বিনোদন

ভালোবেসে দূরে থাকা এক কবি

ডেস্ক রিপোর্টঃ আমাদের যৌবনে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতা ও সাহিত্যের ঘোরাক্রান্ত দিনগুলোতে, আশি দশকের পরিসরে ইকবাল আজিজ তুমুল মগ্ন ছিলেন কবিতায়। আমাদের হাতে ছিল তার কাব্যগ্রন্থ: ‘প্রতীকের হাত ধরে অনেক প্রতীক’ (১৯৮৭), ‘ভালোবেসে দূরে আছি‘ (১৯৯৮)। কয়েক বছর পর প্রকাশিত হয় ইকবাল আজিজের ‘প্রেমের কবিতা’ (১৯৯০), ‘একটি স্বপ্নের কথা‘ (১৯৯৩), ‘নির্বাচিত কবিতা‘। (২০০৭)। সত্তর দশকের কবিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অনেক পরে ঢাকায় আসা একজন। অথচ অনেক বেশি স্পর্শ করেছিলেন তিনি সমকাল ও পরবর্তী প্রজন্মকে।

১৯৫৫ সালে ইকবাল আজিজের জন্ম মাতুলালয় নাটোরে । পৈতৃক নিবাস কুষ্টিয়া । শৈশবের প্রথম তিনটি বছর কেটেছে পুরনো ঢাকার জগন্নাথ সাহা রোডে । শৈশবের বাকি সময়, কৈশোর ও যৌবন কেটেছে নাটোর, ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়ায় । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও এমএ। ছিলেন সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক যোদ্ধা।

আশি দশকে ঢাকায় আসেন ইকবাল আজিজ। মগ্ন হন লেখালেখি ও সাংবাদিকতায়। তার উল্লেখযোগ্য কর্মকাল কেটেছে ‘পাক্ষিক শৈলী‘তে, সম্পাদক-কবি কায়সুল হকের সহযোগী রূপে। কারওয়ান বাজার-সোনার গাঁ ক্রসিং-এর পূর্ব কোণের সেই অফিসে তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ও নৈকট্য। কবিতা, সাহিত্য, দর্শন নিয়ে অনেক আলাপের স্মৃতি।

কথাবার্তা ও ভঙ্গিতে তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে আলাদা। কোলাহল এড়িয়ে চলা মানুষ। খানিকটা নিভৃতিপ্রিয়। কিছুটা আত্মমগ্ন। তার যাপন ও কবিতার মধ্যে দূরত্ব ছিল সামান্যই। আর ছিল জাগতিক লোভ ও প্রাপ্তির বিষয়ে তীব্র উদাসীনতা।

এইসব অভিব্যক্তির ইকবাল আজিজ আমার অনুভবের গভীরে একটি স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন। শনিবার (৯ মার্চ) সকালে তার মৃত্যুর খবর পেলাম। সামাজিকমাধ্যমে তার ছেলে ইশরাক ইজাজ বাবার ফেসবুক আইডি থেকে লেখেন, ‘গভীর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানাচ্ছি যে, আমার বাবা সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চলে গেছেন। আমার পরিবারকে আপনারা দোয়ায় রাখবেন। শান্তিতে ঘুমাও বাবা।‘

লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন কবি ইকবাল আজিজ। অসুস্থতার দিনগুলোতে কাউকে কিছুই জানান নি। ছিলেন নিজের একাকীত্বের পরিসরে। প্রচণ্ড আত্মপ্রচার ও প্রাপ্তির প্রতিযোগিতার পরিবেশ থেকে সযত্নে গুটিয়ে নিয়ে ছিলেন নিজেকে। তার অসুস্থতা, সংকটাপন্ন অবস্থা, চেপে রেখেছিলেন বুকে। যে শহরে অভিমানে হারিয়ে যায় প্রকৃত কবি আর উদ্বাহু নৃত্য করে দরবারি-কবিদল, সেখানে দগ্ধ ও বিদ্ধ হওয়া ছাড়া একজন শুদ্ধ কবির নিয়তিতে আর কিছুই থাকে না।

কবিতা ছাড়াও ইকবাল আজিজের উপন্যাস ‘এক অমানুষের ছায়া‘। গল্পগ্রন্থ : ‘পানশালার সেই সবুজ ফেরেশতা‘। তার প্রিয় বিষয় ছিল পরিবেশ ও নগর । শখ ছিল বইপড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা ও দেশ ভ্রমণ। ভালোবেসে কাছে আসার মতো দূরেও যে থাকা যায়, কবি ইকবাল আজিজ জীবনের শেষদিনগুলোর প্রলম্বিত দূরত্বে সেই চিহ্ন রেখে গেছেন। নাটোর, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, রাজশাহীর মতিহার বা ঢাকায় তার সঙ্গে আর কারো দেখা হবে না কোনো দিন। চিরদূরের ঠিকানায় চিরস্থায়ী হয়ে তিনি মুছে দিয়েছেন সকল নৈকট্য। মানুষ, প্রকৃতি ও কবিতার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ স্মৃতিগুলো ধূসর ছায়ায় ঘিরে রাখবে তাকে। তখন তার কবিতার বিষন্ন পদাবলীতে হয়তো তিনি গুঞ্জরিত হবেন অন্য প্রজন্মের অন্য কোনো কণ্ঠস্বরে:

নদীর দুঃখ নদীই জানে ভালো –
আমি কিছুই জানি না তার ব্যথা
আমার বুকে হাজার কথা বাজে
আমার বুকে প্রাণের আকুলতা।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪ এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *