ও মৃত্যুকে উপেক্ষা করার শক্তি। এছাড়ও মৌমাছিকে তারা পবিত্রতার আদর্শ ও শৃঙ্খলার রক্ষক হিসাবে দেখত।

গাজীপুরস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দৈত্যকায় মৌমাছির গড়া বিশালাকার মৌচাক। ছবি- আ ন ম আমিনুর রহমান এখন পর্যন্ত জর্জিয়ায় মধুর প্রাচীনতম অবশেষ পাওয়া গেছে, যা ৪,৭০০ থেকে ৫,৫০০ বছরের পুরনো বলে ধারনা করা হয়। মিশরের কায়রোর কাছে ২,৪০০ খ্রীষ্টপূর্বে নির্মিত সূর্য মন্দিরে মানুষের মৌচাক রাখার প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন লিপিকারদের রচনা থেকে জানা যায়, ব্যাবিলন সাম্রাজ্যে মৌমাছি পালন করা হতো। খ্রীষ্টের জন্মের প্রথম সহস্রাব্দে আসিরিয়াকে মধু ও জলপাইয়ের দেশ হিসাবে গণ্য করা হতো। সূর্যের অবতার এবং জগতের স্রষ্টা হিসাবে পরিচিত বিষ্ণুকে কখনও কখনও পদ্মফুলের পেয়ালার ওপর বসা ছোট্ট মৌমাছি হিসেবে, আবার কখনওবা তাকে মাথার ওপর উড়ন্ত একটি নীল মৌমাছি সমেত চিত্রিত করা হয়েছে। প্রাচীন গ্রীকরা যাযাবর রীতিতে মৌমাছি পালনে অর্জন করেছিল চরম সাফল্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দার্শনিক, লেখক ও পণ্ডিততবর্গ মৌমাছি সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন, রূপকথা আর শত শত বছরের পুরনো দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে জানা যায়, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগনের মধ্যে সুদূর অতীতেই মৌমাছি পালন ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছিল। বর্তমান বিশ্বে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি মধু উৎপন্ন করে। ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক মধু উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১.৭৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন।

১৭৫৮ সালে প্রখ্যাত সুইডিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও ডাক্তার ক্যারোলাস লিনিয়াস মৌমাছির নাম দেন Apis mellifera (মধুবহ); তিন বছর পর তিনি এর নাম Apis mellifica (মধুকর) হওয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করেন। তবে, তাঁর দেয়া প্রথম নামটিই আজ পর্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রচলিত। মৌমাছি সামাজিক প্রাণী।

ঢাকার কেরাণীগঞ্জে ফুলের নির্যাস সংগ্রহে ব্যস্ত দৈত্যকায় মৌমাছি। ছবি- আ ন ম আমিনুর রহমান বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় ২০,০০০ প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে, যাদের মধ্যে মাত্র সাত প্রজাতি আমাদের প্রিয় খাদ্য মধু উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত। এসব প্রজাতির রয়েছে বহুসংখ্যাক উপপ্রজাতি ও জাত। বাংলাদেশের মৌমাছির প্রজাতির মধ্যে চারটি উল্লেখ্যযোগ্য, যেমন- ১) পশ্চিমা/ইউরোপীয় মৌমাছি (Apis mellifera)- এটি স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় দেখা যায়। এটির অন্তত ২০টি স্বীকৃত উপ-প্রজাতি ও জাতি রয়েছে। পরাগায়ন এবং মধু উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক সুবিধার কারণে উপ-প্রজাতিগুলি তাদের প্রাকৃতিক সীমার বাইরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের মৌমাছি পালনকারীরা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক প্রজাতিগুলো পালনের জন্য বেশি আগ্রহী। ২) পূর্ব/এশিয়াটিক/এশীয় মৌমাছি (Apis cerana)- এই প্রজাতির আদি নিবাস দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়া। ৩) বামন/লাল বামন মৌমাছি (Apis florea)- দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট, বন্য মৌমাছির দুটি প্রজাতির মধ্যে একটি। ৪) দৈত্যাকার মৌমাছি (Apis dorsata)- দৈত্যাকার মৌমাছি প্রধাণত সুন্দরবন ও দেশের অন্যান্য অংশে প্রাকৃতিক মধু উৎপাদনের প্রধান কারিগর। এই বুনো প্রজাতিটি হিংস্র হতে পারে এবং এদের কামড়ে জ্বর ও ডায়রিয়া হয়। এটি সুন্দরবনের বড় গাছে এবং অন্যান্য স্থানে পাশাপাশি ভবনের কার্নিশের উপর বড় আকারের মৌচাক তৈরি করে।

পাবনা শহরের কাছে মৌমাছির খামারে ইউরোপীয় মৌমাছি। আলোকচিত্রী- আ ন ম আমিনুর রহমান। মৌমাছি একসঙ্গে মিলে উপনিবেশ তৈরি করে বসবাস করে। মৌমাছিদের উপনিবেশে তিন ধরনের মৌমাছি থাকে: রানী মৌমাছি (উর্বর স্ত্রী মৌমাছি), পুরুষ মৌমাছি ও কর্মী মৌমাছি (অনুর্বর স্ত্রী মৌমাছি)। সাধারণত একটি উপনিবেশে একটি রানী মৌমাছি , কয়েকশ পুরুষ ও হাজার হাজার (এমনকি লাখ লাখ) কর্মী মৌমাছি বাস করে। মৌমাছির উপনিবেশ বা কলোনিতে বিভিন্ন ধরনের মৌমাছির অবস্থান ও মর্যাদাকে প্রাচীন মিশরিয়ারা ফারাও, তার অনুচর ও সভাসদ এবর চাকর-বাকরদের সঙ্গে তুলনা করত। মৌমাছি কলোনির রানীকে তারা তাদের ফারাও-এর সঙ্গে তুলনা করতো যার চারদিকে থাকত বিশ্বস্ত অনুচর ও সভাসদ (অর্থাৎ পুরুষ মৌমাছি)। আর থাকত বহু চাকর (কর্মী মৌমাছি) যারা ফারও-এর (রাণী মৌমাছি) পায়ে মিষ্টি মধু ঢেলে শ্রদ্ধা জানাত।

বিভিন্ন মৌচাকের মধুর রঙ ও মান কিন্তু এক নয়। মধুর রঙ ও মান নির্ভর করে ফুলের উপর, যা থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে। মধু চটচটে তরল পদার্থ। টাকটা অবস্থায় এর রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার। কিন্তু ভালোভাবে সংরক্ষণ না করলে রঙ ঘোলাটে হয়ে যায়। ডেক্সট্রিন জাতীয় উপাদানের কারণে মধু চটচটে ও আঠালো হয়।

পঞ্চগড়ের বোদায় মৌমাছির খামারে এশীয় মৌমাছি। আলোকচিত্রী- আ ন ম আমিনুর রহমান। রাসায়নিকভাবে মধুতে অল্প পরিমাণ পানি, লেডুলোজ (৪০-৫০%), ডেক্টট্রোজ (৩২-৩৭%), সুক্রোজ (২%), গাম, তেল, চর্বি, খনিজ ও ভিটামিন রয়েছে। খনিজের মধ্যে লোহা, কপার, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, সালফার, অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও ক্যালসিয়ামই প্রধান। এছাড়াও মধুতে মল্টোজ, এনজাইম, অ্যামিনো অ্যাসিড, ম্যালিক অ্যাসিড ও সাইট্রিক অ্যাসিড রয়েছে।

বিখ্যাত রাশিয়ান কীটতত্ত্ববিদ ইউজিন অ্যারাফ-এর গবেষণায় দেখা গেছে, মৌমাছিকে ফুলের সুধার (Nectar) পরিবর্তে ফলের রস (Juice) খাওয়ালে উৎপাদিত মধুতে ভিটামিনের পরিমাণ বেশি হয়। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ল ভন ফ্রিশ ও হেরাল্ড ইশ এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্বিবিদ্যালয়ের এ এম ওয়েনার এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, মৌমাছিরা মধুর উৎস ফুল খুঁজে পাওয়ার পর উৎসের দূরত্ব ও দিক, ফুলের সুধার গুণাগুণ ইত্যাদি সম্পর্কে চাকের মৌমাছিদের অদ্ভুতভাবে তথ্য দিতে পারে। আর এটি শ্রবণ, দর্শন ও রাসায়নিক স্পর্শের মাধ্যমে ঘটে থাকে।

ঢাকার উত্তরায় বামন মৌমাছি ফুলের নির্যাস সংগ্রহে ব্যস্ত। আলোকচিত্রী- আ ন ম আমিনুর রহমান। একটি শ্রমিক মৌমাছি ফুল থেকে সুধা সংগ্রহ করে মৌচাকে ফিরে এসে সুধা ও পরাগরেণূ মৌচাকের কোষে জমা করার পর এ কাজটি করতে পারার আনন্দে নেচে নেচে উল্লাস প্রকাশ করে। কীটতত্ত্ববিদরা বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে এগুলো শণাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। সুধার উৎস (ফুল) মৌচাকের নিকটে হলে মৌমাছি সামনের দিকে একটি সোজা লাইন তৈরি করে দৌড় দেয়, এদিক-ওদিক নাড়িয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে এবং সবশেষে আবার সামনের দিকে দৌড় লাগায়।

কোন একটি নির্দিষ্ট দিকে দৌড় দেয়ার মাধ্যমে এরা মৌচাক থেকে সুধার উৎসের দিক নির্দেশ করে এবং প্রতি একক সময়ে দিক পাল্টানোর সংখ্যা দিয়ে মৌচাক থেকে উৎসের দূরত্ব নির্দেশ করে। এদের রোমশ শরীরে লেগে থাকা পরাগরেণূর মাধ্যমে সুধা সংগ্রহকারী ফুলের ধরন বা প্রজাতি জানা যায়।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে মৌমাছির বাণিজ্যিক খামার। আলোকচিত্রী- আ ন ম আমিনুর রহমান মধুর নানা গুণের কথা বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের কাছে জানা। পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে মধূর উল্লেখ আছে। বাইবেলে তিন ধরনের মধুর কথা বর্ণিত হয়েছে। হিন্দুদের বেদ শাস্ত্রেও মধুর উল্লেখ রয়েছে। ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থে মধুর অপূর্ব স্বাদের কথা বলা আছে। দলিল-দস্তাবেজ অনুযায়ী, প্রাচীন মিসরীয়রা মৃত ব্যক্তিদের দেহ সংরক্ষণের জন্য মধু ব্যবহার করতো। তাছাড়া হিন্দু দেবতারা অবগাহনের জন্যও মধু ব্যবহার করত।

মধু স্মরণাতীতকাল থেকেই ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশ্বের সর্বত্র, প্রাচীন পূরাণে, মধুর বলকারক ও স্বাস্থ্যপ্রদ গুণাবলী এবং যাদুকরি আরোগ্যকারী ক্ষমতার প্রশংসা করা হয়েছে। মধ্যযুগে মধু ক্ষতের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া মুখগহ্বর ও গলার প্রদাহ, পরিপাকতন্ত্রের অসুস্থতা ও আলসারের চিকিৎসায় মধু ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। এটি খাদ্য ও ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মানুষের পাশাপাশি পশুচিকিৎসাতেও মধুর ব্যবহার আছে।

শ্রীমঙ্গলের বাণিজ্যিক খামারে উৎপাদিত বোতলজাত মধু। আলোকচিত্রী- আ ন ম আমিনুর রহমান কথিত আছে, রুগ্ন ঘোড়াকে মধূ ও ভূষি মিশিয়ে খাওয়ালে এরা দ্রুত স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠে। হোমারের ইডিপাশে উল্লেখ আছে, ডাইওমাডেস (Diomades) তার ঘোড়াকে মধুমিশ্রিত বার্লি খাওয়াতো। জুলিয়াস সিজার পোলিও রুমিলিয়াসের শততম জম্মবার্ষিকীতে দেয়া ভোজসভায় তার দেহ-মনের সংরক্ষণের গোপন রহস্যটি কী জানতে চাইলে উত্তরে রুমিলিয়াস বলেছিলেন- “Internus melle, externus olio (অভ্যন্তরীন মধু, বাহ্যিক স্বাস্থ্য“ অর্থাৎ মধু পানের তার দেহ-মনের সুস্থতা সংরক্ষিত হয়েছে। যুদ্ধের বিজয়োৎসবে রোমান সৈন্যরা দীর্ঘ জীবন লাভের আশায় মধূ ও মদ একত্রে পান করত। গ্রীক অ্যাথলেটরা অলিম্পিক এরেনায় প্রবেশের পূর্বে মধু পান করত।

পৃথিবীর বহু নরগোষ্ঠীই মধুকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। মধুকে দুধ, দই, ছানা, পনির, সিরিয়াল ও রুটির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। আফ্রিকার কোনো কোনো অঞ্চলে মধুকে চোলাই করে মদে রূপান্তরিত করা হয় যা শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে পান করা হয়ে থাকে। মধু ও মদের মিশ্রিত দ্রবণকে ’দেবতাদের পানীয়’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। প্রাচীন কবিতায় ইন্দোনিশয়ার বালি দ্বীপকে মধুর দ্বীপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ বালির অতিথিরা প্রচুর পরিমাণে মিড (মধু ও মদের মিশ্রিত দ্রবণ) পান করত। একটি পুরনো ফরাসী প্রথা অনুযায়ী নববিবাহিত দম্পতিদের বিয়ের পরই একাধারে ত্রিশদিন নির্দিষ্ট সময় মধুপান করতে হতো। আর এ থেকেই বর্তমানকালের বহুল প্রচলিত মধুচন্দ্রিমা বা হানিমুন-এর উৎপত্তি হয়েছে। ইহুদীদের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, কোনো শিক্ষার্থী যদি কোনো বইয়ের প্রথম বর্ণের উপর একফোটা মধু রেখে তা চুষে খায়, তবে সে মিষ্টতার সঙ্গে পড়াটি মনে রাখার শক্তি অর্জন করে।

যুদ্ধক্ষেত্রে বিষাক্ত রাসায়নিকে ব্যবহার খুব বেশিদিন আগের নয়। কিন্তু একাজের জন্য বিষাক্ত মধুর ব্যবহার বহু প্রাচীনকালের। আর একাজে বিষাক্ত মধুও রাসায়নিকের মতোই কার্যকর ছিল। বিরোধপূর্ণ পার্বত্য এলাকা নিয়ে যখন পম্পেই নগরীর সেনাপতিদের সঙ্গে আলাপ অলোচনা চলছিল তখন হেপ্টোকোমিস পম্পেইয়ের রাস্তায় পিপে পিপে বিষাক্ত মধু রেখে দিয়েছিল। আর সেই মধু পানেই পম্পেই-এর সৈন্যরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। পরবর্তীকালে গবেষণায় দেখা গেছে Rhododrendon ponticomus-এর সুধা থেকে উৎপন্ন মধু বিষাক্ত হয়ে থাকে।

জৈব পদার্থ সংরক্ষণেও মধু যথেষ্ট কার্যকর। তাই জৈব পদার্থ সংরক্ষণে মধুর ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলল। মধ্য যুগে ইংল্যান্ডে মাংস ও চামড়া কিউরিংয়ে মধু ব্যবহার করা হতো। ‘অলেকেজান্ডার দ্য গ্রেট’-এর মৃত্যুর পর তার মরদেহ মধু ও মৌ মোমের সমন্বয়ে সংরক্ষিত হয়েছিল। বর্ষা মৌসুমে শুকনো জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ তরা কঠিন বিধায় বার্মার লোকেরা শুকনো জ্বালানী কাঠ জোগাড় করা পর্যন্ত মৃতদেহকে মধুতে সংরক্ষণ করা হতো।

 রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার প্রেমতলীতে দৈত্যকায় মৌমাছির ছবি তোলায় ব্যস্ত লেখক। আলোকচিত্রী- তানভীর ইয়াছির ত্বকের উপর মধুর উপকারী প্রভাব প্রাচীনকাল থেকেই সুপরিচিত। প্রাকৃতিক সংরক্ষণ উপাদান থাকায় মধু কখনই নষ্ট হয় না। মিশরীয় ফারাও আখেনাতেনের স্ত্রী নেফারতিতি (১৩৭০ খ্রিস্টপূর্ব), তার দৈহিক সৌন্দর্য রক্ষায় নিয়মিত মধু ব্যবহার করতেন। আসলে নেফারতিতি নামটি তারা উচ্চারণ করত ’নাফতেটা’ যার অর্থ ‘সৌন্দর্য’। ক্লিওপেট্রা (৬৯ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৩০খ্রিস্টপূর্ব) ত্বককে মসৃণ ও দৃঢ় রাখতে তার দৈনন্দিন রূপচর্চায় মধু ব্যবহার করতেন। তিনি স্নানের পানিতে দুধ ও মধু যোগ করতেন। সম্রাট নিরোর দ্বিতীয় স্ত্রী পপিয়া সাবিনা (৩০ থেকে ৬৫ খ্রিস্টাব্দ) দুধ ও মধু লোশন দিয়ে দিনে ৭ বার মুখ ধুতেন। চীনে মিং রাজবংশের শাষণামলে (১,৩৬৮ থেকে ১,৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সম্রাটের দরবারের মহিলারা তাদের ত্বককে সতেজ ও দাগমুক্ত রাখতে মধু এবং কমলালেবুর বীজের মিশ্রণ ব্যবহার করতেন। ফ্রান্সের রাজা ১৫ তম লুই-এর শেষ উপপত্নী মাদাম ডু ব্যারি (১,৪৩ থেকে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ) মুখের মুখোশ হিসাবে মধু ব্যবহার করতেন। তার রূপচর্চার অংশই ছিল মুখোশ লাগানোর পরে শুয়ে থাকা ও বিশ্রাম নেওয়া। জাপানি মহিলারা তাদের হাতের সৌন্দর্য বাড়াতে মধু থেকে তৈরি লোশন ব্যবহার করেন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটস রোগিদের ব্যবস্থাপত্রে মধু দিতেন। প্লিনি (Pliny) মধুকে বহু ধরনের ঔষধের উপশমক হিসেবে বিবেচনা করতেন। মধু এতটাই দামি যে, একবার এর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে বিবাদ লেগে যায়। ১৮৪০ সালে আইওয়া ও মিসৌরি অঙ্গরাজ্য মৌচাকভর্তি গাছ নিয়ে বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। দুটি অঙ্গরাজ্যই এগুলোকে নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করতে থাকে। দীর্ঘ এগার বছর মামলা-মোকদ্দমার পর নিষ্পত্তি হয় ঠিকই, কিন্তু ততদিনে এটি ‘মধু যুদ্ধ’ (Honey War) নামে পরিচিতি লাভ করে ফেলে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগমনের সাথে সাথে বিজ্ঞানের বড় অগ্রগতি, যেমন- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, প্যাটার্ন রিকগনিশান, মেশিন লার্নিং ইত্যাদি হওয়া সত্ত্বেও আমরা এখনও প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত শিষ্টি তরল সোনা মধু নিয়ে বিস্মিত- এর গোপনীয়তা খুঁজে পেতে এখনও দুর্ভেদ্যই রয়ে গেছে। তাইতো মধুর রহস্য এখনও অটুট।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *