সারাদেশ

মাঠের পাশের জেলেপাড়ার প্রতিটি ঘর যেন ‘পার্কিং স্পট’

ডেস্ক রিপোর্ট: সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে উন্নয়ন ঘটেছে জনজীবনে। কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে নিজস্ব অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক বেকার মানুষ।

অন্যদিকে, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছে এক শ্রেণির প্রতারক চক্র। মানুষকে ভাওতা দিতে মুসলমানের কাছে সবচেয়ে পবিত্র ও তীর্থস্থান ‘কাবা ঘর’কেও ছাড়তে নারাজ এই চক্রটি। আর এ জন্য তারা খুঁজে বের করছে অভিনব ও অদ্ভুত সব বিষয়। যার সবশেষ সংযোজন ‘কাবা ঘরের সামনে ছাগলের দুধের তৈরি সাবান কোরবানি’।

মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে প্রচারণা চালাতে ওমরা হজে নিয়ে এই সাবান কোরবানি করা হচ্ছে। আর তাতে ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকেই। অথচ এটি স্রেফ এর পণ্যের প্রচার। ‘কাশ্মেরী বিউটি বাই জিনিয়াত’ নামে রূপচর্চায় ব্যবহৃত পণ্যের অনলাইন শপের স্বত্বাধিকারী জিনিয়াত জাহান যার মূল হোতা।

জিনিয়াত জাহানের গ্যারান্টি এই সাবান কোরবানীতে রাতারাতি পুরো শরীর দুধের মতো সাদা হয়ে যাবে।

পবিত্র নগরী মদিনায় মসজিদে নববীর পাশে মুখে সাবান লাগিয়ে ফেসবুক লাইভে বসে থাকেন বাংলাদেশি নারী জিনিয়াত। মসজিদের মিনার দেখিয়ে নিজের তৈরি সাবানের গুণগান প্রচার করতে থাকেন। শুধু তাই নয়, মক্কায় গিয়ে পবিত্র কাবা ঘর দেখিয়ে নিজের পণ্যের বিজ্ঞাপন করেন এই নারী।

অথচ তার তৈরি এই পণ্যের গুণগত মানের কোনো পরীক্ষা হয়নি, হয়নি এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো ল্যাবরেটরি টেস্ট। অননুমোদিত এমন সাবানজাতীয় পণ্যের ব্যবহারে মরণব্যাধি স্কিন ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগ হতে পারে বলেই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক স্ক্রিন বিশেষজ্ঞ ডা. রেবেকা সুলতানা বার্তা২৪.কম’কে বলেন, অনলাইনে এভাবে জোর প্রচারণার মাধ্যমে যেভাবে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে সেখানে আসল নকল পণ্য চেনা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক কথায় ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, সাবান জাতীয় এমন নকল পণ্যের ব্যবহারের ফলে কন্টাক্ট ড্রামাটাইটিস (এলার্জিটিক রিয়্যাকশন) হওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্কিন যাদের বেশি সেনসেটিভ তাদের সমস্যাটা বেশি হয়। এই নকল পণ্যগুলো ব্যবহারের ফলে কিছু রিয়্যাকশন সঙ্গে সঙ্গে হয় আবার কিছু রিয়্যাকশন হয় ধীরে ধীরে। এছাড়া স্কিন ক্যান্সারসহ বেশ কিছু ধরনের জটিল রোগেরও সৃষ্টি হয়ে থাকে। এসব পণ্য ব্যবহারের ফলে দেখা যায় মানুষের ত্বক দ্রুত ফর্সা হয়। পরে আস্তে আস্তে এ সব ভেজাল পণ্যের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

নিজের একটি উদাহরণ দিয়ে বিশেষজ্ঞ ডা. রেবেকা সুলতানা বলেন, গত কয়েকদিন আগে আমাকে একজন একটা প্রডাক্ট দেখিয়ে বললো জাপানি। আমি বললাম জাপানিজ প্রডাক্ট বাংলাদেশে আসা অসম্ভব। পণ্য ব্যবহারে তাদের দেশের যে টার্মস এন্ড কন্ডিশনস সেটা আমাদের পক্ষে মানা সম্ভব না। হলেও অনেক বেশি দাম পড়বে। যার কারণে এগুলো রফতানি করে বাংলাদেশে আনতে চান না ব্যবসায়ীরা। অথচ অনলাইন বাজারে বলা হচ্ছে তাদের কাছে আছে জাপানি পণ্য।

কীভাবে বাংলাদেশে আসে এবং কম দামে কীভাবে দেয়? প্রশ্ন করেন ডা. রেবেকা। উত্তরেও তিনি নিজেই বলেন, তার মানে এগুলো বাংলাদেশেই তৈরি হয় আর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মোড়কজাত হয়।

ঢাকায় নকল পণ্যের রাজধানী জিনজিরাই এর উৎসস্থল, মত এই চিকিৎসকের। বিষয়টি সরকারি দেখভালকারী সংস্থা বা প্রশাসনকেই দেখতে হবে বলেও মত দেন তিনি। আর জিনিয়াত জাহানের এই সাবান বিক্রিকে রীতিমতো অন্যায় বলেই মনে করেন তিনি।

জিনিয়াত জাহানের এই মার্কেটিং পলিসিকে প্রতারণা বলে মানছে খোদ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)ও। তবে তারা আছেন অভিযোগের অপেক্ষায়। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

জিনিয়াতের কয়েকটি লাইভ প্রচারণার দৃশ্য পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, কোন প্রকার ল্যাব ছাড়া ঘরে বসে নিজ হাতে সাবান লোশন ও ক্রিম তৈরি করেন তিনি। ছাগলের দুধের সাবানে তৈরি করেই প্রথম আলোচনায় এসেছেন জিনিয়াত। এরপর তৈরি করেছেন ক্রিম, নারিকেলের তেলসহ বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী। নিজের তৈরি সাবান কতটা হালাল তা বোঝাতে ওমরায় গিয়ে নিজের সাবান ব্যবহার করেন তিনি। যার নাম দেন সাবান কোরবানি।

ওমরায় গিয়ে লাইভে জিনিয়াতের দাবি করেন, তার তৈরি সাবান বাংলাদেশের সবাই একবার হলেও ব্যবহার করেছেন। যা একটি মিথ্যাচার।

মসজিদের নববীর পাশে দাঁড়িয়ে হাতে লোসন নিয়ে ফেসবুক লাই‌ভে হাজির হন জিনিয়াত। লাইভে তিনি বলেন, আল্লার কাছে বলেছি আমার পণ্য যে নিয়তে যিনিই ব্যবহার করেন না কেন তার যেন সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। এ সময় ইন্নাইলাহি রাজিউন বলে সাবান কোরবানি করে মাগফেরাতও কামনা করেন জিনিয়াত জাহান।

বিষয়টিকে ধর্মের প্রতি অবমাননা ও অসম্মান বলে মনে করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও ইসলাম বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে কথা হয় বিশিষ্ট চিন্তাবিদ মুফতি এনায়েতুল্লাহ’র সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রথমত একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে- একটি পণ্য ক্রেতাদের জন্য হালাল ও ব্যবহার উপযোগী করার জন্য বিভিন্ন স্তর রয়েছে। পণ্যটি যদি ব্যবহারযোগ্য হয়ে থাকে তাহলে বিএসটিআই অনুমোদন দিত। বিএসটিআই অনুমতি দেয়নি, তাহলে ধরে নিতে হবে এটা ব্যবহারযোগ্য না। এখন এই পণ্যটি নিয়ে কাবা শরিফের সামনে প্রচারণা চালানো আইনত ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে অত্যন্ত বাজে কাজ। মানুষের ধর্মকে পুঁজি করে এমন কর্মকাণ্ড ইসলাম কখনও সমর্থন করে না।

এদিকে, অনলাইনে ব্যবসা জমিয়ে ঢাকার অভিজাত শপিংমলে শোরুম দিয়ে বসেছেন জিনিয়াত। সেখানেও বিক্রি হচ্ছে তার তৈরি ক্রিম, সাবান, কোকোনাট ওয়েলসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। নিয়ম অনুযায়ী এসব পণ্য তৈরিতে বিএসটিআই বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু জিনিয়াতের এসব পণ্যের কোন অনুমোদন নেই। শুধু তাই নয় কোন পণ্যের গায়ে উৎপাদন বা মেয়াদ উত্তীর্ণের কোনো তারিখও নেই। আইন অনুযায়ী এসব পণ্য বাজারজাতে রয়েছে শাস্তির বিধান।

উৎপাদন বা মেয়াদাত্তীর্ণ কোন তারিখ না থাকাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে করছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সেই সঙ্গে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপনে ক্রেতা আকৃষ্ট করলে আইনে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে বলেও জানাচ্ছে সংস্থাটি।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমরা সব সময় অবৈধ পণ্যের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকি। যদি তাদের পণ্যে বিএসটিআই অনুমোদন না থাকে এবং অবৈধ পণ্য হয়ে থাকে তাহলে আমরা অভিযান পরিচালনা করবো এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবথা নেব।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) উপ-পরিচালক রিয়াজুল হক বার্তা২৪.কম’কে বলেন, বিএসটিআই অনুমোদনবিহীন পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব পণ্যের ব্যবহারে মানুষের প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে। কেউ যদি এমন অপরাধ করে তাহলে আপনারা তথ্য দেন আমরা বিষয়টা খতিয়ে দেখে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।

এসব বিষয়ে জানতে জিনিয়াত জাহানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। এমনকি মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *