আন্তর্জাতিক

গাইবান্ধায় চরের বালুতে মূল্যবান খনিজের খোঁজ!

ডেস্ক রিপোর্ট: গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলের বালুতে মিলেছে মূল্যবান খনিজ সম্পদের খোঁজ। এই নদের বালুতে একটি নয়, দুটি নয়- রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট, গারনেট, ইলমিনাইট ও কোয়ার্টজের মতো মূল্যবান ছয়-ছয়টি খনিজ পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। কেবল নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যৎ সামান্য মূল্যের এই সম্পদ (বালু) এখন রূপান্তরিত হতে চলেছে লাখ-কোটি টাকার সম্পদে।

কেননা, ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলের বালুতে পাওয়া এসব খনিজ উপাদানে হবে চুম্বক, ইস্পাত, সিরিশ কাগজ, প্লাস্টিক, ওয়েলডিং রড, কসমেটিকস, টাইলস, রিফ্যাক্টরিজ ও মেডিসিন (ওষুধ) উৎপাদনে।

এছাড়া এসব ব্যবহৃত হবে অতি গুরত্বপূর্ণ কাজে। যারমধ্যে খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা পরিষ্কার করতে, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গভীর কূপ খননে, লোহাজাতীয় পাইপ পরিষ্কার করতে এবং বালুতে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য ব্যবহৃত হবে এসব খনিজ।

এসব খনিজ কেবল আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইতালি, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সিয়েরালিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন ও ব্রাজিল এই খনিজ উপাদানগুলো সারা বিশ্বে রফতানি করে থাকে।

খনিজ সম্পদ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) গবেষক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্রহ্মপুত্র সংশ্লিষ্ট এলাকার কোন কোন স্থানে কী ধরনের মিনারেলস আছে, তার প্রাথমিক স্টাডি ২০১০ সালে শুরু হয়ে তা সম্পন্ন হয় ২০১২ সালে। এরআগে ব্রহ্মপত্রের কুড়িগ্রামে প্রবেশ স্থান থেকে ডাউনস্ট্রিমে (ভাটির) গাইবান্ধা পর্যন্ত এবং তিস্তা নদীর অববাহিকায় যেসব চর রয়েছে সেগুলো নিয়ে তারা জিওফিজিক্যাল সার্ভে করে। সেটি কার্যকর হলে ২০১৭ সালের একটি প্রকল্পে জয়পুরহাটে একটি খনিজ সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

পরে সেখানে গবেষণার জন্য ব্রহ্মপুত্রের গাইবান্ধার চরাঞ্চলসহ নদের অন্যান্য এলাকার বিভিন্ন বালুচর থেকে দেড় হাজার মেট্রিক টন বালু সংগ্রহ করেন গবেষকরা। এরপর সংগ্রহকৃত বালু খনিজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণ শেষে প্রতি টন বালু থেকে দুই কেজি ইলমিনাইট, দুই’শ গ্রাম রুটাইল, চার’শ গ্রাম জিরকন, ৩.৮ কেজি ম্যাগনেটাইট, ১২ কেজি গারনেট ও ৫০ কেজি কোয়ার্টজ মিনারেল পায় গবেষকরা।

এছাড়াও গবেষকরা বলছেন, নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য প্রতি এক বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে ১০ মিটার গভীর করে উত্তোলনকৃত বালুর সর্বোচ্চ বাজার মূল্য ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা। আর এর সমপরিমাণ এলাকা থেকে পাওয়া ইলমিনাইট, রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট, গারনেট ও কোয়ার্টজ-এই খনিজ সম্পদগুলোর দাম প্রায় পৌনে চার হাজার কোটি টাকা।

চরের বালুতে মূল্যবান খনিজের খোঁজ

গবেষকরা আরও জানাচ্ছেন, ব্রহ্মপুত্রের বালুতে গবেষণায় পাওয়া খনিজ উপাদানগুলোর মধ্যে গারনেট হলো সব থেকে ভারি ও মূল্যবান খনিজ। যা ব্যবহার করা হয় সিরিশ কাগজ উৎপাদন, লোহাজাতীয় পাইপ পরিষ্কার করতে। এছাড়া এটি বালুতে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্যও ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে খনিজটি সারা বিশ্বে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত রফতানি করে থাকে।

এছাড়া রুটাইল ব্যবহার হয় ওষুধ, ওয়েলডিং রড, রঙ, প্লাস্টিক ও কসমেটিকস উৎপাদনে। যা কেবল অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইতালি, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিয়েরা লিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র রফতানি করে থাকে।

ম্যাগনেটাইট চুম্বক ও ইস্পাত উৎপাদন ব্যবহার হয়, এছাড়া খনি থেকে উত্তোলনকৃত কয়লা পরিষ্কার করতে এবং তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গভীর কূপ খননে ব্যবহার হয়ে থাকে এই খনিজ। যা দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া সারা বিশ্বে রফতানি করে। আর জিরকন সিরামিক, টাইলস উৎপাদনে ব্যবহার হয়। এই খনিজ উপাদানটি সারা বিশ্বে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, চীন, ব্রাজিল, সিয়েরা লিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র রফতানি করে।

খনিজ সম্পদ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান জয়পুরহাটের ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি অ্যান্ড মেটালার্জির পরিচালক ড. মোহাম্মদ নাজিম জামান বলেন, আমরা প্রথমে জিওফিজিক্যাল সার্ভে করি ব্রহ্মপুত্রের কুড়িগ্রামের প্রবেশদ্বার থেকে নিম্নধারায় গাইবান্ধা পর্যন্ত এবং তিস্তা নদীর অববাহিকার চরাঞ্চলগুলোতে। এরপর এই দুই জেলার বিভিন্ন বালুচর থেকে এক হাজার ৫০০ মেট্রিক টন বালু সংগ্রহ করি। সংগ্রহকৃত বালু বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণ শেষে প্রতি টন বালু থেকে দুই কেজি ইলমিনাইট, দুই’শ গ্রাম রুটাইল, চার’শ গ্রাম জিরকন, ৩.৮ কেজি ম্যাগনেটাইট, ১২ কেজি গারনেট ও ৫০ কেজি কোয়ার্টজ মিনারেল পাই আমরা।

তিনি জানান, নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য প্রতি এক বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে ১০ মিটার গভীর করে উত্তোলনকৃত বালুর বাজারমূল্য ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা। আর এর সমপরিমাণ এলাকা থেকে পাওয়া ইলমিনাইট, রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট, গারনেট ও কোয়ার্টজ-এই খনিজ সম্পদগুলোর দাম ৩ হাজার ৬৩০ কোটি অর্থাৎ প্রায় পৌনে চার হাজার কোটি টাকা।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্রহ্মপুত্রের কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার এসব এলাকার বালুতে আরও খনিজ শনাক্তের কাজ করছি আমরা। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এসব খনিজ আহরণের বিষয়ে খুব শিগগিরই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল বার্তা২৪.কমকে বলেন, এসব খনিজ সম্পদ গাইবান্ধা তথা দেশের সম্পদ। গাইবান্ধায় এসব খনিজ আহরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যদি প্রয়োজন হয় তাহলে সকল ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এছাড়া যদি কোনো নির্দেশনা আসে তাও দ্রুত এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।

হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের কাছে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হওয়া ব্রহ্মপুত্রের নাম ভারতে গঙ্গা। নদটি ভারতের আসামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ব্রহ্মপুত্র নাম নিয়ে। আর গাইবান্ধার সদর ও ফুলছড়িতে ব্রহ্মপুত্র এবং সাঘাটায় এর নাম ধারণ করেছে যমুনা। প্রতিবছরের বর্ষায় পানিতে থৈ থৈ করে এ নদ। ভাঙে ভিটে-মাটি। আর শুকনা মৌসুমে হয় ধু-ধু বালুচর। এ সময়ে এর বুকচিরে খনন করে উত্তোলিত বালু সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ কাজে ব্যবহার হয় যৎ সামান্য মূল্যে। ব্রহ্মপুত্রের সামান্য মূল্যের এই বালুই এখন যেন পরিণত হতে চলেছে হীরের টুকরোয়।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *