সারাদেশ

ব্যতিক্রমী আয়োজনে ভূঁয়সী প্রশংসা পেট্রোবাংলার

ডেস্ক রিপোর্ট: পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারের ব্যতিক্রমী আয়োজন ভূঁয়সী প্রশংসায় ভাসালেন অংশগ্রহণকারীরা। শেষ বয়সে দেশের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন তাঁরা।

আর যারা এসেছিলেন তারা কেউ নন, প্রত্যেকেই দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। তাঁরা পেট্রোবাংলা কিংবা অধীনস্থ কোম্পানির শীর্ষ পদে থেকেছেন কোনো না কোনো সময়ে।

আবার অনেকে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে। তারাও দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি খাতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) পদ থেকে অবসরে চলে যান প্রাথমিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মকবুল-ই-এলাহী চৌধুরী। তিনি বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি, বাপেক্স, মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানিসহ বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষপদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি বলেন, অবসর নেওয়ার পর এই প্রথম এমন আয়োজন দেখলাম। খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ! এ রকম আয়োজন রাষ্ট্রের জন্য খুবই উপকারে আসবে! আমার পক্ষ থেকে বলতে চাই, আমি ফ্রি সার্ভিস দিতে প্রস্তুত আছি। প্রয়োজন মনে করলে, ফোন করবেন। আমাকে পাশে পাবেন।

তিনি বলেন, প্রত্যেকটি কূপে সাফল্য চান, তাহলে সম্ভব না। কোনো কূপে গ্যাস পাওয়া না গেলে আপনারা তাকে চাপে রাখবেন, তাহলে কেউ কাজ করতে সাহস পাবে না। আগে যে ফাইল ডিজিএম লেভেলের কর্মকর্তা স্বাক্ষর করতে পারতেন, এখন সেই ফাইল ওপরে উঠতে উঠতে সচিব পর্যন্ত যায় আবার একই পদ্ধতিতে নেমে আসে। এ কারণে যে কাজ তিনদিনে হতো, এখন তা তিন মাসেও হয় না। এ রকম আমলাতান্ত্রিকতা থাকলে আর যাই হোক, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান সম্ভব নয়।

পেট্রোবাংলার ১০০ কূপ খনন প্রকল্পকে উচ্চাভিলাষী বললেও খুবই জরুরি বলে উল্লেখ করেন মকবুল-ই-এলাহী চৌধুরী।

জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, আমরা অন্ধকার যুগ থেকে বের করে এনেছি। কূপ ফেল করলে আমি চেয়ারম্যান দায় গ্রহণ করবো! কথা দিচ্ছি, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা কিংবা তদন্ত কমিটি হবে না। সাফল্য পেলে সবার আর ফেল করলে দায়িত্ব আমি মাথা পেতে নেবো।

পেট্রোবাংলার সাবেক মহাব্যবস্থাপক মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ডাকলে আসবো, পরামর্শ দেবো। দেশ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। শেষ বয়সে দেশের জন্য কিছু করতে চাই। একটি কোর গ্রুপ তৈরি করে দেন, যারা বাপেক্সে বসে দেশের জন্য কাজ করবে। বিদেশি বিশেষজ্ঞ হায়ার (ভাড়া) করতে হবে না। আমাদের দেশেই অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোক রয়েছেন, যারা আপনাদের ফ্রি সার্ভিস দিতে প্রস্তুত রয়েছেন।

তিনি বলেন, কনোকো ফিলিপসের সিসমিক সার্ভে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তারা সাগরে ৭ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। সাগরে দ্রুত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা প্রয়োজন।

পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে অবসর নেন মর্তুজা আহমেদ ফারুক। তিনি বলেন, টেকনিক্যাল কারণে বাপেক্সকে দিয়ে পার্বত্য এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান সম্ভব নয়। বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করানো উচিত। সেখানে অনেক গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের মতো একই ভূ-কাঠামো থেকে ত্রিপুরা অনেক গ্যাস উত্তোলন করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, একটি কূপে গ্যাস পাওয়া না গেলে হৈচৈ শুরু করলে চলবে না। ১০টির মধ্যে ৮টি ড্রাই হলে ফেলে আসবো, তাহলে সম্ভব না। রাজস্থানে ইউনোকল টানা ১৩টি কূপ খনন করে ড্রাই পায়। এরপর কোম্পানির সদর দপ্তর বলেছিল, কূপ আর খনন না করতে! কিন্তু জিওলজিষ্ট অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে চৌদ্দ নম্বর কূপ খনন করে ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বড় খনি আবিষ্কার করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন ভূইয়া বলেন, ২৫টি কূপ খনন করে যদি ব্যর্থ হন, যদি ছাব্বিশ নম্বর কূপে গ্যাস পাওয়া যায়, তার দাম অনেক বেশি। খরচের কয়েকগুণ উঠে আসবে।

দেশে গ্যাস সংকটের জন্য অনুসন্ধান স্থবিরতাকেই দায়ী করে আসছিলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। পেট্রোবাংলার ঢিলেমির কারণে অনেকেই সমালোচনায় মুখর ছিলেন। তবে সেইদিন এখন বদলে যেতে শুরু করেছে পেট্রোবাংলার বর্তমান চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারের হাত ধরে।

সবচেয়ে বড় সমালোচনা ছিল, কূপ খনন না করা। সেখানেই প্রথম ধাক্কা দিয়েছেন জনেন্দ্র নাথ সরকার। ৪৮টি কূপ খনন প্রকল্পে হাত দিয়েছেন, যা দেখে অনেকের চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা।

দ্রুতগতিতেই এগিয়ে চলছে ৪৮ কূপ খনন প্রকল্প। ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হবে। ইতোমধ্যে, ওই কর্মসূচির সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। ১০টি কূপের মাধ্যমে দৈনিক ১৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা বেড়েছে বাংলাদেশের।

আশা করা হয়েছিল, দৈনিক ১০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন বাড়বে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস বেশি পাওয়া যাবে।

এখানেই বসে নেই, ৪৮ কূপের পর ২০২৬-২৮ সালের মধ্যে আরো ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে পেট্রোবাংলা। এ জন্য তিন শতাধিক সম্ভাবনাময় এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে ১০০টি কূপ চুড়ান্ত করা হবে। এ জন্য একটি কোর কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়।

সেই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞদের বৃহস্পতিবারের সেমিনারে আমন্ত্রণ জানানো হয়। খানিকটা মিলমেলার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, পেট্রোবাংলায়। যারা তাদের যৌবনের সোনালি সময়গুলো এখানে কাটিয়ে গেছেন! অনেকেই স্মৃতিচারণ করেন, কাজের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। এমনকী পদে পদে জটিলতা কীভাবে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, সেগুলোও তুলে ধরেন তারা। প্রত্যেকেই পেট্রোবাংলার উদ্যোগকে স্বাগত জানান। পাশাপাশি মাঝে-মধ্যে এমন আয়োজন করার অনুরোধ জানান।

তারা বলেন, পুরনোদের অভিজ্ঞতা আর নতুনদের উদ্যম বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশে প্রচুর গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে জন্য তেল-গ্যাস অনুসন্ধান বাড়ানো উচিত আর তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে টাকার প্রয়োজন হয় না। এখানে বিনিয়োগ করার জন্য অনেক কোম্পানি বসে রয়েছে।
সকালে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

তিনি বলেন, যারা বাইরে আছেন, সবাইকে সঙ্গে রাখতে হবে। আমাদের গ্যাস লাগবে আর সমালোচনা নয়! আসুন, একসঙ্গে দেশের জন্য কাজ করি! আমি চাই, গঠনমুলক আলোচনা হোক।

দীর্ঘদিনের স্থবিরতা দূর করে বুলেট গতিতে ছুটতে চায়। অতীতের সব রেকর্ড ভাঙার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ১১২ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে, কমবেশি ৯৯টি আর ৩ বছরে ৬৯টি কূপ খনন করতে চায় পেট্রোবাংলা।

অন্যদিকে, নতুন মাত্রাও যুক্ত হয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে। এতদিন তেল-গ্যাস অনুসন্ধান একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে ছিল বাংলাদেশ। আরো ছোট করে বলতে গেলে সুরমা বেসিন তথা, সিলেট থেকে শুরু করে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী এবং ভোলার মধ্যে আটকে ছিল বাংলাদেশ। অন্যান্য এলাকায় কিছু অনুসন্ধান কার্যক্রম চললেও তার সংখ্যা নগণ্য বলাই যায়। সেখানেও আমূল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের পুরো ভৌগলিক এলাকা অনুসন্ধানের আওতায় আনা হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের ম্যাপ নিয়ে বসেছি। সেখানে কোন কোন এলাকায় আগে সিসমিক সার্ভে হয়েছে, সেখানে সবুজ চিহ্নিত করা হয়েছে। যেসব এলাকায় আগে কাজ হয়নি, সেগুলো চিহ্নিত করে সিসমিক সার্ভে করা হবে। এরপর সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বাংলাদেশে মোট ২৯টি গ্যাস ফিল্ড আবিস্কৃত হয়েছে। ২০টি গ্যাস ফিল্ডের ১১১টি কূপ দিয়ে দৈনিক (ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৪) ২০৪১ দশমিক ৭ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। মজুত কমে আসায় অনেক কূপেই উৎপাদন কমে এসেছে। ৫টি গ্যাস ফিল্ড (রূপগঞ্জ, কামতা, ফেনী, ছাতক ও সাঙ্গু) পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ৩টি গ্যাস ফিল্ড (কুতুবদিয়া, ভোলা ও জকিগঞ্জ) বন্ধ রয়েছে গ্যাস সঞ্চালন ব্যবস্থা না থাকায়।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *