সারাদেশ

‘শীতনিদ্রায়’ আন্দোলন

ডেস্ক রিপোর্ট: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির ‘এক দফা’র আন্দোলন কার্যত ঘোষণা ছাড়াই শেষ। যথাসময়ে নির্বাচনের পর নতুন সরকারের মন্ত্রিসভাও কাজ শুরু করেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলছে। ৩০ জানুয়ারিতে শুরু হওয়া অধিবেশন চলবে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো কর্মসূচি থেকে পিছু হটেছে। মনে হচ্ছে না আর কোন টানা কর্মসূচি আসবে, এবং আসলেও সে কর্মসূচিগুলোতে দলগুলোর নেতাকর্মীরা কোনোভাবে সম্পৃক্ত হবে বলেও মনে হচ্ছে না।

নির্বাচন থেকে শুরু করে সরকার গঠন, সংসদ অধিবেশন সবকিছু সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছে। সংসদে বিরোধী দল নির্বাচনও হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের পছন্দে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সংসদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন লাভ করলেও নানা বাধ্যবাধকতা ও সরকারের সিদ্ধান্তেই মাত্র ১১ আসন পাওয়া জাতীয় পার্টি হয়েছে সংসদের প্রধান বিরোধীদল। এরবাইরে অবশ্য আর দল আছে একটি যারা নিজস্ব দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল; বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবং কল্যাণ পার্টি ছাড়া বাকি সকলেই আওয়ামী লীগের আনুকূল্যে সংসদ সদস্য। অবশ্য কল্যাণ পার্টির মোহাম্মদ ইবরাহিমও নির্বাচনে জিতে আসতে পেয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের বৃহৎ অংশের সমর্থন, তা না হলে এক-এগারোর ‘কিংস পার্টি’র এই নেতা সংসদ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতেন কিনা সেখানেও আছে ঢের সন্দেহ!

সংসদে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র রাজত্ব। জাতীয় পার্টি নামেমাত্র প্রধান বিরোধী দল। দলটির যে এগারো নেতা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সকলেই আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়ে এসেছেন। আওয়ামী লীগ সমঝোতার ভিত্তিতে ওইসব আসন ছেড়ে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের ছাড় দেওয়া ২৬ আসনের মধ্যে মাত্র ১১টি আসনে জিতে আসতে পেরেছেন জাতীয় পার্টির নেতারা। ফলে দলটি বিরোধী দল হিসেবে কাগজেকলমে থাকলেও কার্যত তারা সরকার-দল আওয়ামী লীগের মুখাপেক্ষী।

যে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে জিতেছেন তাদের মধ্যে অন্তত ৫৯ জন আওয়ামী লীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা। তারা স্বতন্ত্র ভাবে নির্বাচনে জিতলেও সংসদে গিয়ে যতটা না স্বতন্ত্র, তারচেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের। সংসদ অধিবেশন শুরুর আগে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদেরকে গণভবনে ডেকেছিলেন এবং সেখানে গিয়ে তারা দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ ঘটিয়ে এসেছেন। নিজেদেরকে তারা আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করার পাশাপাশি সরকারের অংশ হিসেবে থাকারও দাবি করেছেন এবং এই দাবি গ্রহণের সানুগ্রহ অনুরোধ করেও এসেছেন। সংরক্ষিত নারী আসনে আনুপাতিক হারে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ থাকলেও তারা সে সুযোগটা নেননি, এটা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়ে দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ করেছেন। স্বতন্ত্রদের এই ‘বিনীত আত্মসমর্পণ’ যদিও আনুগত্যপ্রকাশ, তবে এটা দ্বাদশ জাতীয় সংসদকে অকার্যকরের একটা পথ বলে মনে হচ্ছে। এই সংসদে কোন বিরোধী দল নেই, এটাই এখন প্রমাণিত।

সংসদের আওয়ামী লীগের যেকোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই। সংসদের বাইরেও কেউ নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনের অন্যতম বৃহৎ শক্তি বিএনপি নেতৃত্ব সংকটের কারণে নাজুক অবস্থায়। নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমে মাঠ থেকে হাওয়া হয়ে গেছে তারা। দলটির কেন্দ্র থেকে প্রান্তের সকল পর্যায়ের নেতারা এতদিন ছিলেন ‘আত্মগোপনে’। এখন যদিও বাইরে বেরিয়ে আসছেন ক্রমে, তার আগেই আন্দোলন শেষ। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিন মিলছে না। অপরাপর কেন্দ্রীয় নেতাদেরও একই অবস্থা। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর, দেশ-বিদেশে অভিনন্দনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিক্ত হয়ে চলার প্রেক্ষাপটে বিএনপির সকল স্তরের নেতাকর্মীর মাঝে নেমে এসেছে হতাশা। তার ওপর নির্বাচনের পর মাত্র দুই দিন কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি দেওয়া হলেও সে কর্মসূচি আগের মতোই ব্যর্থ হয়েছে।

আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে নামেনি বিএনপি। তারা স্রেফ দলের নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের দমননীতিতে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে বসে আছে। নির্বাচনের আগে থেকে সরকার কঠোরভাবে বিরোধী দলের বিশেষ করে বিএনপির ওপর দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছে এটা যেমন সত্য, তেমনি এ-ও সত্য যে এই দমননীতি উপেক্ষা করে মাঠের রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারেনি বিএনপি। জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া সকলেই বিরোধী দলের প্রতি কঠোর ছিলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনীতিবিদদের প্রতি কঠোর দমননীতি অনুসরণ করেছে, তবু বিরোধী দলগুলো নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছে, মাঠে প্রতিরোধ করেছে, আন্দোলনে সফল হয়েছে। কিন্তু বিএনপির ক্ষেত্রে এটা আমরা দেখিনি। বরং বিএনপিকে দমননীতির বিপক্ষে প্রেস রিলিজ আর সংবাদ সম্মেলন ছাড়া মাঠে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। নিকট অতীত কিংবা বর্তমানও এর ব্যতিক্রম নয়।

গত কয়েক মাসের আন্দোলনের বিপরীতে একপ্রকার গণগ্রেপ্তারের পথে গেছে সরকার। আক্রান্ত হয়েছে বিএনপির সকল স্তরের নেতাকর্মীরা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, আমানউল্লাহ আমান, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানীসহ অনেক নেতাই কারাগারে। তাদের জামিন মিলছে না। একের পর এক মামলা দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। নানা অভিযোগ দেওয়া এই মামলাগুলো থেকে জামিনও পাচ্ছেন না তারা। জামিনের ক্ষেত্রে যদিও সরকারের পক্ষ থেকে আইনি বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়, তবে খোদ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সদ্য-সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, তারা নাকি এক রাতের মধ্যে সবাইকে জামিন দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের সেই সে ইঙ্গিত বলছে সবকিছু রীতিনীতি অনুসরণ করে হচ্ছে না। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে জামিন, নয়ত কারাগার—আব্দুর রাজ্জাকের সেই ইঙ্গিত ও বক্তব্য প্রমাণ করে সবকিছু স্বাভাবিক ছিল না, এবং এখনো যে আছে সে লক্ষণও নেই।

বিএনপির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোরনীতি দেশে-বিদেশে আলোচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এর বিরুদ্ধে কথা বলেছে। নির্বাচনের পর আগের মতো গণগ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে না। গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে থাকা বিএনপি নেতারা ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের রোজকার সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়, এবং প্রতিদিনই বাংলাদেশে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর দমননীতি নিয়ে কথা ওঠে, তবে দেশে এনিয়ে সরকারের বিব্রত হওয়া চোখে পড়ছে না। নির্বাচনের আগে এনিয়ে সরকারের মন্ত্রীরা কথা বলতেন, কিন্তু এখন ঝাঁঝাল ভাষায় তেমন একটা বলেন না। তাদের কাছে এটা রুটিন-বক্তব্য হিসেবেই প্রতিপন্ন হচ্ছে।

সরকার পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ ও হরতালের ডাক দেয় বিএনপি। টানা সেই কর্মসূচি চলে তিনশ দিনের মতো, এরপর আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত কিংবা প্রত্যাহার না করেই বিএনপি পরের নির্বাচনে অংশ নেয়। এবারও সেই একই ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর ২৯ অক্টোবর থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদ দিয়ে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিতে শুরু করে বিএনপি। এরপর ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের দিন হরতাল দিয়ে এরপর আর হরতাল-অবরোধের পথে যায়নি। এবারও বিএনপির পক্ষ থেকে আন্দোলনের কর্মসূচি থেকে সরে আসার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। এবারের আন্দোলনও তাদের ২০১৫ সালের অনুরূপ হয়ে গেছে। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর নেতারা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গেছেন, খালেদা জিয়া সাড়ে ৫ মাস হাসপাতালে কাটানোর পর ঘরে ফিরেছেন, দলের নেতারা ফিরতে শুরু করেছেন ঘরে।

শীত মূলত আন্দোলন মৌসুম। আন্দোলন শুরুর সময় থেকে এখনো চলছে সেই শীত। তবে এবার পৌষের শেষ থেকে বিএনপির আন্দোলন কার্যত ‘শীতনিদ্রায়’!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *