সারাদেশ

আত্মপ্রকাশের দ্বারপ্রান্তে ষষ্ঠতম জাতীয় পার্টি

ডেস্ক রিপোর্ট: জাতীয় পার্টি নামে ৫টি দল রাজনীতির মাঠে সক্রিয় রয়েছে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ষষ্ঠতম জাতীয় পার্টির জন্ম হতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫টি টুকরো রাজনীতির মাঠে বিচরণ করছে। ৯ মার্চ কাউন্সিলের মাধ্যমে আরও একটি জাতীয় পার্টি গঠন এখন সময় ব্যাপার বলা যেতে পারে।

জাপা প্রথম ভাঙ্গনের শিকার হয় ১৯৯৯ সালে। ওই সময় কারাবন্দি এরশাদের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন সংসদ সদস্য ও সিনিয়র কয়েকজন নেতা। মিজানুর রহমান চৌধুরী-আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নেতৃত্বে গঠন করা হয় পৃথক জাতীয় পার্টি (মিম)। ওই ভাঙ্গনটি ছিলো সবচেয়ে বড় ভাঙ্গন। তখন অল্পের জন্য সংসদীয় নেতার পদ রক্ষা করতে সক্ষম হন কারাবন্দি এরশাদ। পরে দলীয় প্রতীক লাঙল নিয়ে টানা হেচড়া করেন জাতীয় পার্টি (মিম)। শেষ পর‌্যন্ত কোর্টে গড়ায় বিষয়টি। তখন কোর্টে এরশাদের পক্ষে লড়েছিলেন সহধর্মীনী রওশন এরশাদ। জাপার ওই অংশটি এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরীক। নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পার্টি জেপি নামে নিবন্ধিত অংশটির প্রতীক বাইসাইকেল।

২০০০ সালে জাতীয় পার্টি তখন বিএনপি জোটের দিকে ঝুঁকেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের পুর্বে হঠাৎ ইউটার্ণ নিলে তৎকালীন মহাসচিব প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জু ও কাজী ফিরোজ রশীদের নেতৃত্বে আরেকবার ভাঙ্গনের মুখে পড়ে জাপা। এবার সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (নাফি) বিজেপি। যেই দলটি এখনও জাতীয় পার্টি বিজেপি নামে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে রয়ে গেছে। এই অংশটিও ইসিতে নিবন্ধিত তাদের দলীয় প্রতীক দেওয়া হয়েছে গরুরগাড়ি।

বিজেপি ভেঙে আরেকটি দল হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নামে। এই অংশটিও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। কাঁঠাল প্রতীক পাওয়া ওই অংশটির ইসির নিবন্ধন নম্বর ০২৮।

সর্বশেষ ভাঙ্গনের শিকার হয় ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর। সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদ’র হাত ধরে। তখনও বেশ কিছু প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ বের হয়ে গিয়ে নতুন জাতীয় পার্টি (জাফর) সৃষ্টি করেন। এই অংশটিও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে সক্রিয় রয়েছে।

ভাঙ্গা গড়ার খেলায় পার্টি অনেকটাই নেতৃত্বে শূন্য বলা যেতে পারে। ঝানু রাজনীতিবিদ বলতে যা বুঝায় এমন নেতার সংখ্যা সংখ্যা হাতে গোনা। যে কারণে মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন দল থেকে হায়ার করে জেলা কিংবা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেমন হঠাৎ করেই যোগদান করা এক নেতাকে খুলনা মহানগরের আহ্বায়ক করা হয়। আবার ইদানিংকালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের কয়েকটি নির্বাচনে নেতা হায়ার করতে দেখা গেছে।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাপার মাঠ পর্যায়ে অনেক জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু সেই সমর্থনকে কাজে লাগানোর মতো নেতার সংকট প্রকট। আবার যারাও রয়েছেন তারাও ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতীয় পার্টি এরশাদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। দু’একবার যারাই এরশাদের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করতে গেছেন তাদেরকেই দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক নেতা একাধিক দফায় শোকজ ও সাময়িক বহিস্কারের শিকার হয়েছেন। শো’কজের ক্ষেত্রে এরশাদ ছাড় দেননি আপন ভাই জিএম কাদের ও স্ত্রী রওশন এরশাদকেও।

এরশাদের মৃত্যূর পর থেকেই নানা রকম টানাপোড়েনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে দেবর-ভাবির (জিএম কাদের ও রওশন এরশাদ) সম্পর্ক। এরশাদের মৃত্যূতে শুন্য হওয়া বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে প্রথম বিরোধ দেখা দেয়। দেবর ও ভাবি পৃথকভাবে নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য স্পিকারকে চিঠি দেন বিগত সংসদে। শেষ পর্যন্ত রওশন এরশাদকে বহাল করেন স্পিকার। আরও কতগুলো ইস্যুতে তাদের মধ্যে টানাপোড়েন ছিল।

কিন্ত গত সংসদ নির্বাচনে রওশন এরশাদ এবং তার সন্তানকে পার্টি থেকে মনোনয়ন না দেওয়া অম্লমধুর সম্পর্ক এখন সাপে-নেউলে রূপান্তরিত হয়েছে।

গত ২৮ জানুয়ারি রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে তাদের পদ থেকে অব্যাহতি দেন। একইসঙ্গে নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। রওশন দাবী করেছেন তৃণমূল ও কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুরোধে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। দলটির সর্বশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে না পারায় ইসির কাছে একাধিক দফায় সময় চেয়ে নিয়েছিল জাপা। সেই সময়ও গত হয়েছে কয়েক মাস আগেই, কিন্তু কাউন্সিল করতে পারেনি জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদলের চেয়ারে থাকা দলটি। আর এই সুযোগটি কাজে লাগাতে চাচ্ছেন রওশন এরশাদ। হঠাৎ করেই একতরফাভাবে জাতীয় পার্টির কাউন্সিল ডেকেছেন। এরপর বর্ধিতসভাসহ নানান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে রওশন এরশাদকে সামনে রেখে। রওশন এরশাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া সিনিয়র বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে ইতিমধ্যেই বহিস্কার করা করেছেন জিএম কাদের।

রওশনপন্থীরা শুধু পার্টির চেয়ারম্যান এবং মহাসচিবকে মানতে চাইছেন না। আর অন্যান্য সকল কমিটিকে তাদের কমিটি বলে দাবী করে আসছেন। তারা বলতে চাইছেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ সকল জেলা-উপজেলা কমিটি তাদের সঙ্গে রয়েছে। তারা কাউন্সিলের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু কাউন্সিলকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। তিনি বলেছেন, রওশন এরশাদ পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদে রয়েছেন, পদটি অলঙ্কারিক। তার কাউন্সিল ডাকার কোন এখতিয়ার নেই। আর তার সঙ্গে জাতীয় পার্টির কোন নেতাকর্মী নেই। তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা কেনো নেওয়া হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছেন তার সঙ্গে জাতীয় পার্টির সম্পর্ক স্পর্শকাতর।

কাউন্সিল নিয়ে জিএম কাদের পন্থীদের যে অস্বস্তি কাজ করছে তা তাদের কার্যক্রম দেখলে বোঝা যায়। পার্টির একটি খবর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর নির্দেশনা এবং আহ্বান ছাড়া অন্যকোন ব্যক্তিবর্গের আহ্বানে এবং জাতীয় পার্টির নাম ব্যবহার করে ঢাকায় বা অন্য কোন স্থানে আয়োজন করা কোন সম্মেলন, সভা, সমাবেশে কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ না করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ওই চিঠি কেন্দ্রীয় কমিটি, সকল জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন কমিটিকে দেওয়া হয়েছে।

রওশন পন্থীরা কাউন্সিল করেই ক্ষ্যান্ত দিচ্ছেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। তারা এরপর পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখলের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। আবার লাঙ্গল প্রতীকও তাদের চাই, ইতোমধ্যে ইসিতে চিঠি দিয়েছেন। আবার কাউন্সিলের পর তৎপর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রয়োজন হলে কোর্টে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *