আন্তর্জাতিক

চ্যাটজিপিটির যুগে গণমাধ্যমের টিকে থাকার উপায় কী?

ডেস্ক রিপোর্ট: এআইয়ের সর্বগ্রাসী প্রভাব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কাছে প্রতিনিয়ত পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে মূলধারার গণমাধ্যম। টিকে থাকার এ প্রতিযোগিতায় মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোকে নিয়মিত ‘রিচ’ বাড়াতে বহুমুখী কৌশল নিতে হচ্ছে। সহায়তা নিতে ঝুঁকতে হচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের দিকেই। ফলে, এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জন্য প্রদত্ত নীতিমালা, অ্যালগরিদম ও মালিকানা পরিবর্তন গণমাধ্যমের স্বাভাবিক বিচরণকে প্রভাবিত করছে চরমভাবে।

এসবের ভিড়ে প্রচলিত মূলধারার সংবাদমাধ্যমসমূহের টিকে থাকা ইতিহাসের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং। গণমাধ্যম ভাইস-এর দেউলিয়া হওয়া, ইলন মাস্কের এক্স (সাবেক টুইটার) অধিগ্রহণ, যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় সংবাদপত্র গোষ্ঠীর বিপুল কর্মী ছাঁটাই করার মতো ঘটনা এই চ্যালেঞ্জকে আরও ত্বরান্বিত করে। তার উপর সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে চ্যাটজিপিটির মতো এআই প্রযুক্তিও।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রমরমা মৌসুমে লেখা নির্ভর সংবাদমাধ্যমগুলোর পরিস্থিতি দিনদিন আরও খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত তেমন বিশেষ কোনো উপায় তারা খুঁজে বের করতে পারেনি যা দিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। ২০২৪ সালও সংবাদমাধ্যমের জন্য এখন পর্যন্ত বড় কোনও সুখবর নিয়ে আসেনি; পাওয়া যাচ্ছে না খুব বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাসও। বরং ক্রমাগত অ্যালগরিদম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমের লেখা প্রধান সংবাদের ‘রিচ’ কমিয়ে দিচ্ছে এসব সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহ। 

অন্যদিকে বিজ্ঞাপন নির্ভর এসব মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর ক্লায়েন্টদেরও কেড়ে নিচ্ছে সম্প্রতি দর্শক আকর্ষণের শীর্ষে থাকা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও টিকটকাররা। বিজ্ঞাপনের বাজারকে সংকুচিত করার পেছনে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চলমান সংঘাত, রাজনৈতিক উত্তেজনাও দায়ী। ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রাণঘাতি যুদ্ধ, জলবায়ু সংকট, কোভিড মহামারীর পরে সৃষ্ট দীর্ঘ অর্থনৈতিক মন্দা গণমাধ্যমের আয়ের উৎসকে একেবারেই তলানিতে এনে ঠেকিয়েছে।

মূলধারার সংবাদমাধ্যমসমূহ ঘুরে দাঁড়াবে কোন পথে?

করোনা মহামারী চলাকালীন সময়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর কর্মী ছাঁটাই এবং নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার যে চিত্র দেখা গিয়েছিল তা ভয়াবহ। বর্তমান পরিস্থিতিও তেমনই নড়বড়ে। ঐতিহ্যবাহী এই সংবাদমাধ্যমগুলো যদি টিকে থাকতে চায় তাদের ছুটতে হবে বর্তমান বাজার কৌশলের পেছনে। যে হারে বিজ্ঞাপনের বাজার পরিবর্তিত হচ্ছে, তাতে আয়ের উৎস নিয়েও চিন্তা বাড়ছে হাউসগুলোতে।

রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজমের জ্যেষ্ঠ সহযোগী গবেষক নিক নিউম্যানের মতে, তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা এবং মূলধারার মিডিয়ার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার এই চ্যালেঞ্জ ২০২৪ সালে ৪০ টিরও বেশি দেশের নির্বাচন এবং চলমান সংঘাতে গভীর প্রভাব ফেলবে।

রয়টার্স ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নিউম্যানের অপর এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০২৬ সালের মধ্যে ‘কৃত্রিমভাবে তৈরি’ (synthetically produced) করা হবে ইন্টারনেট কন্টেন্টের বড় অংশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নতুন নতুন ট্রেন্ডকে জনপ্রিয় করার মধ্য দিয়ে খুব সহজে বাস্তব দুনিয়ার খবরকে অনেকাংশেই বদলে দিতে বা ধামাচাপা দিতে সক্ষম হবে।

এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিক ও ব্যবস্থাপকদের দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সাংবাদিকদের একই সাথে লেখা, অডিও- ভিডিও আধেয় এবং মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতায় দক্ষ হতে হবে। এছাড়াও নিউম্যান তার জরিপভিত্তিক গবেষণায় প্রাসঙ্গিক আলোচনা টেনে গণমাধ্যমের আয়-রোজগার এবং টিকে থাকা নিয়ে কিছু উপায় উল্লেখ করেছেন।

১. গণমাধ্যমের অর্থায়নে পরিবর্তন আনতে হবে।

একদিকে খুব দ্রুত হারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন দর্শক; অন্যদিকে পাঠক, শ্রোতা অথবা দর্শক হারাচ্ছেন মূলধারার গণমাধ্যম। একসময়কার শক্তিশালী টেলিভিশন স্টেশনগুলোও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। আবার টেক জায়ান্টদের অ্যালগরিদম পরিবর্তনের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর অত্যন্ত জনপ্রিয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ভক্স এবং ভাইসও  অলাভজনক হয়ে পড়ছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাঁধে ভর না করে, নিজস্ব অর্থায়ন কৌশল খুঁজে বের করতে হবে গণমাধ্যমের।

গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকরাও নতুন নতুন সাবস্ক্রিপশন মডেল চালু করছেন। ‘কন্টেন্ট বান্ডলিং’ তার মধ্যে একটি। ভোক্তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পে-ওয়াল প্যাকেজ তৈরি করা হচ্ছে, যার মধ্যে থাকছে পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের আধেয় (কন্টেন্ট)।

নিউম্যানের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, ‘কন্টেন্ট বান্ডলিং’ কৌশলটি কাজ করেছে। গবেষণায় তিনি দেখেছেন যে, এ ধরনের বাজার কৌশল হাতে নেওয়ায় পাঠক বা ভোক্তারা নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত ঢুঁ মারছেন।

২০২৩ সালে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জরিপ পরিচালনা করেছেন তিনি। সে জরিপে উঠে এসেছে, বিশ্বজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার ভেতরেও ‘সাবস্ক্রিপশন’ নেওয়া থামিয়ে রাখেননি গ্রাহকরা। তবে সাবস্ক্রিপশন বিক্রির টাকায় বিজ্ঞাপন সংশ্লিষ্ট আয়ের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব যায়নি এখনও। তবে আশার বিষয় হলো সাবস্ক্রিপশন বিক্রি প্রতিবছরই বেড়ে চলেছে।

কেবল ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রই নয়, গণমাধ্যমের ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন প্রতিবেশী ভারতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে দেশটির ৭০টিরও বেশি সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন ধরনের ‘পে-ওয়াল’-এর আওতায় নিজেদের কন্টেন্ট রেখেছেন।  

বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ইআই (আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং) তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলছে, ভারতে প্রিমিয়াম ও এক্সক্লুসিভ কন্টেন্টের সাবস্ক্রিপশন গ্রাহকদের বিক্রি করে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলোর আয় ২০২৩ সালে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ১৪ মিলিয়ন ডলার।

২০১৮ সালে দিল্লি প্রেস গ্রুপ প্রথমবারের মতো পে-ওয়াল কৌশল প্রয়োগ শুরু করে। এই সংস্থাটির ৯টি ভাষায় ৩০টির বেশি সংবাদমাধ্যমের মালিকানা রয়েছে। ওই একই আলোচনায় দিল্লি প্রেস গ্রুপের পরিচালক অনন্ত নাথ বলেন, ‘সেসময় কোনো কিছুই কাজ করছিল না। আমরা বাধ্য হয়েই কন্টেন্টের জন্য পে-ওয়াল চালু করি। শুরুতে পাঠকরা দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু আমাদের কোনও উপায় ছিল না। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বিজ্ঞাপনও গণমাধ্যমের আয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলবে।’

যেসব পত্রিকা ছাপা হওয়ার পাশাপাশি অনলাইন পোর্টালও চালায়, তারা নিজেদের কন্টেন্টগুলো নিজেদের পরিবেশিত এক্সক্লুক্সিভ ও গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোকে পে-ওয়ালের আওতায় নিয়ে এসেছে। ইআই-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ভারতে ২০২৫ সালের মধ্যে সংবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট নানা ধরনের পণ্য থেকে সাবস্ক্রিপশনের আয় দাঁড়াবে ২৯ মিলিয়ন ডলারে। তবে ‘কন্টেন্ট বান্ডলিং’ কৌশলের কারণে এ আয় প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫৮ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি দাঁড়াবে।

হিন্দুস্তান টাইমস গ্রুপের প্রকাশনা ‘মিন্ট’ ২০২০ সালে ডিজিটাল সাবস্ক্রিশন মডেল চালু করে। গত বছরের ইন্ডিয়ান ম্যাগাজিন কংগ্রেসে ডিজিটাল পে-ওয়াল নিয়ে এক প্যানেল আলোচনায় প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া স্ট্রিমের স্ট্র্যাটেজিস্ট নিখিল কানেকল বলছেন, ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন থেকে ‘মিন্ট’ তার আয়ের ২৫ শতাংশ উঠিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছে। কারও উপর নির্ভর না করে সংবাদ ওয়েবসাইট হিসেবে আয় বাড়ানোয় পে-ওয়াল দারুণ কাজ করেছে। 

গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, ২০২৪ সালে ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশনের পরে সবচেয়ে বেশি আয় হবে বিজ্ঞাপন খাত থেকে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকদের লক্ষ্য থাকবে তিন বা চারটি ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়ে একাধিক আয়ের উৎস তৈরি করা। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস হিসেবে বিভিন্ন ইভেন্ট এবং ই-কমার্সও বিবেচিত হবে।

নিউম্যানের গবেষণা বলছে, টেকজায়ান্টদের থেকে গণমাধ্যম যে অতিরিক্ত আয় করতো তা বাড়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই বললে চলে। তার এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পেছনে কারণ হলো ইতিমধ্যে ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম সংবাদমাধ্যমগুলোকে কন্টেন্টের বদলে অর্থ দেওয়ার পথ পাল্টে ফেলার কৌশল হাতে নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকে টিকে থাকতে হলে প্রচলিত মাধ্যম থেকে কৌশলগতভাবে সর্বাধিক আয় করার উপযোগী ১০০ ভাগ ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তরিত হতে হবে।

২. এআইয়ের সর্বগ্রাসী প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকরী কৌশল অনুসন্ধান করতে হবে

নতুন প্রযুক্তির আগমন, দর্শক-পাঠকের রুচির পরিবর্তন ও আচরণের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য গণমাধ্যমগুলোকে প্রতিনিয়ত কার্যকরী কৌশল খুঁজতে হবে। অর্থাৎ পাঠক-দর্শকের সঙ্গে আরও শক্তিশালী ও সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার উপায় খুঁজতে হবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার এটিই হয়তো সর্বশেষ উপায়।

নিউম্যান নিজের গবেষণাতে এআই এর হুমকির বিষয়েও জোর দিয়েছেন। তার মতে, তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের জায়গা এআই-এর দখলে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নতুন প্রযুক্তি কীভাবে ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করবে এবং এর সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন তিনি।

গতমাসের আইসিএফজে-এর ওয়েবিনারে নিউম্যান বলেছিলেন, ‘কিছু গণমাধ্যম ব্যবস্থাপক সত্যিই এআইকে অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেন। কেননা, তথ্য অনুসন্ধানের নতুন এই অভিজ্ঞতা গণমাধ্যমের জায়গা দখল করে নেবে।’

এআই-এর প্রভাবগুলো সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। ফলে এটি গণমাধ্যম ব্যবসাকে কীভাবে প্রভাবিত করবে সে পূর্বাভাস এখনই দেওয়া যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

গবেষণায় বলা হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) আবির্ভাব চলতি বছরে বিশ্বজুড়ে তীব্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সংবাদমাধ্যম খাতকেও কাঁপিয়ে দেবে।বিশেষ করে কন্টেন্ট তৈরিতে এআই-এর প্রভাব সর্বগ্রাসী হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। 

সম্পাদক ও গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকরা মনে করছেন,  চলতি বছর অনলাইনে ব্রাউজার দিয়ে সার্চ করলে রেফারেল ট্রাফিক আরও কমবে। এআই সার্চ ইঞ্জিন এবং অন্যান্য মাধ্যমগুলো নিজেদের ব্যবসায়িক সুবিধায় একসঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে বলেই এমনটা মনে করছেন তারা।

অন্যদিকে গুগল এবং মাইক্রোসফট সার্চ জেনেরেটিভ এক্সপেরিয়েন্স (এসজিই) ব্যবহার করা শুরু করেছে। আগে সার্চ করলেই গুগল কেবল ওয়েবসাইটের লিংক দিতো, এখনও সেটি দিচ্ছে; তবে গ্রাহকের সামনে সবার প্রথমে তথ্য বা অনুসন্ধানের সরাসরি উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। এতে অনুসন্ধানকারীর লিংকে ঢোকার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।   

টানটান উত্তেজনার এই প্রতিযোগিতায় এরই মধ্যে মাইক্রোসফটের সার্চ ইঞ্জিন বিং চ্যাটজিপিটি-এর নির্মাতা ওপেনএআই-এর সঙ্গে যৌথভাবে রিয়েল-টাইম সংবাদ পরিবেশন শুরু করেছে। এর অ্যালগোরিদমের মডেলটি সংবাদ ওয়েবসাইটসহ বিভিন্ন সাইটের কন্টেন্ট থেকে তথ্য সেঁচে আনার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ। অন্যদিকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চ্যাটজিপিটি-এর আদলেই গুগল নিয়ে এসেছে ‘জেমিনাই’। ইন্টারনেট কন্টেন্ট এবং অন্যান্য উৎসগুলো থেকে লেখা, ছবি, অডিও এবং ভিডিও তথ্য নিয়ে কাজ করতে পারদর্শী ‘জেমিনাই’। গুগল এর সাহায্য নিয়ে ইন্টারনেটে সার্চের ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে পরাক্রমশালী।

৩. সংবাদ পরিবেশনার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে

নিজের গবেষণায় নিউম্যান চলতি বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মূলধারার গণমাধ্যমের মধ্যকার জটিল সম্পর্কের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন। ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গত এক বছরেই সংবাদের গুরুত্ব বা প্রাধান্য কমিয়ে দিয়েছে। সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের তুলনায় স্বতন্ত্র কন্টেন্ট নির্মাতাদের প্রাধান্য দিয়ে মেটা ও টিকটক নিজেদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা জারি রেখেছে। আর তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে পরীক্ষিত গণমাধ্যমগুলো দর্শক ও পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণে কন্টেন্ট ক্রিয়েটর বা ইনফ্লুয়েন্সারদের থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।

পাশাপাশি ভিডিও-কেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্ম যেমন টিকটক ও ইউটিউব-এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংবাদ পরিবেশনার পদ্ধতিতেও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। 

নিউম্যান গত মাসে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টস (আইসিএফজে)-এর এক ওয়েবিনারে বলেন, “তথ্য-উপাত্ত বলছে, সংবাদ পরিবেশন ও প্রচারের যে প্রক্রিয়া, তা একটি জটিল ‘ইকোসিস্টেমে’ পরিণত হয়েছে। ফেইসবুক এখন আর এই জগতের দণডমুণ্ডের কর্তা নেই।”

সংবাদ সম্প্রচারের প্রক্রিয়ায় আমূল এ পরিবর্তনের ফলে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য বিশ্বজুড়ে প্রকাশক ও ব্যবস্থাপকদের নামতে হয়েছে নতুন নতুন উপায়ের সন্ধানে। যেমন, ভোক্তার পছন্দমাফিক কন্টেন্ট দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হাতিয়ার হিসেবে নিতে হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো ম্যাসেজিং অ্যাপেরও। 

৪. মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনাকে প্রাধান্য দিতে হবে

পাঠকের রুচির পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে শুধু লেখা পড়েই সন্তুষ্ট থাকছে না। তারা লেখার পাশাপাশি ভিডিও ও অডিও শুনতে চায়। তাই মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে মূলধারার গণমাধ্যমসমূহকে। বিগত দুই দশকে সংবাদের লিঙ্ক অনুসন্ধান এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে আরেকজনকে সেটি পাঠানো সহজ ছিল। বেশিরভাগ সময়েই লিখিত কন্টেন্টই ছিল গণমাধ্যমের আয়ের অন্যতম জোগানদাতা। অডিও-ভিডিওর মতো অন্যান্য কন্টেন্টগুলোকে বিবেচনা করা হতো সহকারীর ভূমিকায়।

কিন্তু গত কয়েক বছরে মোবাইল ডিভাইসগুলোর প্রাযুক্তিক উন্নয়ন বদলে দিয়েছে পুরনো চিত্র। এ সময়ের মধ্যেই আবার অডিও এবং ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি এবং শেয়ার করে এমন কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম অর্জন করে নিয়েছে পাঠক জনপ্রিয়তা। নতুন প্রজন্মের গ্রাহকরা পড়ার বদলে শোনা ও দেখাকেই যেহেতু বেশি পছন্দ করছে তাই প্রতিযোগিতাই পিছিয়ে পড়ছে প্রথাগত সাংবাদিকতা।

নিউম্যানের জরিপে উঠে এসেছে, কিছু সংবাদমাধ্যম এই পরিবর্তনকে প্রথাগত বার্তাকক্ষের জন্যে ডিজিটাল বিপ্লবের ‘দ্বিতীয় পর্যায়’ হিসেবে দেখছে। টেক্সট নির্ভর কন্টেন্ট থেকে সরে এসে মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট তৈরিতে সাফল্য পেতে হলে বার্তাকক্ষগুলোকে তাদের কাজের ধরনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা ছাড়া কোন উপায় নেই।

২০২৪ সালে এসে এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে সংবাদমাধ্যমগুলোকে আরও বেশি ভিডিও-অডিও কন্টেন্ট তৈরি করতে হবে। এর পাশাপাশি প্রচারিত বা প্রকাশিত লিখিত কন্টেন্টের সংখ্যাও ধরে রাখতে হবে বলে ধারণা করছেন নিউম্যান।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *