বাংলাদেশের সঙ্গে নয়, আরাকানে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ চলছে: কাদের
ডেস্ক রিপোর্ট: রাখাইনে চলমান সংঘর্ষে একমাত্র ভাই মারা গেছে জুবাইদা নামের এক রোহিঙ্গা নারীর। সেখানে আছে তার আরও ৬ বোন। মোবাইল ফোনে তাই বারবার খবর জানার চেষ্টা করছিলেন টেকনাফের জাদিমুরা ক্যাম্পে বাস করা জুবাইদা।
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন জুবাইদা। এখন ফেলে আসা স্বজনদের নিয়ে নতুন উৎকণ্ঠা তাদের। জুবাইদার সঙ্গে কথা হয় বার্তা২৪.কম-র এই প্রতিবেদকের।
জুবাইদা বলেন, সোমবার (২৯ জানুয়ারি) আমার ভাই মারা গেছিল, মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) ওরা পুরো পাড়া জ্বালিয়ে দেয়। দেড়শো জনের মতো মানুষ হতাহত হয়েছে, বাকিরা বিভিন্ন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। এমন শীতের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া করতে পারছে কিনা জানি না। এসবও শুনেছি বিদেশ থেকে, দেশের কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।
স্বজনদের খবর না পাওয়ার পাশাপাশি নিজ ভূমিতে ফেরা নিয়েও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে রোহিঙ্গাদের মাঝে।
রোহিঙ্গাদের আরেকজন মো. আয়াছ বলেন, এখন যেভাবে মিয়ানমারে ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে আমরা সেরকম ঝগড়াঝাঁটি চাই না। যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, যদি শান্তি থাকে, তাহলে আমরা ফিরে যেতে রাজি আছি। এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমরা কীভাবে নিজভূমিতে ফিরব। আমরা এখন খুব ভয়ে আছি। এই অবস্থায় সেখানে ফেরা তো সম্ভব নয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, বিদ্রোহী ও জান্তাবাহিনীর সংঘর্ষের জেরে গত অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৫৫৪ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গেল শুক্রবার সেখানে ২৩ রোহিঙ্গা নিহতের দাবিও করেছে সংস্থাটি। এছাড়াও বাস্তুচ্যুত হয়েছে অসংখ্য বেসামরিক মানুষ।
শরণার্থী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল হতে যাচ্ছে। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, মিয়ানমারের কোনো পক্ষ রোহিঙ্গাদের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি।
শরণার্থী বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. রাহমান নাসির উদ্দীন বলেন, মিয়ানমারে এখন যেটা সামরিক যুদ্ধ চলছে সেটা সেখানে বসবাসকারীদের মধ্যে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। একইসাথে যদি সেখানে নতুন কোন গণতান্ত্রিক সরকার আসে তাহলে রাতারাতি রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবে এরকম কোন সম্ভাবনা আমি দেখি না। আরাকান সিভিল সোসাইটির সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের আরাকানের বা রাখাইনের অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। যদিও আশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে আরাকান আর্মি এবং ন্যাশনাল ইউনিটি গভমেন্ট রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলে সনাক্ত করছে, রোহিঙ্গা বলে ডাকছে, রোহিঙ্গা শব্দটা ব্যবহার করছে। তারপরও যদি সামরিক জান্তার পতন হয়ে গণতান্ত্রিক সরকার আসে তাহলে প্রায় ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা রাতারাতি মিয়ানমারে চলে যাবে সেটা আমি মনে করি না।
রাহমান নাসির মনে করেন, ভবিষ্যৎ আরও কঠিন হতে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের। যদি আরাকান আর্মির হাতে রাখাইন রাজ্যের দখল অব্যাহত থাকে, তবে রোহিঙ্গারা তাদের নিজ ভূমি ফেরত পাবে কিনা তাতেও সন্দেহ রয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান সংঘর্ষ এ অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে জটিল করার পাশাপাশি দীর্ঘসূত্রতায় ফেলতে যাচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকেও।
এদিকে, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা পূর্বশর্ত হওয়ায় প্রত্যাবাসনে ব্যাঘাত ঘটার আশংকা করেছে শরণার্থী কমিশন। উল্টো আশঙ্কা তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের। তবে সীমান্ত এলাকায় কঠোরতার কারণে এখন পর্যন্ত নতুন করে ঢুকতে পারেনি কোনো রোহিঙ্গা।
রাখাইন রাজ্যের এ সংঘর্ষ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চরমভাবে ব্যাহত করেছে বলে দাবি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের। তিনি বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সংঘাতের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আবারও ব্যাঘাত ঘটেছে। ক্যাম্পগুলোতে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। কোন রোহিঙ্গা যাতে মিয়ানমারে অবস্থানরত স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এপারে আসার বিষয়ে অনুপ্রাণিত না হয়। এই অবস্থায় কোন রোহিঙ্গাকে আমরা আর নিতে পারব না।
অন্যদিকে, সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে শক্ত অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। স্থলসীমায় বিজিবির পাশাপাশি জলসীমায় কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে কোস্টগার্ড।
মিয়ানমারের চলমান অস্থিরতায় রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাচ্ছে? সে প্রশ্নটি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আরাকান আর্মির সাথে জান্তা বাহিনীর চলমান সংঘর্ষের কারণে এগিয়ে থাকা প্রত্যাবাসন ইস্যুটিও পিছিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই।
সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।