সারাদেশ

ভারতের আসন্ন নির্বাচন: জোট নিয়ে জট পাকছে, খুলছে কই?

ডেস্ক রিপোর্ট: গুরুত্বপূর্ণ সব সীমান্ত দখলে মরিয়া বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠীর সামনে দাঁড়াতেই পারছে না ক্ষমতাসীন জান্তা প্রশাসন। মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের উত্থান আর জান্তাদের এই ধরাশায়ী রূপ গত বছরের ডিসেম্বর থেকেই বিশ্বনজরে রয়েছে। চলমান এসব সংঘাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশনস (ইএও) ও থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স (টিবিএ)।

উল্লেখ্য থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স হলো তিনটি বিদ্রোহী সংগঠনের একটি জোট। এতে যুক্ত আরাকান আর্মি, এমএনডিএএ এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)। সম্মিলিতভাবে এসব শক্তি মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছে। 

অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় প্রতিটি মানদণ্ডে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ এবং নিকৃষ্ট শাসকগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে জান্তা সরকার। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে কমপক্ষে ৪ হাজার ৪৭৪ জন বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন; গ্রেফতার করা হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে। এছাড়াও জান্তা সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের সময় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ৭৮ হাজারেরও বেশি বাড়িঘর।

সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গভীর সংকটে ডুবন্ত মিয়ানমার মূল বৈশ্বিক সূচকগুলোতে নিকৃষ্ট এক রাষ্ট্রের উদাহরণ। গত তিন বছরে যেসব ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেশটিতে তৈরি হয়েছে তাতে চরম বিপর্যয়ে রয়েছে দেশটির মানবাধিকার এবং উন্নয়ন।

অনলাইন স্টেটসম্যানে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, চীন সীমান্তের কাছে কোকাং শাসিত জোনের রাজধানী লাউক্কাইং শহরের দখল নিয়েছে ইএও। মিয়ানমারের মানবপাচার ও অবৈধ বাণিজ্যিক পণ্য প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে এই শহর। তাই এ শহর বিদ্রোহীরা দখলে নেওয়ার পর এসব বিষয়ে উদ্বিগ্ন চীন তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হতে পারে ভেবে অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স (টিবিএ)। তাদের কৌশলগত সংঘাতনীতি সেনাবাহিনীদের ভিত নেড়ে দিয়েছে। ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে বিদ্রোহীদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে প্রায় ২০০ আউটপোস্ট হারিয়েছে জান্তারা। 

দেশটির স্থানীয়  সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতির প্রতিবেদনে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির পাঁচটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। জান্তা প্রশাসন কীভাবে দেশ থেকে কারাগারে রূপ দিয়েছে মিয়ানমারকে সেটিই ব্যাখ্যা করেছে প্রতিবেদনটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে তীব্র মানবিক সংকট, বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার হটস্পট, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সবচেয়ে বিপজ্জনক, সবচেয়ে বড় কারাগার, সাংবাদিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন নিকৃষ্ট ক্যাটাগরিতে এগিয়ে রয়েছে মিয়ানমার।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে প্রায় ১ কোটি ৮৬ লাখ নাগরিক বা দেশটির মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ জরুরি মানবিক সহায়তার আওতায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিন বছর আগের সেনা অভ্যুত্থানের আগে এমন চাহিদার আওতায় ছিল মাত্র ১০ লাখ মানুষ। ২০২১ সালের এই সামরিক অভ্যুত্থান দেশটিতে  নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে মানবাধিকার সংকট।

তীব্র মানবিক সংকটের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ‘ক্ষুধার হটস্পট’- এও রূপ নিয়েছে মিয়ানমার। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি মিয়ানমারকে শীর্ষে রেখে বিশ্বব্যাপী ‘ক্ষুধার হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ। দেশটির মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ বাসিন্দা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আওতায় পড়ে আছে বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম-এর তথ্য অনুযায়ীও দেশটিতে তীব্রভাবে বেড়ে গেছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মধ্যে ডুবে গেছে মিয়ানমার। প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ বা প্রতি চারজনে একজন ভয়াবহ খাদ্য সংকটের শিকার। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে মিয়ানমার।

অন্যদিকে এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হিসেবেও সমালোচিত হচ্ছে মিয়ানমার। গ্লোবাল পিস ইনডেক্স বা বিশ্ব শান্তি সূচক-২০২৩ অনুসারে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর মধ্যে ১৮তম স্থানে রয়েছে মিয়ানমার। এই অঞ্চলের একমাত্র দেশ উত্তর কোরিয়া মিয়ানমারের পরের অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে, অভ্যুত্থানের পর থেকেই স্বাধীন গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের বর্বরোচিতভাবে টার্গেট করেছে সামরিক প্রশাসন। চীনের পরেই সাংবাদিকদের কারাগারে পাঠানো দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মিয়ানমার। কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে অন্তত ৪৩ জন সংবাদকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে দেশটিতে। অন্যদিকে চীনে কারাভ্যন্তরে পাঠানো হয়েছিল ৪৪ জন সংবাদকর্মীকে। এখানেও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মিয়ানমার।

অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারস-এর তথ্য (এএপিপি) অনুসারে, ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মিয়ানমারে মোট ১৯ হাজার ৯৯৩ জন রাজনৈতিক বন্দি কারাগারে ছিল, যার মধ্যে তিন হাজার ৭৮০ জনই নারী। এমনকি আগের শাসনামলেও এই সংখ্যা কখনও তিন-চার হাজার ছাড়ায়নি। এই পরিসংখ্যান সামনে আসলে বিশ্বের সবচেয়ে ‘খারাপ কারাগার’ হিসেবে স্বীকৃতি পায় মিয়ানমার শাসকগোষ্ঠী। যারা ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের দাবিতে প্রতিবাদ করেছেন বা লড়াই করেছেন তাদের কারাবন্দি করা হয়েছে। অন সাং সু চির পাশাপাশি নির্বাচিত অনেক নেতা, তরুণ ছাত্র এবং বিভিন্ন পেশার সদস্য রয়েছেন কারাগারে। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে রেখেছে সামরিক পোশাক পরা অপরাধীরা যারা যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যায় জড়িত। 

প্রসঙ্গত, সামরিক জান্তা বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে এই চলমান যুদ্ধে সীমান্ত অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ, চীন ও ভারত সীমান্তে বসবাসকারী লোকজন বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যেও প্রভাব পড়েছে দেশটির। এমন সংঘাত পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তাও ইতিমধ্যে অনুমেয় সবার কাছে। বসবাসের অনুপযোগী এই ভূখণ্ড থেকে প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। রোহিঙ্গা ভাড়ে বাংলাদেশ এখন এতোটাই ধরাশায়ী যে আর ধারণ ক্ষমতা নেই বাংলাদেশেরও। বিশ্বব্যাপী অভিবাসন সংকটকে আরও তীব্র করে তুলতে ইন্দোনেশিয়া বা ইউরোপিয়ান অঞ্চলেও প্রভাব ফেলছে এই মিয়ানমার সংকট।

উল্লেখ্য, সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে মিয়ানমারে। ২০২১ সালে সম্পাদিত হয় ন্যাশনওয়াইড সিজফায়ার এগ্রিমেন্ট (এসসিএ)। কিন্তু এই এগ্রিমেন্ট ভেঙে ফেলে জান্তাদের উপর আক্রমণ চালায় কুকি ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি, কুকি ন্যাশনাল আর্মি এবং চিন ল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স। এতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অনেক সেনা নভেম্বরে ভারতে পালিয়ে গিয়ে শরণার্থী হয়। মিজোরামে চলে গিয়েছেন প্রায় ৬০০ সেনা সদস্য। তাদেরকে সফলতার সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে মিয়ানমার পুলিশের কিছু সদস্য ভারতে আশ্রয় প্রার্থনা করে। সংঘাতের এই পর্যায়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষে টিকতে না পেরে প্রাণ বাঁচাতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বিজিবি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ১৪ সদস্য। পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত বরাবর রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত লড়াইয়ে আরাকান আর্মির দাপটে অনেকটাই নির্জীব জান্তা বাহিনী। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে চিন ও রাখাইন রাজ্যের বিপুল এলাকা ইতিমধ্যেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।  

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে জান্তা বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে চীন। এসব যুদ্ধবিরতিকে নাকোচ করে দিয়ে দেশের স্বৈরাচারকে উৎখাতে বদ্ধপরিকর বিদ্রোহীদের অ্যালায়েন্স গোষ্ঠী। তারা যুদ্ধবিরতি মানতে নারাজ। ফলে এ বছর জানুয়ারিতে আরেকটি যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করতে বাধ্য হয় চীন। তবে কোনো চুক্তিই বিদ্রোহীদের ক্রমাগত এসব আক্রমণ থামাতে কার্যকর হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন জান্তা বাহিনীর নানাবিধ সহিংস কার্যকলাপে একটি অস্থিতিশীল রাজনীতি এবং অর্থনীতির দেশে রূপ নিয়েছে মিয়ানমার। চরম মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস যেন পিছুই ছাড়ছেনা দেশটির। মানবাধিকারের এমন চরম সংকট সৃষ্টির জন্য জান্তা প্রশাসনের শাসননীতির ব্যর্থতাই বেশি দায়ী। সেনাবাহিনীদের জাতিগত বিনাশের অপচেষ্টা মিয়ানমারের জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ হয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। 

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *