আন্তর্জাতিক

ইন্দো-বাংলা-চীন সম্পর্ক: সমীকরণ ও জটিলতা

ডেস্ক রিপোর্ট: কূটনৈতিক চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রেও শিল্প বাণিজ্য অর্থনীতির প্রভাব বা গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। এশীয় মহাদেশে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, দুই বৃহত্তম দেশ ভারত এবং চীনের মধ্যে পারস্পরিক কূটনৈতিক এবং অন্যান্য সম্পর্ক যে মোটেই মধুর নয় সে কথা সবারই জানা। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে ভারতের প্রতিবেশী বন্ধুদেশ বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই ভালো এবং চীনের পক্ষ থেকেও এই সম্পর্ককে আরো উন্নততর এবং মধুরতর করার প্রচেষ্টা সবসময় জারি আছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একথা গোপন করেননি যে বাংলাদেশের পরিকাঠামো উন্নয়নের খাতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থের বা বিনিয়োগের প্রয়োজন তা যদি বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারের থেকে সহজ শর্তে এবং সহজ উপায়ে পাওয়া যায়, তাহলে তা গ্রহণ করতে তার আদৌ আপত্তি নেই।

এই তিনটি দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের সমীকরণের ক্ষেত্রে শেষ সমীকরণটি হল ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। এই নিয়ে কোনো দ্বিমত বা সন্দেহের অবকাশ নেই যে এই মুহূর্তে ভারত বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক একেবারে শিখরে অবস্থান করছে। তিস্তা জলবন্টনের মত কিছু অম্ল বিষয় থাকলেও সাম্প্রতিক কালের মধ্যে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম সাধারণ নির্বাচনে ভারত যে ভূমিকা নিয়েছে এবং যেভাবে শক্তপোক্ত হয়ে কিছু পশ্চিমে দেশের বিরোধিতার সত্ত্বেও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে তাতে এই সম্পর্ক মজবুত থেকে মজবুততরই হয়েছে।

এই যে তিনটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের সমীকরণের জটিলতা – তাকে কিভাবে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগানো বা ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে এবার চীনের সরকার সর্বতোভাবে প্রচেষ্ট হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরে এবং ড. হাছান মাহমুদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পরে যারা প্রথম দিকেই অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কিন্তু চীনের রাষ্ট্রদূত ও ছিলেন। এবং যা শোনা গেছে বা ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তাতে একথা স্পষ্ট যে তিস্তা জলবন্টন নিয়ে ভারতবর্ষের পক্ষ থেকে যে গড়িমসি- তাকে কেন্দ্র করে- বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের বিরুদ্ধে উস্কানি জোগাতে কোন কসুরি রাখেননি চীন সরকার। শোনা গেছে, জলবন্টন নিয়ে ভারত বাংলাদেশ এ ঐক্যমত্য না হলে তিস্তা নদীর উপর ওই নদীর জলকে কেন্দ্র করে যে বিকল্প প্রস্তাব – যা মূলত ড্রেজিং নির্ভর – চীন সরকার বাংলাদেশ সরকারকে, ২০১৭ সাল থেকে দিয়ে রেখেছে, তার ছাড়পত্র পাওয়ার ব্যাপারেও চীনের প্রশাসন নতুন করে উদ্যোগী বা সচেষ্ট হয়েছে।

শুধু তাই ই নয়, অতি সম্প্রতি ডলারকে এড়িয়ে রুপি-টাকায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য শুরু করেছে ভারত, যাতে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলোর জোগান বাংলাদেশের বাজারে স্থিতিশীল থাকতে পারে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে ডলারের রিজার্ভ ঘাটতিতে যা ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তাতে চীনের প্রশাসনও নাকি ঢাকাকে একই ধরণের প্রস্তাব দিয়েছে। দুই দেশের মধ্যেই মুদ্রা বিনিময়কে আরও সহজ করতে বাংলাদেশে এক বা একাধিক চীনা ব্যাংক খোলার প্রস্তাবও নাকি বিবেচনাধীন।

শেখ হাসিনা সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বাজার আরো বেশি করে দখল করার লক্ষ্যে অত্যন্ত তৎপর হয়ে পড়েছে চীন। সেই সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশের বেশ কিছু বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাবনাও। এই সমস্ত কিছুই রূপায়িত হোক বা না হোক, বেইজিং এর এই প্রস্তাবগুলো বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার উভয়ের উপরই চাপ সৃষ্টি করবে বা চাপ রেখে চলবে। বাংলাদেশ সরকার যাতে চীনের এই চাপ কাটিয়ে বেরোতে পারে, তার জন্য মোদি সরকারকেও শেখ হাসিনা সরকারের পাশে আরো শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। এই অঞ্চলে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি এবং গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য ভারতকে বাংলাদেশকে পাশে নিয়েই চলতে হবে- এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই।

সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে, এই তিন দেশের মধ্যে কূটনৈতিক, আর্থিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের সমীকরণ আগামী দিনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে আর এই দিকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের লাগাতার নজর থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলকাতা 

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *