সারাদেশ

বাংলাদেশ কী একটি অনুদার সমাজে রূপান্তরিত হচ্ছে?

ডেস্ক রিপোর্ট: কালের বিবর্তনে কেবল ঈদই বদলে যায় নি। বদলেছে সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি, পরিবেশ-প্রকৃতি, সামষ্টিক জীবনাচার হতে সমস্তই। একমাত্র ব্যতিক্রম রাষ্ট্র, শাসন ব্যবস্থা, শাসক চরিত্র। সেটি উপনিবেশিক আমলের ধারাবাহিকতায় আজও অনড় অবস্থানে। আমাদের সমাজজীবনে ঈদের এই বদলে যাওয়ার পেছনে সঙ্গত কারণ অবশ্যই রয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার চরম প্রভাবে সামষ্টিক চেতনা-দৃষ্টিভঙ্গি বিলুপ্তির পথ ধরেই ঈদের এই বদলে যাওয়া। আমাদের সমাজ-জীবনে ধর্মীয় এবং জাতিগত উৎসব-পার্বণসমূহও আর পূর্বের ন্যায় নেই। কালের পরিক্রমায় সেগুলোর আচার-আনুষ্ঠানিকতাও বদলে গেছে। অতীতে দেখা ঈদের সঙ্গে এখনকার ঈদের বিস্তর ব্যবধান। একশত আশি ডিগ্রি বৈপরীত্য বললেও ভুল হবে না। ঈদের সামাজিকতার যে চিরচেনা ছবিটি আমাদের মনোজগতে স্থায়ীরূপে ছিল, বর্তমানের ঈদের সঙ্গে তা মেলানো যায় না। অতীতের ঈদের স্মৃতিকাতরতায় সংক্ষিপ্তভাবে তার চিত্র তুলে ধরবো। অনেকের কাছে এখনকার বাস্তবতায় সেটা রূপকথার ন্যায় মনে হতে পারে।

ঈদ উৎসবের প্রধান উপাদানটি সামাজিকতা। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পারস্পরিক সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যরে নির্মল প্রতীক। ঈদকে কেন্দ্র করে নজরকাড়া বৈষম্য আমরা এখন প্রবলভাবে প্রত্যক্ষ করি। অতিমাত্রায় ভোগ-বিলাসে মত্ত হবার প্রবণতাও দেখে থাকি; অতীতেও ছিল, তবে এরূপ মাত্রাতিরিক্ত ছিল না। ঈদের আনন্দ সবাই মিলে ভাগ-বাঁটোয়ারায় পালনের সংস্কৃতি ছিল। সেটি কালের গর্ভে এখন বিলীন হয়েছে। একটি শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শ্রেণিগত ব্যবধান-বৈষম্য অতীতেও ছিল। কিন্তু এত অধিক মাত্রায় প্রকটভাবে ছিল না। আমরা ক্রমেই যে ব্যবস্থার অধীন হয়ে পড়েছি, সেটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। এখানে পুঁজিই সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রকের চালিকা শক্তিরূপে রাষ্ট্রে-সমাজে, এমন কি পরিবারের অভ্যন্তরে পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। মানুষে মানুষে যে সহজাত সম্প্রীতির বন্ধনগুলো ছিল সেগুলো ছিন্ন এবং লুপ্ত হবার পথ ধরেছে। অথচ ঈদ উৎসবের প্রধান উপাদানটি সম্প্রীতির নির্মল সামাজিকতা। অতীত আর বর্তমানের ঈদের প্রধান পার্থক্য এখানেই। অতীতে সমষ্টিগতভাবে উৎসব পালনের রীতি-রেওয়াজ ছিল।

পারিবারিক এবং সামাজিক বাধ্যবাধকতাও এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতো। এখন সেসবের বালাই নেই। এখন প্রত্যেকে যার-যার, তার-তার। অর্থাৎ ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার অদৃশ্য জালে সামাজিক চেতনা আটকে পড়েছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সেই জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার উপায়-সম্ভাবনা নেই। এই জাল অর্থাৎ মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা পুঁজিবাদের মৌলিক দর্শনের অন্তর্গত। ব্যবস্থা না পাল্টানো অবধি ঐ জালে আমরা আরো বেশি জড়িয়ে পড়বো। পরষ্পর পরষ্পর থেকে আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো। তাই সর্বাগ্রে জরুরি ব্যবস্থার পরিবর্তন। সেটা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের জীবনে সমষ্টিগত বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটবে না। বরং উত্তরোত্তর সেটা বৃদ্ধি পাবে।

পূর্বেকার ঈদ কেমন ছিল? সেকালের ঈদের প্রধান উপাদানটিই ছিল সামষ্টিক সামাজিকতা। ঈদ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ঈদে ধর্মীয় আচার বলতে দুই রাকাত ওয়াজেব নামাজ আদায় ব্যতীত আর কোনো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নেই। ওয়াজেব নামাজ ফরজ নয়। ফরজ আদায়ের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা থাকে। ওয়াজেব-এর ক্ষেত্রে সেটি নেই। সকল সম্প্রদায়েরই ধর্মীয় উৎসব-পার্বণ রয়েছে। সে সকল উৎসবসমূহে ধর্মীয় আচারের তুলনায় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতাই সর্বাধিক। উৎসবসমূহকে সম্প্রদায়গত সীমা অনায়াসে অতিক্রম করার বিস্তর সুযোগ রয়েছে। আমাদের ভূখ-ে এক সময়ে ধর্মীয় উৎসবে অন্য সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের অজস্র নজির ছিল। ঈদ, পূজা, বড়দিনে বন্ধু, প্রতিবেশী হতে সামাজিক সম্পর্ক-সম্প্রীতিতে একে-অন্যের ধর্মীয় উৎসবে আমন্ত্রিত হত। যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছা বিনিময় করতো। সম্প্রদায়গত ভিন্নতার পরও পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সামাজিকতার সংস্কৃতি ছিল। রক্তাক্ত দেশভাগে সেই সম্পর্কের বিনাশ ঘটে। আজাদ পাকিস্তানে ধর্মীয় জাতীয়তার চরম মাশুলের মুখে আবার জাগরণ ঘটে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার। সেই সুবাধে জাতিগত ঐক্য-সংহতির দুয়ার উন্মুক্ত হয়।

পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙ্গে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর এই বাংলাদেশে আবার সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দেবে; সেটা ছিল কল্পনার অতীত। সামরিক শাসকদের বদৌলতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দুয়ার উন্মোচনের পথ ধরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাড়-বাড়ন্ত বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভবিতব্য এই যে, বেসামরিক তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটেনি। ভোটের রাজনীতির নিয়ামক শক্তিরূপে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সুরক্ষা ও বিকাশে যুক্ত দেশের এযাবৎ কালের প্রতিটি ক্ষমতাসীন সরকার। তুলনা বিচারে কম-বেশি হতে পারে কিন্তু ঐ ঘৃণিত পথটি কেউ পরিহার করে নি। উন্মুক্ত রেখেছে স্বীয় স্বার্থে।

কৈশোরে দেখেছি মাসব্যাপী রোজার শেষে ঈদের চাঁদ দেখতে মানুষ বাড়ির ছাদে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ভীড় করতো। চাঁদ দেখামাত্র শুরু হয়ে যেত আনন্দের উল্লাস প্রকাশ। পটকা, বাজি ফুটিয়ে আগত ঈদের আনন্দ প্রকাশ করা ছিল গতানুগতিক। মসজিদে-মসজিদে সাইরেন বাজিয়ে আগামীকালের ঈদের সংবাদ প্রচার করত। মসজিদ সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি অলিতে-গলিতে ঢুকে ঈদের নামাজের সময়সূচী চিৎকার করে বলে যেত। রেডিও-তে বেজে উঠতো কাজী নজরুল ইসলামের গান-রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদসহ বিভিন্ন ঈদকেন্দ্রিক গান। আজকে যেটা পুরান ঢাকা নামে খ্যাত। ঢাকা বলতে তখন ছিল এই পুরান ঢাকা’ই। নতুন ঢাকার গোড়াপত্তন শুরু হয়েছে। তবে তেমন জনবহুল হয়ে ওঠেনি। এই পুরান ঢাকার ঈদের সামাজিকতা একমাত্র গ্রামের সামাজিকতার সঙ্গেই তুলনা চলে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের দুঃখে-সুখে নিকট আত্মীয়ের ন্যায় সংলগ্ন হবার সামাজিক সংস্কৃতি ছিল। যেটি এখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায় নি। তবে স্বীকার করতে হবে কমেছে।

ঈদের আগের দিনকে চাঁনরাত বলার রেওয়াজ ছিল। চাঁনরাতে পুরান ঢাকার যুবকেরা মাসব্যাপী রোজার সংযমের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মদ্যপানে মাতলামিতে মত্ত হত। তাদের মাতলামিতে রাস্তা-সড়কে, বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী সিঁড়ি ঘাটের পরিবেশ ভয়ঙ্কর হত। রাতে তারা এদিক-সেদিক পড়ে থাকতো। কাকভোরে বাড়ি ফিরে গা-গোসল করে নতুন জামা-কাপড় গায়ে চড়িয়ে ঈদের নামাজে শামিল হত। মেয়েরা মেহেদী লাগাতো গভীর রাত অবধি। কম-বেশি প্রায় সকলের বাড়িতে মেহেদী গাছ ছিল। বাজার থেকে মেহেদী কিনে পাটায় বেঁটে মেহেদী লাগানোর সংখ্যা ছিল খুবই স্বল্প। ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যেতো ঈদের বিশেষ রান্নার আয়োজন। এখনকার ন্যায় তিন-চার দফায় ঈদের জামাতের নজির ছিল না। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার আধিক্য তখন ঘটেনি। একবারই ঈদের নামাজ হত মসজিদে।

নামাজ শেষে গণকোলাকুলি-শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে বাড়ি ফিরতে দীর্ঘক্ষণ অতিবাহিত হত। সবার সঙ্গে সবার আত্যন্তিক যোগসূত্রতা ছিল। ঈদের দিনে সেটা রক্ষা না করা ছিল অপরাধতুল্য। আমরা যারা কিশোর বয়সী ছিলাম। আমরাও পাড়া-মহল্লার সহপাঠিদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে অনেক সময় পরে বাড়ি ফিরতাম। গুরুজনদের সালাম করে সেলামি না পাওয়া পর্যন্ত নড়তাম না। বাড়ির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ছুটতাম আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশীদের বাড়ির অভিমুখে। সালাম করা এবং সেলামি আদায়ই ছিল মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি ছিল সামাজিকতার দায়ভার। কারো বাড়িতে ঈদের দিন না গেলে তীব্র কটু কথা শুনতে হত। সবার বাড়িতে সবার যাওয়ার সামাজিক রেওয়াজ পালন করা ছিল বাধ্যবাধকতার অন্তর্গত।

সড়কের পাশে হরেক খাবারের দোকানে নানা পদের আকর্ষণীয় খাবার কিনে খাওয়ার প্রবণতা কিশোরদের মধ্যে দেখা যেত। সেলামির কাঁচা পয়সা ঝনঝন করতো সবার পকেটে। চারআনা-আটআনায় তখন প্রচুর চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল। সহপাঠি বন্ধুরা এমন কি হিন্দু সম্প্রদায়ের বন্ধুরা পর্যন্ত দল বেঁধে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে চকবাজারের ঈদের মেলা দেখা, মেলার সামগ্রী কেনা, দূরে বসবাসরত আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে যাওয়া-সেলামি সংগ্রহ এসব ছিল ঈদের দিনের গতানুগতিক বিষয়। দলভুক্তদের যে-কোন একজনের আত্মীয় বাড়িতে গেলে সবাই সমান সমাদর-সেলামি পেতাম। খাবারের জন্য জোর তাগিদ উপেক্ষা করতাম সময় ক্ষেপণের ভয়ে। দিনটি গত হলে তো সব সুযোগই হাতছাড়া হয়ে যাবে।

সব আত্মীয়দের বাড়িতে যাবার আনুষ্ঠানিকতায় বহুক্ষণ পেরিয়ে যাবে, সেই শঙ্কায় সালাম শেষে সেলামি নিয়েই এক প্রকার ছুটে অপেক্ষমান ঘোড়ার গাড়িতে উঠে পড়তাম। বিকেলের দিকে বর্তমানের সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে ঢাকার চিড়িয়াখানায় যেতাম। বর্তমানে যেখানে জাতীয় ঈদগা সেখানে ছিল ঢাকার চিড়িয়াখানা। সন্ধ্যে নাগাদ বাড়ি ফিরে আসতাম। পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্র চালু হবার পর স্থানীয় অনেকের বাড়িতে টিভি ছিল, তাদের বাড়িতে টিভি দেখতে যেত সবাই। উঠানে টেবিলে এনে টিভি বসিয়ে সবার জন্য টিভি দেখার ব্যবস্থা করত। ছোটরা মাদুরে এবং বড়রা চেয়ারে বসে অনেক রাত অবধি একত্রে টিভির অনুষ্ঠান দেখতো সবাই।

স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েরা দল বেঁধে পাড়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করত। বান্ধবীদের সবার বাড়িতে সবাই যাওয়া-আসা করতো। অতিথি আপ্যায়নের জন্য সেমাই-পায়েস ইত্যাদি মিষ্টি জাতীয় খাবার ঘরে-ঘরে তৈরি করা থাকতো। কেনা সেমাইর প্রচলন ছিল না। হাতে ঘুরানো কলে ঈদের আগে বাড়িতে-বাড়িতে সেমাই তৈরি করতো। রোদে শুকিয়ে হালকা আঁচে ভেজে তুলে রাখতো ঈদের অপেক্ষায়। সবার বাড়িতে অভিন্ন প্রচলন। মহিলারাও বিকেলে আত্মীয়-প্রতিবেশীদের বাড়িতে শুভেচ্ছা বিনিময়ে যাওয়া-আসা করত। প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়িতে ঈদের দিন যাওয়া ছিল ঈদের অনিবার্য সামাজিকতা।

ঈদে কে কত দামি জামা কিনেছে সেসব নিয়ে তেমন কারো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল না। নতুন জামা-জুতা হলেই বর্তে যেতাম। বাহারি চটকদার পোশাকেরও তেমন প্রচলন ছিল না। ব্যতিক্রম যে ছিল না, তা নয়। তবে সংখ্যায় অতি নগণ্য। স্থানীয় যুবকদের ঈদের আনন্দ ছিল ভিন্নতর। সড়কে-বুড়িগঙ্গার পাকা সিঁড়ি ঘাটে মাইক বাজিয়ে আনন্দ করতো। সিঁড়ি ঘাটে যত্রতত্র তাস খেলতো। দল বেঁধে রূপমহল, তাজমহল, মুকুল (আজাদ), মানসী (নিশাত), শাবিস্তান, লায়ন, স্টার, মুন বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ছুটতো ঈদে মুক্তি পাওয়া লাহোরে নির্মিত উর্দু ছবি দেখতে। স্থানীয় যুবকদের নিকট সাবিহা-সন্তোষ, মোহাম্মদ আলী-জেবা,ওয়াহিদ মুরাদ-রানী প্রমুখ পাকিস্তানি তারকারা ছিল জনপ্রিয়। এসবের বাইরেও তাদের পরস্পরের ঈদের সামাজিকতা ছিল। দূর-দূরান্তের বন্ধুরা ছুটে আসতো। আবার এখান থেকেও অনেকে দলবদ্ধভাবে যেত বন্ধুদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে।

ঈদের দিন উৎসব মুখর আনন্দ সর্বত্র বিরাজ করতো। হরেক প্রকারের আনন্দে মেতে থাকতো সবাই। ছাদে কিংবা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঘুড়ি উড়ানোও ছিল ঈদের আনন্দের অংশ। বিভিন্ন রঙের ঘুড়িতে আকাশ ছেয়ে যেত। সম্প্রদায়গত ভিন্নতা এদিনে ম্লান হয়ে যেত। অনেক হিন্দু বন্ধুরাও আমাদের দলভুক্ত হয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতো। ঈদে ধর্মীয় আবেদনের চেয়ে সামাজিক আবেদন অধিক। পাকিস্তানি রাষ্ট্রে তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ক্রমেই বিকশিত হচ্ছিল। সে কারণে ধর্মীয় জাতীয়তা বাঙালিরা প্রায় পরিত্যাগে দ্বিধাহীন হয়ে উঠেছিল। এসকল কারণে ঈদ উৎসবে অসাম্প্রদায়িকতা বিকাশ লাভ করছিল। স্থানীয় যুবকদের নিকট যেমন লাহোরের ছবি জনপ্রিয় ছিল। পাশাপাশি তরুণ ও মাঝ বয়সী নারী-পুরুষদের নিকট ঢাকায় নির্মিত বাংলা ছবি অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে পরিবারসহ বাংলা ছবি দেখার প্রবণতায় বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখার মধ্যেও এক ধরনের সামষ্টিক সামাজিকতা ছিল। যেটি এখন আর পাওয়া সম্ভব নয়।

একালের ঈদ মানেই বিলাস এবং ভোগবাদিতায় পূর্ণ। কে-কত মূল্যের কতটা এবং কোন বিখ্যাত শপিং মল থেকে ঈদের পোশাক কিনেছে, এনিয়ে গর্বে মশগুল থাকা। আর ঈদে সামষ্টিক সামাজিকতা বলে এখন আর অবশিষ্ট কিছু নেই। সময়টা এখন যার-যার, তার-তার বলেই সঙ্গত কারণে সবাই ঘরে ঘরে অনেকটা বন্দীদশায় ঈদ পালন করে। একের পর এক পোশাক বদল করে, নিজের পোশাক নিজেই দেখে। অন্য কেউ দেখে প্রশংসা করলে নিশ্চয় গর্বিত ও খুশির সুযোগ হত। কিন্তু কার পোশাক কে দেখে। যার যারটা নিয়ে সবাই ব্যস্ত। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে এখন আর কেউ যাওয়া-আসা করে না। বড় জোর মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠিয়ে সেই দায় থেকে পরিত্রাণ নেয়। মোবাইল-ফেইসবুক নামক প্রযুক্তির আগমনে দৈহিক যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। অপর দিকে প্রযুক্তিগত বার্তা বিনিময়কে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম রূপে প্রচারণা করা হয়ে থাকে। বিষয়টি হাস্যকর রূপেই বিবেচনা করা যায়।

ঈদের নামাজ এখন মসজিদে-ঈদগাগুলোতে তিন-চার দফায় আদায় হয়ে থাকে। সকল টিভি মিডিয়াতে দেশব্যাপী ঈদের কয়েক দফা নামাজের সময়সূচী ও স্থানসমূহের নাম ঘন ঘন সম্প্রচারিত হয়। ঈদের দিন বেশিরভাগ মানুষই ঘরে বসে-টিভি দেখে ঈদ পালন করে। নিকট আত্মীয়দের বাড়িতে পর্যন্ত অনেকের যাওয়া-আসা নেই। একান্ত পারিবারিক সীমায় প্রায় প্রত্যেকে সীমাবদ্ধ। একই ভবনের পাশাপাশি ফ্ল্যাটে বসবাস অথচ কারো সাথে কারো সম্পর্ক-যোগাযোগ কিছুই নেই। অপরিচিতমাত্রই অবাঞ্ছিত বলে জ্ঞান করে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতার এই যুগে সামষ্টিক সামাজিকতার দৃশ্যমান কিছু নেই। ঈদকে কেন্দ্র করে সুপার মলগুলোতে যেরূপ রমরমা বেচা-বিক্রি, জনসমাগম ঘটে, ঈদের দিন তার প্রতিফলন আমরা দেখি না। বোকা বাক্স নামক টিভি মানুষকে গৃহে আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে; মানুষ স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্নতাকে বরণ করার কারণেই।

ঈদে গ্রামে যাওয়া মানুষের পরিমাণ কিন্তু কম নয়। বাস, ট্রেন, লঞ্চে চেপে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রচুর মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটে যায়। সেটা ঐ সামষ্টিক সামাজিকতার টানে। গ্রামে এখনও সামাজিকতা বিলীন হয়ে যায়নি। ঈদে গ্রামে যাওয়া মানুষের সিংহভাগই হচ্ছে স্বল্প আয়ের নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি ক্ষুদ্র অংশও ঈদে গ্রামে যায়। আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপনে। তবে সংখ্যায় স্বল্পই বলা যাবে। বিত্তবান শ্রেণি আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে এমন কি দেশত্যাগে বিদেশে পর্যন্ত ঈদ উদ্যাপন করে। আমাদের বিত্তবান শ্রেণির মধ্যে এধরনের প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। অনেকে ঈদের কেনাকাটার জন্য ছুটে যায় বিদেশে।

লাগেজ বোঝাই করে ঈদের বাজার নিয়ে দেশে ফিরে আসে এবং গর্বে-গৌরবে সে কথা প্রচার করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। ঈদে বৈষম্য পূর্বেও ছিল। আজও আছে। তবে মাত্রাটা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একে অপরের বাড়িতে ঈদ উপলক্ষে যাওয়া আসায় প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ির খাবারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পেতো। এখন সেটা তিরোহিত। সবার বাড়ির রান্না করা ঈদের খাবারও এক নয়, ভিন্নতর। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির শ্রেণিগত অবস্থানের ওপর। শ্রেণি পার্থক্যে বর্তমান সময়ে সমশ্রেণির বাইরে কেউ কারো নয়। শ্রেণি সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক টিকে থাকা-না থাকা নির্ভর করে। এখনকার ঈদে শহরে উৎসব-আনন্দ চোখে পড়ে না।

স্বল্প আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাবার কারণে ঈদের পূর্ব হতে পরবর্তী চার-পাঁচ দিন শহর ফাঁকা হয়ে যায়। গ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ততা শহরের আশিভাগ মানুষের অথচ বিত্তবান শ্রেণি গ্রামচ্যুত। পরিজন-সমাজ এবং সামষ্টিক সামাজিকতা বিচ্যুত। তারা যে গ্রাম থেকে এসেছে সে কথাও তাদের বোধকরি স্মরণে নেই। শ্রেণি উত্তোরণে অতীতের আত্মীয়-পরিজন, সামাজিকতা কেবল ভুলেই যায় নি। সচেতনভাবে পরিত্যাগ করে সমশ্রেণির মধ্যে বিলীন হয়ে পড়েছে। এই সকল বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করার ক্ষেত্রে ঈদ একটি সম্ভাবনাময় উপলক্ষ। যেটা নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রে আমরা দেখে থাকি। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রে সেটা অবান্তররূপেই গণ্য করা যায়।

ঈদ নিশ্চয়ই আনন্দের উৎসব। কিন্তু বর্তমানে ঈদে আমরা কিন্তু সমাজ জীবনে সর্বাধিক বৈষম্য দেখে থাকি। সমাজের সুবিধাভোগী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সুবিধাবঞ্চিতদের ক্ষেত্রে তীব্র বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। এক কাতারে নামাজ আদায় করলেও সকলের পরিধেয় বস্ত্র এক তো নয়-ই, ভয়ানক মাত্রায় বৈষম্যপূর্ণ। কতিপয়ের বিত্ত-বৈভবে ভোগ-বিলাসিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের পোশাকে-আচরণে, খাওয়া-খাদ্যে ইত্যাদিতে।

আমাদের সমাজে ধনী-দরিদ্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য আকাশপাতাল ব্যবধানসম। রোজার মাসে ধর্মীয় অনুশাসনে যাকাত প্রদানের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। অবশ্য যাকাত প্রদানের বিষয়টি সমাজে বৈষম্যকেই স্থায়ী করেছে। ধনীরা যাকাত দেবে আর দরিদ্ররা হাত পেতে নেবে। যাকাত আদান-প্রদানের ব্যবস্থাটি সমাজের শ্রেণি বৈষম্যকেই সু-নিশ্চিত করেছে। বিভিন্ন বস্ত্রের দোকানে ব্যানার টাঙিয়ে যাকাতের কাপড় (শাড়ি-লুঙ্গি ইত্যাদি) বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখা যায়। যাকাতের কাপড় মাত্রই অত্যন্ত নিম্নমানের এবং স্বল্পমূল্যের। সকল দোকানি ঐ স্বল্প মূল্যের এবং অতি নিম্নমানের যাকাতের বস্ত্র বিক্রি করে না। যে সমস্ত দোকানে তা বিক্রি হয়, সে সকল দোকানে বিজ্ঞাপন প্রচারের আবশ্যিকতার প্রয়োজন হয়।

সমাজের বিত্তশালী অংশ যাকাতের বস্ত্র বিলি বণ্টনে নিজেদের দাতারূপে জাহির করতে যে পন্থাটি অবলম্বন করে থাকে; এতে অসহায় মানুষের পদদলিত হয়ে মৃত্যুর প্রচুর ঘটনাও ঘটে থাকে। ঈদ নিশ্চয় আনন্দ-উৎসব। তবে সবার জন্য নয়। ঈদে নজরকাড়া বৈষম্য অত্যন্ত তীব্ররূপে দেখা যায়। রোজা-ঈদ যেন বিত্তবানদের আহার-ভোজন এবং সীমাহীন ভোগ বিলাসিতা মেটাতেই আসে। খাদ্য-দ্রব্য পণ্যের বাজার অধিক মাত্রায় চড়া হবার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠদের নাকাল হতে হয়। ঈদের আনন্দের বার্তা সকলের জন্য সমানভাবে আসে না। আসা সম্ভবও নয়। বিদ্যমান বৈষম্যপূর্ণ সমাজে সেটা আশা করাও মূর্খতা।

সকল উৎসব-পার্বণে দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক, উৎসবকে অসাম্প্রদায়িক রূপে গড়ে তোলা। দুই, সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন করা। এই দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধান সম্ভব হলেই ঈদসহ সকল উৎসব-পার্বণ সর্বজনীন হবে এবং পরিপূর্ণরূপে সকলের জন্য উৎসবের আনন্দ নিশ্চিত করতে পারবে। নয়তো ঈদ আসবে-যাবে, কেউ কেউ ভোগবাদিতায় ভাসবে আর সংখ্যাগরিষ্ঠরা চেয়ে চেয়ে কেবল দেখবে। উপভোগে বঞ্চিত হবে। সেক্ষেত্রে ঈদ-পার্বণের আবেদনও পূর্ণতা পাবে না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *