বিনোদন

মাঝ পথে নিভে যাওয়া নক্ষত্র আহমেদ রুবেল

ডেস্ক রিপোর্টঃ বাল্যবন্ধু জনপ্রিয় অভিনেতা আহমেদ রুবেল হঠাৎ পরপারে পাড়ি জমালেন। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! কয়েকদিন আগেও তাকে দেখে মনে হয়নি এভাবে চলে যাবে আগাম বার্তা না দিয়ে। জানতাম, সে শরীরের প্রতি খুব অবিচার ও অযত্ন করে। তার নিজের প্রতি এই অবিচারের বিষয়টি সবসময় পীড়া দিতো। রুবেল আমাদের খুব ঘনিষ্ট বন্ধুদের একজন। সবসময় তাঁর মঙ্গল চাইতাম। গুণীমানুষ হিসেবে সফল হোক তাই চাইতাম। চাইতাম সে আরও ভালো ভালো কাজ উপহার দিবে। কিন্তু সেটা হলো না। যদিও কিছুদিন হলো, সে নিজের প্রতি যত্নবান হয়ে উঠছিল, তাঁর ভাঙ্গা চেহারায় যৌবনের লাবণ্য ফিরতে শুরু করেছিল। অর এই সময়ে সে চলে যাবে ভাবিনি কখনও।

আহমেদ রুবেল কেবল বাল্যবন্ধু নয়, অন্তারাত্মা বললেও ভুল বলা হবে না। একসাথে থিয়েটার করেছি, সাংগঠনিক কার্যক্রম করেছি। বহু স্মৃতি তাঁকে নিয়ে। গাজীপুরে আমরা পরস্পর কোয়ার্টার কিলোমিটার দুরত্বে বসবাস করেছি ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে। একই প্রাইমারি এবং হাই স্কুলে পড়ালেখা করেছি। যদিও সে আমার একবছর পরে এসএসসি পাশ করেছে। তবুও সহপাঠীদের থেকেও বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে ছিল ভীষণ আড্ডাবাজ এবং বন্ধুবৎসল। তাঁর জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর আর গল্প বলা ছিল আকর্ষণীয়। বিভিন্ন চরিত্র অভিনয় করে করে উপস্থাপন করায় মুন্সিয়ানা ছিল। যা তাঁর অভিনয় প্রতিভার পূর্বাভাস ছিলো। বিশেষ করে সে যখন ৮ম ও আমি ৯ম শ্রেণিতে তখন টিফিনের সময়ে ডালপুরি খেতে খেতে ধুমিয়ে আড্ডা দেওয়া ছিল আমাদের রোজকার ঘটনা। সেখানে সে কাড়াকাড়ি করে দু’একজনের ভাগের পুরি খেয়ে ফেলতো। এবং বেশ বিশ্বাসযোগ্য গল্প দিয়ে সে দায় অন্য কারো উপর চাপিয়ে দিতো। আবার এভাবে কাউকে বোকা বানানো নিয়ে খুব হাসাহাসি গল্পগুজব হতো। যাকে বোকা বানানো হতো তার চেহারা দেখতে কেমন হয়েছিল, সে তখন কি রকম করেছিল-তাও হাস্যরসাত্মকভাবে উপস্থাপন করতো রুবেল। এই আমাদের বাল্যবন্ধু আহমেদ রুবেল। যাকে আমরা রুবেল বলে ডাকি এবং চিনি। স্কুল-কলেজের কাগজপত্রে তাঁর নাম আহমেদ রেজা রুবেল। অভিনয় জগতের “আহমেদ রুবেল”। ১৯৬৮ সালের ৩ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রাজারামপুর গ্রামে তার জন্ম। মঞ্চনাটক দিয়েই তার উঠে আসা। নন্দিত নাট্যকার সেলিম আল দীনের ‘ঢাকা থিয়েটার’-এ কাজের মাধ্যমেই তার উত্থান গল্পের শুরু।

আহমেদ রুবেল এর পিতা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আয়েশ উদ্দিন জেলা শিল্পকলা একাডেমি, গাজীপুর এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘসময় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর পিতা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এখন বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাশায়ী। তাঁর বড়ভাই ডা. খালেদ শামসুল ইসলাম ডলার ভাই জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র-ভদ্র  ও মিশুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ছোট বড় সকলের আস্থা ও ভালোবাসার পাত্র ছিলেন, তাই তাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয় । দুঃখের বিষয় তিনি মর্মান্তিক এক দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। সম্ভবত সেটা একযুগেরও আগের ঘটনা। নব্বইয়ের দশকে অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর কিংবা অন্যান্য তারকা শিল্পী, সাহিত্যক, কবিদের সাথে তাঁর সখ্যতা ও সুসম্পর্ক স্বচক্ষে দেখেছি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নানা অনুষ্ঠানে তারকা ব্যক্তিদের তিনি অতিথি হিসেবে নিয়ে আসতেন। অতিথিরা তাদের বক্তৃতায় ডলার ভাইয়ের নানা গুণ তুলে ধরে প্রসংশা করতেন। তাঁর সহোদর আহমেদ রুবেল পারিবারিকভাবেই সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠে। অভিনয়ের প্রতি তাঁর এতো মোহ সেটা স্কুল জীবনের রুবেলকে দেখে টের পাওয়া যেতো না।জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় আমি নিয়মিত অংশ নিতাম। বেশির ভাগ সময় অভিনয়ে জেলা পর্যয়ে প্রথম হতাম। কিন্তু রুবেলকে সেখানে অংশ নিতে দেখি নাই কখনো।

আমরা গাজীপুরের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাওয়াল রাজমাতা প্রতিষ্ঠিত রাণী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ‘সেরা’ ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থী ছিলাম। মেধাবী কিন্তু দুষ্টুমিতে সেরা ছিলাম আমরা। এই আড্ডাবাজ বন্ধুদের দলে রুবেলও একজন। পড়ালেখা ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখা খুব প্রিয় কাজ তখন আমাদের। রাণী বিলাসমনি স্কুল ঘেঁষে রাজবাড়ী সড়কের অপরপাশেই নারায়ণ দা’র দোকান। সেই দোকানের পুরি-সিঙ্গাড়ার দুর্নিবার হাতছানি আমাদের আড্ডায় টানতো। টিফিনের বিরতিতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রুবেল, আমরা  কয়েকজন নতুন ছবি মুক্তি পেলেই সিনেমা হলে ছুটতাম। তখন আমরা স্কুলে নিয়ে আসা বইখাতা নারায়ণ দা’র দোকানে লুকিয়ে রেখে সিনেমা হলে যেতাম।

গ্রীষ্মকালে দিন অনেক বড়। বিকেল ৩টা থেকে ৬টা ম্যাটেনি শো দেখতাম। ছবি শেষে হল থেকে বের হয়ে দেখতাম সূর্য মধ্যগগণ থেকে কেবল পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। মাঝে মাঝেই আমরা ধরা পড়ে যেতাম। বাংলা ও ইংরেজির চলমান ডিকশনারি আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক নূরুল ইসলাম (ভাওয়ালরত্ন)।  স্যারের গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকতাম আমরা। সিনেমা দেখে ফিরে এসে দোকানে বইখাতা নিতে গিয়ে দেখি সব হাওয়া। চেয়ে দেখি, নারায়ণ দা’র মুখ মেঘে অন্ধকার। কী ব্যাপার? কী হলো? আমাদের বইখাতা গেলো কোথায়?

জানা গেলো, নূরু স্যার টিফিন পলাতক বাঁদর ছাত্রদের খোঁজে এসেছিলেন। দোকানে তল্লাশি চালিয়েছেন। বাঁদরগুলোর টিকিটির নাগাল না পেয়ে বইখাতাগুলো আটক করেছেন। আমরা না হয় স্যারের হাতে জোড়া বেতের কিছু ধোলাই খেয়ে হজম করলেই বেঁচে যাবো। কিন্তু বাপু রুবেল এর হবে টা কী? নূরু স্যার আর রুবেলের বাবার দহরমমহরম দোস্তালী। ‘সুপুত্র’ রুবেলের টিফিন পিরিয়ডে ফাঁকি আর বইখাতা দোকানে রেখে লাপাত্তা হওয়ার খবর বাবার কানে গেলে হবেটা কী? রুবেলের মুখে ভয়ংকর ভয় ও দুশ্চিন্তার  চিন্তার ছাপ। যা আমাদের নিজের টেনশন ভুলিয়ে দিত। রুবেলের বাবা আয়েশ স্যার কঠিন রাগী মানুষ। রুবেল এর কি দণ্ড দেবেন কে জানে!

নাটক ‘একাত্তরের পালা’। সামনের সারিতে বাম থেকে ডানে লাল শার্ট পড়া তৃতীয় ব্যক্তি আহমেদ রুবেল। পেছনে সর্বচূড়ায় মাঝের ব্যক্তির ডানপাশে কালো গাউন পরিহিত লেখক

এরপর কয়েকদিন আর রুবেলের দেখা নেই। জানিনা কি হলো। কয়েকদিন পর হঠাৎ আবার সব আগের মতো। আবার সেই আড্ডা, সেই ফাঁকিবাজি। রুবেলের মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই কি ঝড় বয়ে গেছে। সে ঐ প্রসঙ্গের ধারেকাছেও যায় না। আমরা আগের মতোই পুরি সিঙ্গাড়ার টানে আড্ডা জমাই। স্কুল পড়া ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখি।  এরকম নানা গল্পগাথা আহমেদ রুবেল এর স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে। এমন অনেক ঘটনা আছে যা খুব স্মরণীয় কিন্তু এখানে বর্ণনীয় নয়। না না, আর যা হোক রুবেলকে কখনও প্রেমে পড়ার গল্প করতে শুনিনি। সম্ভবত ও বাবার ভয়ে স্কুল জীবনে প্রেম করার কথা ভাবতেও চায়নি। সেই রুবেল যখন আহমেদ রুবেল হয়ে গেলো আর আমাদের হার্টথ্রুব অভিনেত্রী তারানা হালিমের সঙ্গে ঘর বাঁধলো অবাক না হয়ে পারিনি। এটা যে প্রেমঘটিত ভালো লাগালাগির ঘটনা তা তো বোঝা যায়।

রুবেল এর অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৮৩ সালের দিকে। আমরা গাজীপুরের একঝাঁক তরুণ সমকাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করি। রুবেল এবং আমরা ২৫/৩০ জন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।  প্রথমে প্রখ্যাত নাট্যকার মামুনুর রশীদের ‘এখানে নোঙর’ মঞ্চনাটকে একসাথে কাজ করি। এরপর বেশ কিছু পথনাটকে। যেমন: সেলিম আলদীনের ‘বাসন’, মান্নান হীরার ‘ফেরারী নিশান’ আব্দুর রাজ্জাকের ‘সবার উপর মানুষ সত্য’ সহ স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘চোর’ নাটকে অভিনয় করেছি। বিশেষ করে এস এম সোলায়মান এর ‘এই দেশে এই বেশে’ নাটকটি করেছি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হবার ভয় উপেক্ষা করে।

ক্ষমতাসীন এরশাদের সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে নানা বিষয় নিয়ে রচিত এই সাহসী মঞ্চনাটকটি খুবই জনপ্রিয়তা পায়। ঢাকায় প্রতিটা শো হাউজ ফুল হতো। গাজীপুরে মাত্র দশ টাকার টিকিট শেষ হয়ে গেলে সেটাই দুইশত পাঁচশত টাকায় কেনার প্রতিযোগিতা দেখা গেলো শো এর দিন। শেষে মানুষ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর ড. বদরুদ্দোজা অডিটোরিয়ামের কলাপসিবল গেইটের তালা ভেঙে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।অডিটোরিয়াম লোকেলোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নাই। দাঁড়িয়ে, ফ্লোরে বসে অসংখ্য দর্শক সে নাটক উপভোগ করেছে।

আহমেদ রুবেল এ নাটকে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছে। মেকআপ গেটআপের পর তাকে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর না বলে উপায় ছিলো না। উঁচু-লম্বা সুঠামদেহী আহমেদ রুবেলের বড় বড় টানাটানা চোখ, খাড়া নাক আর ঈষৎ কুঁকড়ানো ব্যাকব্রাশ চুল রবি ঠাকুরের চরিত্রকে জীবন্ত হাজির করেছিল সেদিন । রুবেলের রাশভারি কন্ঠের সংলাপে গমগম করছিলো সারা হল। আমি এ নাটকে এরশাদের মন্ত্রী পরিষদের তথ্যমন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করি।  বাসন নাটকে প্রথমে আমি খলচরিত্র চেয়ারম্যান এর অভিনয় করি। দ্বিতীয় শো এর সময় চেয়ারম্যান চরিত্রে ছিলেন আহমেদ রুবেল। আমি নায়িকার বাপ। চোর নাটকে আহমেদ রুবেল অভিনয় করেনি৷ সে সময় সে ঢাকা থিয়েটারে ব্যস্ত। দুইটি শো হওয়ার পর লম্বা বিরতি দিয়ে তৃতীয় শো হওয়া নিয়ে খুব মজার ঘটনা আছে তাকে নিয়ে। সেই শো ছিলো গাজীপুরের কালিয়াকৈরে। হঠাৎ ডাক পড়েছে। কোন মহড়া ছাড়াই শো করতে হবে। মুখস্ত সংলাপ কেউ কেউ ভুলে গেছে। এ সময়ে কেউ পেছন থেকে স্ক্রিপ্ট পড়ে না। সংলাপ পুরোপুরি মুখস্ত মানে রপ্ত করে মঞ্চে উঠতে হতো। কিন্তু উপায় নাই দেখে পেছন থেকে স্ক্রিপ্ট পড়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় আহমেদ রুবেলকে। তো চোর নাটকের দুটো স্থানে একই রকম সংলাপ আছে। রুবেল এর এ নাটকের সংলাপ ভালো রপ্ত নেই। সে তো ঢাকায় ব্যস্ত। এখন এসেছে আমাদের দায়মুক্ত করতে। তা বেশ ভালোই হচ্ছিল আমরা ৪ চোরের অভিনয়। ভুল হলে,  সংলাপ আটকে গেলে রুবেল ধরিয়ে দেয়ন পর্দার আড়াল থেকে ।

তবে একইরকম সংলাপ একবার হয়ে গেলো। নাটক প্রায় অর্ধেকটা শেষে বাধলো গোল। যেই একইরকম সংলাপ ফের এলো কোআর্টিস্ট আমি তো কিউ ধরে আবার সেই পেছনের সংলাপ দিয়ে ফেললাম।  হায় সর্বনাশ!  কেউ আর সেটা ম্যনেজ করতে পারছি না। নাটক আবার পেছন থেকে শুরু হলো। একটু আগের দৃশ্য আবার দেখে দর্শক কেমন সন্দেহের চোখে তাকাতে লাগলো। ওদিকে রুবেল তো মহাসমুদ্রে। সে তো আর সংলাপ মেলাতে পারে না স্ক্রিপ্ট দেখে। একবার পাতা উল্টে সামনে একবার পেছনে করতে করতে হয়রান-পেরেশান। শেষমেষ কোনও একভাবে আমরা নানা ইমপ্রোভাইস দিয়ে সেবার উতরে যাই। কিন্তু রুবেল সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার ভাঙ্গারেকর্ড দীর্ঘদিন বারবার বাজিয়ে গেছে।

পথনাটক ‘বাসন’র দ্বিতীয় শো। পেছনে সর্ববামে মাইক্রোফোনের সামনে আহমেদ রুবেল।  সামনে বসা ডান থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি লেখক। যা আজ শুধুই স্মৃতি…

আহমেদ রুবেল এর সাথে শেষ মঞ্চ নাটক নাসির উদ্দিন  ইউসুফের ‘একাত্তরের পালা’। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক ড. রশীদ হারুন এ নাটকের নির্দেশনা দেন। আমি সহকারী নির্দেশক ছিলাম। এছাড়া বিবাদী উকিলের চরিত্র রূপায়ণ করি। ঢাকা থিয়েটার এর পরিবেশনায় চরিত্রটি মূলত করতেন সুবর্ণা মোস্তফা।  আহমেদ রুবেল এ নাটকে একজন রাজনীতিকের চরিত্রে অভিনয় করেন।  আরও অভিনয় করেন আহমেদ রুবেল এবং আমার অন্যান্য বন্ধু সহপাঠী ও সহকর্মীরা। তাঁদের মধ্যে ইনাম সারোয়ার বেণু, জাহিদ হোসেন সোহেল, মিজানুর রহমান মজনু, সৈয়দ হাসান জুন্নুরাইন সোহেল ছিলেন উল্লখযোগ্য চরিত্রে। সেটা  ১৯৯১ সালের কথা।

এরপর আহমেদ রুবেল এর সাথে কম দেখা হতো। সে ঢাকায় আমি গাজীপুরে যার যার মতো ব্যাস্ত। ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বেইলি রোডে মহিলা সমিতির চত্বরে কখনও কখনও দেখা হলে কুশল বিনিময় হতো। এসময়টায় আহমেদ রুবেল অভিনয় অঙ্গনে পরিচিত হয়ে উঠছেন। এরই মধ্যে ২০০১ সালের কোন একরাতে রাজধানী ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় দেখা। দৈনিক ভোরের কাগজে কাজ করি তখন আমি। এ বছরই বিটিভিতে নাট্যশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। কিন্তু সাংবাদিকতার পেশায় এসে ওখানে আর কাজ করা হয়নি। আহমেদ রুবেল সে সময়ের উঠতি তারকা। সেদিন আমাকে রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক সুপ্রিয় বন্ধুজন ভোরের কাগজের সঞ্জীব চৌধুরী। দলছুটের ‘গাড়ী চলে না চলে না চলে না রে’ খ্যাত জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী প্রয়াত সঞ্জীব দা’র কথাই বলছি। আহমেদ রুবেল সঞ্জীব দা’কে দেখে উৎফুল্ল হয়ে আমাদের টেবিলে ছুটে এলো। পরে আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি এখানে?’ সঞ্জীব দা বললেন,  ও আমার সহকর্মী।  এরপর মনে হয় আহমেদ রুবেল একটু আনমনা হয়ে গেলো। আমার মনে হলো, সে ঠিক হিসাব মেলাতে পারছিল না কিভাবে আমি মফস্বল থেকে হঠাৎ সঞ্জীব চৌধুরীর মতো একজন সাংবাদিকের এতো কাছের মানুষ হয়ে গেলাম।

আহমেদ রুবেল সবসময়ই আমাদের থেকে একদশক এগিয়ে ছিলেন। বহু চড়াই উতরাই পেরিয়েই সে অভিনয় শিল্পী হিসেবে আলাদা পরিচয় তৈরি করতে পেরেছিল। অভিজ্ঞতা বলে, তার চেয়েও বেশি প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় আরও ৪/৫ জন অভিনয় প্রতিভা সমকাল থিয়েটারে ছিল।  কিন্তু তাঁরা ঢাকায় গিয়ে প্রতিষ্ঠিত অভিনয় শিল্পী হবার প্রতিযোগিতায় যায়নি। গাজীপুরে ছোট্ট গন্ডির মধ্যে ছোট্ট পরিসরে আটকে আছে। অগ্রসর চিন্তার মানুষ আহমেদ রুবেল এই গন্ডির সীমানা  পেরিয়ে এপার বাংলা ছাড়িয়ে ওপার বাংলার ছবিতে শাবানা আজমীরের মতো প্রখ্যাত অভিনেত্রীর সাথে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।

এই আহমেদ রুবেল বাংলা ছবির চরম দুর্দিনে হুমায়ূন ফরিদির অভিনয় দেখে নিজেকে বাংলা ছবির তারকা গড়ার স্বপ্ন দেখতো। সে স্বপ্নের কথা মাঝে মাঝেই আমাদের কাছে নানাভাবে প্রকাশ করতো।  আহমেদ রুবেল এর সীমাবদ্ধতা ছিলো সে নিজেকে তেমন ভাঙচুর করতে পারতো না। হুমায়ূন ফরিদি এই কাজটিতে সবচেয়ে পারঙ্গম ছিলেন। সে বিবেচনায় আহমেদ রুবেল দিনে দিনে জাত শিল্পী হয়ে উঠছিলেন। তাঁর জাত শিল্পী হয়ে উঠার দীর্ঘপথ মাঝপথে এসে থমকে গেলো। তাকে দিয়ে আরো অনেক কাজ করানো যেতো। মিডিয়া কখন কাকে নিয়ে কেন আকাশে উড়বে এ প্রশ্ন গোলকধাঁধার মতো ঘুরপাক খেতে থাক। কেননা তার আগেই যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের সব আলো একেবারে নিভে গেলো। তাঁর এতো সম্ভাবনাকে আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলাম না। তিলে তিলে শেষ হতে দেখলাম। যার কোন শেষ নেই। আসলে এর শেষ দরকার।

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও নাট্যকর্মী

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪ এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *