সারাদেশ

ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বাংলা মায়ের সন্তানদের গৌরব অর্জনের দিন আজ

ডেস্ক রিপোর্ট: মোদের গরব, মোদের আশা। আ-মরি বাংলা ভাষা!’ বাংলার মতো মধুর ভাষা যেন পৃথিবীতে আর নেই। বাংলাভাষার মাধুর্য এবং গুরুত্ব শুধু ১ লক্ষ ৪৮ হাজার বর্গমাইলেই সীমাবদ্ধ নয়।

মুক্ত হওয়ার জন্য অনেক দেশের মানুষ আত্মত্যাগ করলেও, ভাষার জন্য যে কাউকে প্রাণ দিতে হতে পারে তা কারো ধারণাও ছিল না! বিশ্বে প্রথম ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার গৌরব অর্জন করে বাংলা মায়ের সন্তানরা।

আন্দোলনের শুরু হয় ফেব্রুয়ারি মাসেই। কয়েক দফায় আন্দোলন চললেও নিরস্ত্র বাঙালি ছাত্রদের বুকে পুলিশের গুলিতে রাজপথ সিক্ত হয় রক্তে। তাই ১৯৫২ সাল বাঙালিদের জেগে ওঠার সময়কাল। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি গড়ে ওঠে এই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি। ছোট একটি দেশের জাগরণ, স্বাধীনতা অর্জন এবং বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি লাভ করার সূচনা হয় সেইদিন।

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই সম্মান একই সাথে আনন্দের এবং বেদনার। স্মরণীয় এই তারিখটি বাঙালি এবং বাংলার অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। ইতিহাসের সোনালি পাতা উল্টালে দেখা যায়, শহীদের বুকের রক্তে এখনো ভিজে জীবন্ত সেসব স্মৃতি!

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগের পর হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে হিন্দুস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম পাশে স্বাধীন পাকিস্তান স্থাপন করা হয়। সেই সাথেই পাকিস্তানের দু’টি ভিন্ন রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি ৪০ লক্ষ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে পাকিস্তান। তবে বিভাজনের পর থেকেই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বৈষম্য নজরে পড়তে শুরু করে। একই দেশের রাষ্ট্র হলেও সরকার, প্রশাসন, অর্থনীতি, সামরিক- সব দিকেই বাঙালিদের বঞ্চিত করা হতো। সেই বৈষম্যের প্রথম প্রতিবাদ হয় ১৯৫২ সালে।

নতুন সৃষ্ট রাষ্ট্র নিয়ে আশাবাদী ছিল বাঙালিরা। তবে সম্ভাবনাময় স্বপ্নে চকচক করা চোখে যেন হতাশার বালি ছুঁড়ে মারে বৈষম্যবাদী পশ্চিম পাকিস্তানিরা। যা শুরুই হয় ভাষার মাধ্যমে। সমগ্র পাকিস্তানের শতকরা ৫৪ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষার সম্মান দিতে জোর গলায় অস্বীকার করে পাকিস্তানীরা। এমনকি রাষ্ট্রীয় মুদ্রা এবং ডাকটিকিট থেকে বাংলা একেবারে ‍মুছে ফেলার চেষ্টা চলতে থাকে। জোর করে বাঙালিদের ভাষাগত ভাবে পঙ্গু করার কোনোরকম সুযোগ যেন ছাড়া হবে না! এমন সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায় পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের। তাই নতুন গঠিত রাষ্ট্র নিয়ে আশাহত হওয়ার পাশাপাশি, ক্ষোভ জমতে থাকে বাঙালির মনে।

একই দেশের দু’টি রাষ্ট্র হলেও পাকিস্তানের পশ্চিম প্রান্তের আধিপত্য দেখা দেয় শুরু থেকেই। পাকিস্তানের রাজধানী করা হয় করাচিকে। নতুন রাষ্ট্রের জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হয়, শুধুমাত্র উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। বিদ্যালয়, অফিসসহ মিডিয়াতেও শুধুমাত্র একটি ভাষা ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়।

পূর্ব পার্শ্বে এই সিদ্ধান্তের তৎক্ষণাৎ দ্বিমত দেখা যায়। তমুদ্দিন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ঢাকাবাসী র‍্যালিতে নামে করে। বাংলাকেও পাকিস্তানের আরেকটি রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবী চলতে থাকে। তবে পশ্চিম পাকিস্তান ছিল অনড়। তাদের ‘পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন’-এর অনুমোদন করা তালিকায় ছিল না বাংলা ভাষার নাম। ক্ষোভে জ্বলতে থাকা বাঙালিরা সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহন করবেব তারা। ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছাত্ররা আনুষ্ঠানিকভাবে এই দাবী তোলা হয়। একাধারে চলতে থাকে মিছিল ও আন্দোলন।

১৯৪৮ সালে ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন, সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা হবে উর্দু। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদী ওঠে বাঙালিরা। জিন্নাহ’র মৃত্যুর পরও দফায় দফায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা নিয়ে পাকিস্তানের দু’পক্ষে মতোবিরোধ চলতেই থাকে। থেমে থেমে আন্দোলন চালায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বাঙালিরা। যা চলতে থাকে কয়েকবছর।

আগুনে চূড়ান্ত ঘি পড়ে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি। ঢাকায় এক সমাবেশে চূড়ান্ত ঘোষণা করা হয়, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ আবার পুরানো স্লোগান রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ভেসে আসে চতুর্দিকে। ২১ ফেব্রুয়ারি( বাংলায় ১৩৫৮ সনের ৮ ফাল্গুন) এই দাবীতে বাঙালিরা সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ধর্মঘট বাঞ্চাল করতে ১৪৪ ধারা জারিসহ মিটিং-মিছিল রদ করার ঘোষণা দেয়।

সরকারি আদেশ অমান্য করলে যুবক ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়। তাতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার,শফিউর সহ অনেক ছাত্র শহীদ হন। অনেককে গ্রেফতারও করা হয়। স্বাধীন জাতির স্বাধীনতার এই অবমাননায় সকলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে জড়ো হন। ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসহ সাধারণ জনগণও সমাবেত হয়ে শহীদদের প্রতি শোক প্রকাশ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতারাতি মেডিকের কলেঝের পাশে তৈরি করা হয় শহীদ মিনার।

২৬ ফেব্রুয়ারি সেই শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে শহীদদের অবমাননাও করা হয়। কট্টর পন্থী পাকিস্তান বাঙালিদের মাথা তুলে দাঁড়াতে না দেওয়ার জন্য যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চিত্রপট কিছুটা পরিবর্তন হয় ১৯৫৪ সালে। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে বাঙালিরা যেন স্বস্তি ফিরে পায়। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়। সেখানে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষার সম্মান দেওয়া হয়। দীর্ঘ কয়েকবছর আন্দোলন এবং আত্মত্যাগ সফল হলেও বাঙালি অনুধাবন করে তাদের লড়াই মাত্র শুরু হলো। নিজেদের দেশেই তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই, বরং আছে বৈষম্য।

৯০ দশক অবধি ২১শে ফেব্রুয়ারিকে বাংলার শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের পর থেকে এবং বিশ্বব্যাপী নিজ নিজ ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ২৭ থেকে ২৮ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *