সারাদেশ

বিকেটিটিসি’র বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণে উদ্বুদ্ধকরণ সভা

ডেস্ক রিপোর্ট: কয়েক দশকের স্থবিরতার আড়মোড়া ভেঙে বুলেট গতিতে ছুটতে শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। ইতোমধ্যেই তার সুফলও পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ।

দেশে গ্যাস সংকটের জন্য অনুসন্ধান স্থবিরতাকেই দায়ী করে আসছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। পেট্রোবাংলার ঢিলেমির কারণে অনেকেই সমালোচনায় মুখর ছিলেন। তবে সেইদিন এখন বদলে যেতে শুরু করেছে। পেট্রোবাংলার আগের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান (বর্তমান পানি সম্পদ বিভাগের সচিব) আড়মোড়া ভেঙে লাইনে তোলার প্রচেষ্টা নেন। আর লাইনে থাকা পেট্রোবাংলাকে বুলেট গতি দিতে যাচ্ছেন বর্তমান চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার। একদিকে, যেমন গতিময় হয়েছে, অন্যদিকে নতুন মাত্রাও যুক্ত হয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে।

এতদিন তেল-গ্যাস অনুসন্ধান একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে ছিল বাংলাদেশ। আরো ছোট করে বলতে গেলে সুরমা বেসিন তথা, সিলেট থেকে শুরু করে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী এবং ভোলার মধ্যে আটকে ছিল বাংলাদেশ। অন্যান্য এলাকায় কিছু অনুসন্ধান কার্যক্রম চালু হলেও তার পরিমাণ নগণ্য বলাই যায়। সেখানেও আমূল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা।

চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ৪৬ কূপ প্রকল্পের সঙ্গে আরো দুটি যুক্ত করা হয়েছে। দ্রুতগতিতেই এগিয়ে চলছে ৪৮ কূপ খনন প্রকল্প, যা ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হবে। ইতোমধ্যেই ওই কর্মসূচির সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। ১০টি কূপের মাধ্যমে দৈনিক ১৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা বেড়েছে বাংলাদেশে। দৈনিক ১০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন বৃদ্ধির আশা করা হয়েছিল। সেখানে আমরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস বেশি পেতে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, ৪৮ কূপ খনন প্রকল্পের পাশাপাশি ২০২৬-২৮ সালের মধ্যে আরো ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এ জন্য তিন শতাধিক সম্ভাবনাময় এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে ১০০টি কূপ চূড়ান্ত করা হবে। এ জন্য একটি কোর কমিটি কাজ করছে। শিগগিরই এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হবে।

জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, কূপ খননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সম্ভাবনাময় স্থান চিহ্নিত করা। আর স্থান চিহ্নিত করতে হলে ২ডি ও ৩ডি সিসমিক সার্ভে করা জরুরি। আমরা সেখানেও কাজ শুরু করেছি। এতদিন অনুসন্ধান কার্যক্রম কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। সেই প্রথা ভেঙে বাংলাদেশের পুরো ভৌগলিক এলাকা অনুসন্ধানের আওতায় আনা হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের ম্যাপ নিয়ে বসেছি। সেখানে কোনো কোনো এলাকায় আগে সিসমিক সার্ভে হয়েছে, সেখানে সবুজ চিহ্নিত করা হয়েছে, যে সব এলাকায় আগে কাজ হয়নি সেগুলো চিহ্নিত করে সিসমিক সার্ভে করা হবে। এরপর সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, কাজের ক্ষেত্রে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। সবার আগে তাদের রিগগুলো সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে, যাতে তাদের রিগগুলো কোনো সময় অলস বসে না থাকে। ধারাবাহিকভাবে রোস্টার করে দেওয়া হচ্ছে। তারপর অবশিষ্ট কূপগুলো বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে খনন করে নেওয়া হবে। তাদের ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। তারা নিয়ে বসে থাকবে, তা করার সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, স্তরগত দিক থেকেও প্রচলিত ধারা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণত ২৬০০ মিটার থেকে ৪০০০ মিটার পর্যন্ত কূপ খনন করে গ্যাস তোলা হয়। তবে ফেঞ্চুগঞ্জ-২ সহ কিছু কূপে ৪৯০০ মিটার পর্যন্ত খনন করা হয়েছে। ওই স্তরের নিচে কখনো কাজ করা হয়নি। পাবনার মোবারকপুরসহ ২টি কূপে আরো ডিপ ড্রিলিং (গভীর খনন) করার কাজ শুরু করেছি। আমরা ডিপ ড্রিলিং থেকেও অনেক ভালো ফল আশা করছি।

গ্যাস স্তরের নিচে রয়েছে কঠিন শিলা। বাপেক্সের একটি ৩ডি সিসমিক (থ্রিডি) সার্ভেতে বলা হচ্ছে, কঠিন শিলার নিচে গ্যাস স্তর থাকতে পারে। ওই ৩ডিতে বলা হয়েছে, শ্রীকাইলে ৯২৬ বিসিএফ (বিলিয়ন ঘনফুট) আর তিতাসে ১ হাজার ৫৮৩ বিসিএফ গ্যাস থাকতে পারে। সব মিলিয়ে মজুতের পরিমাণ আড়াই টিসিএফের (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) মতো হতে পারে। তবে কঠিন শিলার নিচের স্তরে কী আছে, তা কূপ খনন করে দেখা হয়নি। আর কূপ খনন না করা পর্যন্ত কোনো কিছু নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। সে কারণে বাংলাদেশ কূপ খনন করতে যাচ্ছে।

অবহেলিত পার্বত্য এলাকাতেও কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। সমতলের চেয়ে কিছুটা জটিল হওয়ায় সাগরের মতো আন্তর্জাতিক দরপত্রের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ জন্য সাগরের আদলে একটি পিএসসি করার কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান।

তিনি আরো বলেন, বিশাল সম্ভাবনার গভীর সমুদ্র নিয়েও কাজ চলমান রয়েছে। নতুন পিএসসির ফলে অনেক বিদেশি কোম্পানি আগ্রহ দেখাচ্ছে। মার্চে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। প্রতিযোগিতায় যারা প্রথম হবে তারাই কাজ পাবে। আমরা ২০২৬ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করার সব রকম প্রস্তুতি নিয়েছি।

বাংলাদেশে প্রচুর গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৯টি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তেল-গ্যাস সম্পদের সম্ভাবনা নিরূপণে কাজ করে। কিছু সংস্থা সারাদেশে এবং কিছু সংস্থা বিশেষ এলাকায় অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০০১ সালে ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) ও পেট্রোবাংলা, হাইড্রোকার্বন ইউনিট ও নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট সমীক্ষা পরিচালনা করে। ইউএসজিএস-পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে সর্বনিম্ন ৮ দশমিক ৪, গড় ৩২ দশমিক ১ ও সর্বোচ্চ ৬৫ দশমিক ৭ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন কিউবিক ঘনফুট) গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে, হাইড্রোকার্বন ইউনিট ও নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট সর্বনিম্ন ১৯, গড় ৪২ ও সর্বোচ্চ ৬৪ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছে।

বাংলাদেশে মোট ২৯টি গ্যাস ফিল্ড আবিস্কৃত হয়েছে। ২০টি গ্যাস ফিল্ডের ১১১টি কূপ দিয়ে দৈনিক (ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৪) ২০৪১ দশমিক ৭ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। মজুত কমে আসায় অনেক কূপেই উৎপাদন কমে এসেছে। ৫টি গ্যাস ফিল্ড (রূপগঞ্জ, কামতা, ফেনী, ছাতক ও সাঙ্গু) পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ৩টি গ্যাস ফিল্ড (কুতুবদিয়া, ভোলা ও জকিগঞ্জ) বন্ধ রয়েছে গ্যাস সঞ্চালন ব্যবস্থা না থাকায়।

বাংলাদেশের সফলতার হার উচ্চ হলেও এখন তিমিরেই মনে করেন অনেকে। তবে সেই ধারা ভেঙে গতিতে ফিরেছে পেট্রোবাংলা। ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে গ্যাসের মজুত ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে আশার আলো দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে প্রথম কূপ খনন করা হয় ১৯১১ সালে। ১১২ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে, কমবেশি ৯৯টি। আর ৩ বছরে ৭০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে চায় পেট্রোবাংলা।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *