সারাদেশ

বৈষম্যহীন বাংলাদেশে সবার অধিকার নিশ্চিত করা হবে: তথ্য উপদেষ্টা

ডেস্ক রিপোর্ট: রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য একটি বিশেষ আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরি করা হচ্ছে। সম্প্রতি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগীদের আরও উন্নত এবং সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য এই ওয়ার্ড তৈরি হচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই উদ্যোগ নিয়েছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রাজশাহীজুড়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এতে স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। চাপ পড়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন, যাদের বেশিরভাগই এডিস মশার কামড়ে সংক্রমিত হয়ে গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন। যার সিংহভাগই ঢাকা থেকে আগত।

শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (রামেক) ঘুরে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে শিশু থেকে শুরু করে বয়স্করাও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন।

রামেক হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মুমূর্ষ অবস্থায় কাতরাচ্ছেন অনেকে। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু রয়েছেন দুই জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়স ৩০ থেকে ৪৫ এর মধ্যে। অল্প কিছু সংখ্যক যুবকও রয়েছেন। এদের সাথে ৬০ বছরের এক বৃদ্ধও রয়েছেন। যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগেরই ঢাকার সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে । কেউ ঢাকা থেকে এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন আবার কেউ ঢাকাতে গিয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।

নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার বাসিন্দা ওসমান আলী (৩১)। সম্প্রতি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি ঢাকা থেকে ফেরার পর থেকেই জ্বরে আক্রান্ত হন। প্রথমে সনাতনী পদ্ধতিতে চিকিৎসা করালেও জ্বর না কমায় পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে আসেন চিকিৎসা নিতে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত করা হন তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। ওসমান আলী গত ১৫ সেপ্টেম্বর রামেকে ভর্তি হন এবং বর্তমানে তার চিকিৎসা চলছে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বাসিন্দা বাবলু হোসেন সম্প্রতি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় একটি কাজের জন্য গিয়েছিলেন। ঢাকায় ফেরার পর কয়েকদিন ধরে তিনি তীব্র মাথাব্যথা, জ্বর এবং বমিতে ভুগছিলেন। রামেকে এসে পরীক্ষা করার পর নিশ্চিত হন তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত। চিকিৎসকরা তাকে দ্রুত ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন।

বাবলু হোসেন জানান, মেডিকেলে চিকিৎসক ও নার্সরা তার যথাযথ যত্ন নিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় সব ওষুধ সময়মতো সরবরাহ করছেন। তবে তিনি হাসপাতালের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, হাসপাতালের পরিবেশ এতটাই অস্বাস্থ্যকর যে এখানে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে। যদিও নগরজুড়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রচারণা চলছে, মশার বিস্তার রোধে জনসচেতনতা ও সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাব স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

তাদের মতে, এ বছর সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি গুরুতর হবে বলে দুই মাস আগেই সতর্ক করা হয়েছিল। তবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ সেভাবে চোখে পড়েনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে, অক্টোবর মাসে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

প্রতিবছরই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য দায়ীদের নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, যারা এর দায়িত্বে রয়েছেন, তারা এটিকে কেবল চাকরি হিসেবে দেখছেন, সেবা ও ভালোবাসার আন্তরিকতার অভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সেইসাথে রোগীদের অসচেতনতা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ডেঙ্গুর যথাযথ চিকিৎসার অভাব এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা প্রতিবছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

রাজশাহী জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক জানান, প্রতিবছর বর্ষার এই সময়টাতে ডেঙ্গু রোগ একটি বড় আতঙ্ক হয়ে দাড়ায়। ডেঙ্গু রোগীদের সেবা প্রদানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। রোগীদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা হচ্ছে। হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম সম্পর্কেও তিনি আশ্বস্ত করে তিনি জানান, রামেকের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্যালাইনসহ অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী মজুত রয়েছে এবং ভবিষ্যতে কোনো সরঞ্জামের ঘাটতি যেন না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীদের অধিকাংশই (শক সিনড্রোম) খিঁচুনি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এটি ডেঙ্গুর একটি গুরুতর পর্যায়। এই অবস্থায় রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। এটি রক্তচাপ কমিয়ে ফেলে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে। শক সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থায় অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সী ক্যাজুয়ালটি বিভাগের ইনচার্জ অফিসার ও ডেঙ্গু বিষয়ক মুখপাত্র ডা. সংকর বলেন, রামেকে ডেঙ্গু চিকিৎসায় একটি ডেঙ্গু টিম গঠন করা হয়েছে এবং ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নতুন একটি আইসোলেশান ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে আমরা সেই আইসোলেশন ওয়ার্ডটা রোগীদের জন্য খুলে দিব। ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য যাবতীয় সরঞ্জামের কোনো ঘাটতি নেই।

ডা. সংকর বলেন, আজকে মোট ৬ জন ডেঙ্গু রোগ নিয়ে ভর্তি হয়েছে। এই মৌসুমে ১৫৮ জন রোগী ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ছাড় পেয়েছে। এছাড়া ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে দুই জন আইসিইউতে আছেন। তাদের মধ্যে একজন পুরুষ আর অন্যজন নারী।

রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন প্রশাসন এবং রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মো. হুমায়ূন কবির জানিয়েছেন, রাজশাহীতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য একটি বিশেষ ক্যাম্পেইন শুরু করা হয়েছে। এরই মধ্যে রাজশাহী বিভাগের শতাধিক স্থানে এই ক্যাম্পেইন পরিচালিত হয়েছে এবং রাজশাহী জেলায় ৮০টিরও বেশি স্থানে এই কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। যেখানে ময়লা-আবর্জনার মাত্রা বেশি, সেসব জায়গায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এই ক্যাম্পেইন পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, নগরীর ময়লা পরিষ্কারের জন্য হোবার মেশিনের মাধ্যমে দুটি ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে একটি কীটনাশকের কার্যক্রম চলমান থাকলেও বাজেট ঘাটতির কারণে অন্য কীটনাশক ব্যবহারে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন, যাদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৩৯ জন, তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। মার্চ মাসে আক্রান্ত হন ৩১১ জন; এর মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এপ্রিলে আক্রান্ত হন ৫০৪ জন, তাদের মধ্যে মারা গেছেন দুইজন। মে মাসে আক্রান্ত হন ৬৪৪ জন, এর মধ্যে মারা গেছেন ১২ জন। জুনে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৯৮ জন, এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের। জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন আর মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। অগাস্ট মাসে আক্রান্ত হন ৬ হাজার ৫২১ জন, এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮৪৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে মারা গেছেন আরও একজন। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১২২ জনের এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৩ হাজার ১০৮ জন।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *