সারাদেশ

উপজেলা আ. লীগের দাওয়াতপত্রে অসংখ্য ভুল, সমালোচনার ঝড়

ডেস্ক রিপোর্ট: কোথাও কোথাও বন্যা হলেও বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ায় বৃষ্টির আরামে মুছে গেছে দুঃসহ তাপপ্রবাহের সাম্প্রতিক স্মৃতি। তবে, পত্রিকান্তে প্রকাশ, তাপপ্রবাহের প্রতিকার ও করণীয় সম্পর্কে এখনো চূড়ান্ত হয়নি জাতীয় গাইডলাইন। এমনকি, তাপপ্রবাহে মৃত্যুর সঠিক সংখ্যাগত তথ্য ও কারণ জানা নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। যদিও বিশেষজ্ঞরা বার বার করে বলেছেন, তাপপ্রবাহে শরীরে যে হিট স্ট্রেস তৈরি হয়, তাতে হিট স্ট্রোকে মৃত্যু হতে পারে মানুষ ও গবাদিপশুর। এজন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও নির্দেশনা তাপপ্রবাহে মৃত্যুর বিষয়ে ভবিষ্যৎ সতর্কতার ক্ষেত্রে দিশা দিতে পারবে।

গেল তাপপ্রবাহের অস্বাভাবিক গরমে সারা দেশে অসমর্থিত হিসাবে প্রায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাপপ্রবাহে শরীরে যে হিট স্ট্রেস তৈরি হয়, তাতে হিট স্ট্রোক ছাড়াও বিভিন্ন কারণে মৃত্যু হতে পারে বলে জানিয়েছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। তবে তাপপ্রবাহজনিত মৃত্যুর সঠিক তথ্য দিতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ পর্যন্ত হিট স্ট্রোকে ১০ জনের মৃত্যুর কথা বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মৃতরা কী কী শারীরিক জটিলতায় মারা গেছেন, তা তাৎক্ষণিক জানার বিজ্ঞানসম্মত উপায় নেই বলেও জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তরফে।

ভারত কিন্তু এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত গুছিয়ে রেখেছে। তাপপ্রবাহের জেরে সাড়ে তিন মাসে, অর্থাৎ গত মার্চ থেকে সে দেশে ১১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশে মৃত্যু হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তার পরেই রয়েছে বিহার। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, তাপপ্রবাহের জেরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। এই রাজ্যে গত মার্চ থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের। তার পরেই রয়েছে বিহার। এই সময়ের মধ্যে বিহারে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। রাজস্থানে তাপপ্রবাহজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ১৬। মধ্যপ্রদেশে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের। তবে দেশের মধ্যে হিট স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা এই রাজ্যে সবচেয়ে বেশি। মার্চ থেকে জুনের মধ্যে ১০ হাজার ৬৩৬ জন হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন।

হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা উত্তর এবং পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতেও বেড়েছে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, ১ মার্চ থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত গোটা দেশে হিট স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ হাজার। গড়ে ২৪ ঘণ্টায় দিল্লিতে গরমে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের।

উত্তর ভারত স্বভাবতই তাপপ্রবণ অঞ্চল। তবে, আশ্চর্যের বিষয় হলো, এবার কলকাতার তাপমাত্রাও রাজস্থানের মরুভূমির সমপর্যায়ের উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল। একই ভাবে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশেও অসহনীয় গরম পড়েছিল। যে কারণে বিঘ্নিত হয়েছিল স্বাভাবিক জীবন। বন্ধ করা হয়েছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গরমে অসুস্থ হয়েছে বহু মানুুষ। বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি তাপপ্রবাহ, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ ও ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে সেটি অতি তীব্র তাপপ্রবাহ। বিশ্ব-আবহাওয়ার বিপর্যয় ও দেশের মধ্যে প্রকৃতি বিনাশী পরিস্থিতির কারণে সামনে বছরেও তাপপ্রবাহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এক্ষেত্রে পূর্ব-সতর্কতা ও পূর্ব-প্রস্তুতি গ্রহণ করা অপরিহার্য।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএসের (ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট জেলা হাসপাতাল বা উপজেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে তথ্য পাঠায় তা সংগ্রহ করা হয়। তারপর শতভাগ নিশ্চিত হয়েই এসব তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। তবে হিট স্ট্রোকের বাইরে অন্য কোনো কারণে মৃত্যু আছে কিনা জানতে চাইলে তারা জানান, ঠিক কোন কারণে মৃত্যু হয়েছে তা জানতে হলে ময়নাতদন্ত প্রয়োজন।

বাংলাদেশে তাপমাত্রাজনিত কারণে এমন পরিস্থিতি আগে সৃষ্টি না হওয়ায় কেউ সতর্ক ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞগণ। তাদের মতে, ‘দেশে এর আগে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। ফলে কেউই প্রস্তুত ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যে তথ্য আসছে আর মাঠে যে তথ্য রয়েছে তার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। প্রকৃত তথ্য পাওয়া না গেলে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পদক্ষেপ কঠিন হয়ে পড়ে। কোথায়, কোন বয়সী মানুষ ঠিক কী কারণে মারা যাচ্ছে তার সঠিক তথ্য নেই। ময়নাতদন্ত ছাড়া কোনো মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে বলা যাবে না। গত বছরও অনেক গরম থাকলেও চলতি বছরই মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’

তাদের মতে, তাপমাত্রা বেশি হলে সাধারণত হিট স্ট্রোকে বেশি মৃত্যু হয়। অন্যান্য কারণও হতে পারে। যেমন হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। তবে ঠিক কী কারণে অসুস্থ হচ্ছে বা মৃত্যু হচ্ছে তা পরীক্ষা না করে অনুমাননির্ভর বললে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, প্রচণ্ড তাপের কারণে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যারা ঘরের বাইরে কাজ করেন, তাদের ঝুঁকি বেশি। তাপের ফলে হিট স্ট্রোক, ক্লান্তি, হৃদরোগ, হিট ক্র্যাম্প (লবণ ও পানির অভাবে পেশিতে খিঁচুনি), তাপ ফুসকুড়ি হতে পারে। তাপমাত্রার অধিক্যের কারণে যাদের বয়স ৬৫ বা তার বেশি তারা ঝুঁকিতে বেশি পড়েন। এছাড়া যাদের অতিরিক্ত ওজন, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তারা গরমে মারাত্মক অসুস্থ হতে পারেন।

বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশেও ক্রমবর্ধমান তাপপ্রবাহের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মৃত্যু বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে হাসপাতালগুলোতেও হিট স্ট্রোকের রোগী বাড়ছে। এহেন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আরো প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশেষ করে, তীব্র তাপদহনের কারণে হিট স্ট্রোকসহ তাপমাত্রাজনিত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় একটি জাতীয় গাইডলাইন (নির্দেশিকা) তৈরি করাও জরুরি। বিশ্বের নানা দেশে এরূপ গাইডলাইন রয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে যে, এরূপ একটি নির্দেশিকা খসড়া আকারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া অধিক তাপপ্রবণ খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের চিকিৎসকদের এ বিষয়ে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে বলেও জানা গেছে। উল্লেখ্য,। ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল গাইডলাইন অন হিট রিলেটেড ইলনেস’ শিরোনামে নির্দেশিকা তৈরির জন্য একটি কমিটি কাজ করছে।

কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন,, ‘গাইডলাইনটি সাধারণ মানুষের জন্য নয়। যারা চিকিৎসা দেবেন ও চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবেন তাদের জন্য। তবে গাইডলাইনের শেষে জনসাধারণের জন্য কিছু পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। শুরুর দিকের অধ্যায়গুলোয় তাপপ্রবাহ এবং জনস্বাস্থ্যে জরুরি ঝুঁকিগুলো তুলে ধরা হয়েছে। পরের অধ্যায়গুলোয় হাসপাতালের প্রস্তুতি, বয়স্ক রোগীদের চিকিৎসা, গর্ভবতীদের জন্য চিকিৎসা, শিশুদের চিকিৎসা, প্রতিরোধের বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে এসব রয়েছে। কী কী পরীক্ষা করতে হবে, কীভাবে রোগীকে ব্যবস্থাপনার আওতায় নিতে হবে, কী চিকিৎসা দেয়া হবে এসব রয়েছে।’

জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে তাপদাহকে একটি বড় ধরনের বিপদ রূপে গণ্য করা হয়। কারণ, অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তিভেদে ঝুঁকি ভিন্ন হয়। বয়স ভেদে ও শারীরিক পরিস্থিতির ভিন্নতা হেতু কারো হৃদযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কারো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে অথবা কেউ অন্য কোনো কারণে মারা যেতে বা অসুস্থ হতে পারে। ফলে প্যাথলজিক্যাল অটোপসি (ময়নাতদন্ত) ও রোগীদের মেডিকেল হিস্ট্রি না জেনে চিকিৎসকের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করাও সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুর দেশে তাপপ্রবাহজনিত অসুস্থতার বিষয়ে গাইডলাইন বা নির্দেশনা থাকা অতীব জরুরি। এতে তাপপ্রবাহের সঙ্কুল পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যের বিপদ কমবে, অসুস্থতা ও মৃত্যুর সঠিক তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে এবং সর্বোপরি আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও হাসপাতালগুলোর জন্য সহজতর হবে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *