আন্তর্জাতিক

ব্যাংক খাত সংস্কারে কিছু প্রস্তাব

ডেস্ক রিপোর্ট: বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটতরাজ, বিচারহীনতা আর রাজনৈতিক আজ্ঞাবহতার শিকলে বাধা। অতীতে এই খাতকে সংশ্লিষ্ট সকলে মিলেমিশে পরিকল্পিতভাবে মগের মুল্লুক বানিয়েছে। এর ফলে রক্ষক ভক্ষক হয়েছে, আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে বহু অযাচিত ব্যক্তি, সৃষ্টি হয়েছে এস আলম ও সালমানের মতো অর্থনৈতিক ডনদের। এভাবে গুটি কয়েক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের হাতে কুক্ষিগত ব্যাংক খাত দেশের সামগ্রিক এবং সুষম অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ভুমিকা রাখতে পারছেনা। মগের মুল্লুকে পরিণত হওয়া ব্যাংক খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও এখন প্রায় শুন্যের কোঠায়। যে কয়েকটি পেশা বা পেশাজীবীর প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধা এবং ঘৃণা কাজ করে, তার মধ্যে এখন ব্যাংকাররাও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। তবে আশার বাণী হচ্ছে- বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের বৈষম্য, দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক অসমতা দূর করতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যাপক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, সচেতন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকেও আসছে নানা ধরনের সংস্কার প্রস্তাব ও দাবি।

এটা অনস্বীকার্য যে ব্যাংক খাত দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। তাই এর সংস্কারও অত্যন্ত জরুরি, যা সরকারের শীর্ষ তিন অগ্রাধিকারের একটি হওয়া উচিত। এই সংস্কারের জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর রোডম্যাপ। এই প্রেক্ষিতে, ব্যাংক খাতের সংস্কারের জন্য কিছু প্রস্তাব তুলে ধরছি, যা স্বচ্ছ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্যহীন ও সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের মূল্যায়নে আস্থা ভোট চালুকরণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের যোগ্যতা, কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রতি ২ বছর পরপর সব তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি/সিইওদের মাধ্যমে আস্থা/অনাস্থা ভোট চালু করা উচিত। এই ভোটের মাধ্যমে গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের স্ব স্ব পদে থাকার উপযুক্ততা নির্ধারণ করা হবে, যা ব্যাংকিং খাতে কার্যকর নেতৃত্ব ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।

শীর্ষ ব্যাংকারদের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ

ব্যাংকের এমডি নিয়োগের মতো এমডির অধস্তন আরো ৪ পদ পর্যন্ত ব্যক্তিদের এবং প্রধান কার্যালয়ের সকল বিভাগীয় প্রধান, বিভাগীয় শহরের সব শাখার ম্যানেজারদের নিয়োগ ও প্রমোশন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত / অনুমোদিত হতে হবে।

প্রমোশন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণ

যারা ৬ মাস, ১ বছর বা ২ বছরের ব্যবধানে ত্বরিত প্রমোশন পেয়েছেন, তাদের প্রমোশন পাওয়ার পেছনে কী কারণ ছিল, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যদি কোনো ব্যাংকার যোগ্যতা ছাড়াই প্রভাব খাটিয়ে বা চাপ তৈরি করে প্রমোশন পেয়ে থাকেন, তবে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংকগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন স্যালারি স্কেল এবং প্রমোশন eligibility টাইম স্প্যান থাকার ফলে ব্যাংক খাতে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। কিছু ব্যাংকে প্রমোশন জন্য ২ বছর সময় বিবেচনা করা হয়, আবার কিছু ব্যাংকে ৩ বছর সময় ধরা হয়। কেউ কেউ আবার ৫ বছরেও প্রমোশন প্রদান করে না। তাই প্রমোশনের জন্য সব ব্যাংকেই এক অভিন্ন টাইম স্প্যান বিবেচনা করা উচিত, এবং প্রমোশন প্রক্রিয়া নিয়মিত রেখে প্রতি বছর যোগ্যদের প্রমোশন প্রদান করা উচিত। তাছাড়া পারফরম্যান্স মূল্যায়ন যেহেতু ডিসেম্বর ভিত্তিক, সেহেতু প্রমোশনগুলো জানুয়ারির ১ তারিখ থেকেই কার্যকর করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে নজরদারি রাখতে হবে। এর মাধ্যমে যোগ্য কর্মীদের মধ্যে মনোবল এবং বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, যা একটি কার্যকর এবং ন্যায়সঙ্গত ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

নিরপেক্ষ সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ

সরকারি ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনুসরণে বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যম ও নিচের সারির কর্মকর্তাদের নিয়োগও ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে হতে হবে। নিয়োগ কার্যক্রম ত্বরানিত করতে কমিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকার, বিআইবিএম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তাছাড়া কমিটির নিরপেক্ষতার স্বার্থে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির একজন সদস্যের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৫ বছর করা যেতে পারে।

প্রকৃত আর্থিক অবস্থা উন্মোচন

সরকারি খরচে আগামী ৩-৬ মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা ফার্ম দ্বারা প্রতিটি ব্যাংকের বিশদ নিরীক্ষা করে প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নির্ণয় করে ব্যাংকগুলোকে ৩ বা ৪টি গ্রেডে ফেলে সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়াও নিয়ম করা যেতে পারে- নিয়মিত নিরীক্ষার অতিরিক্ত হিসেবে ৫ বছর পরপর প্রতিটি ব্যাংককে বিদেশি নিরপেক্ষ নিরীক্ষা ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষা করাতে হবে।

ঋণ অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা

ঋণ অনিয়মের সাথে জড়িত প্রমাণিত ব্যাংকার ও বোর্ড সদস্যদের অনতিবিলম্বে সাসপেন্ড করে আগামী ৬ মাসের মধ্যে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এছাড়াও, আইন করে ঋণ জালিয়াতির শাস্তি হিসেবে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা প্রয়োজন।

ঋণ খেলাপিদের অধিকার খর্বিত করে সামাজিকভাবে বর্জন

ঋণ খেলাপিদেরকে ঋণ খেলাপি বলার পাশাপাশি আরও অসম্মানজনক কোনো সম্বোধন করা যেতে পারে এবং তাদেরকে তীব্রভাবে বয়কট ও একঘরে করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- তাদের পাসপোর্ট ও ভিসায় ঋণখেলাপি সিল মেরে দেওয়া, বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তাদের মৌলিক অধিকারের অতিরিক্ত সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে, যেমন- বাসায় ও অফিসে এসির ব্যবহার অনুমোদন না করা; বিমানের ভিআইপি টিকেট না দেওয়া; জমি-প্লট-ফ্ল্যাট ও গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করতে না দেওয়া; মূল্যবান জুয়েলারি ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা; ব্যবসায়িক লাইসেন্স ইস্যু বা নবায়ন না করা; রাজনীতি, ব্যবসা, ধর্মীয় বা সামাজিক সংগঠনের কোনো পদে না রাখা; সভা-সমিতির প্রধান না করা ইত্যাদি। কোনো ভিজিটর তাদের ওয়াবসাইটে ভিজিট করলেই “আমি ঋণখেলাপি” এই পপ-আপ ম্যাসেজ দেখতে পাওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে। না হলে তাদের ওয়েবসাইট ব্লক করে রাখতে হবে। তাদেরকে কেউ ফোন করলে, কলার যেন ওয়েলকাম টিউন হিসেবে শুনতে পায়, “আপনি একজন ঋণখেলাপিকে কল করেছেন”!

আয়কর রিটার্নের সম্পদ ও দায়ের চূড়ান্ততা

টিআইএনধারী ঋণ গ্রহীতাগণ রিটার্নে নিজেদেরকে মিসকিন আর ঋণ প্রস্তাবে নিজেদেরকে রাজা হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাই এই দ্বৈত আর্থিক বিবরণী রোধ করতে, টিআইএনধারীদের ব্যাংক ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে রিটার্নে প্রদর্শিত সম্পদ, দায়, আয়-ব্যয়কেই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। ব্যাংকগুলোকে রিটার্নের ফিন্যান্সিয়াল বিবরণীর উপর ভিত্তি করেই ঋণগ্রহীতার ক্রেডিট ওয়ার্দিনেস অ্যাসেস করতে হবে।

মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবের লেনদেনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা

আয়কর রিটার্নে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবের লেনদেন এবং স্থিতিকে উল্লেখ করার বা বিবরণী সংযুক্ত করার বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণে, মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টগুলো ঘুষ গ্রহণের অন্যতম নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাগণ। তাই প্রত্যেক মোবাইল ব্যাংক একাউন্টের লেনদেনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে এ হিসাবের লেনদেনকেও আয়করের আওতায় আনতে হবে। একজন ব্যক্তির নাম বা আইডি দিয়ে একের অধিক মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলাও নিষিদ্ধ করতে হবে।

ব্যাংকারদের সম্পদ রিপোর্টিং ও সঞ্চয়ী হিসাব সীমাবদ্ধতা

একজন ব্যাংকারের নামে ২টির বেশি সঞ্চয়ী হিসাব থাকতে পারবে না। প্রতি বছর ব্যাংকারদেরকে তাদের ব্যাংক ব্যালেন্স এবং জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অলংকার, গাড়ি ইত্যাদি সম্পদ ও দায়ের হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের নিজেদের হিসাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে রিপোর্ট করবেন। এছাড়াও ৫ বছর পরপর প্রত্যেক ব্যাংকার তাদের স্ত্রী/স্বামী এবং সন্তানদের সম্পদ ও দায়ের হিসাবও জমাপ্রদান করবেন। ব্যাংকের পরিচালকদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম বা আরও কড়া নিয়ম করা যেতে পারে।

ব্যাংকিং খাতে অভিন্ন পদসোপান ব্যবস্থা

সব ব্যাংকে সর্বোচ্চ ১০টি পদসোপান রেখে একটি অভিন্ন hierarchical designation প্রবর্তন করা উচিত (functional designation ভিন্ন হতে পারে)। এই ব্যবস্থা ব্যাংকিং সেক্টরে পদ ও দায়িত্বের স্বচ্ছতা ও সামঞ্জস্য নিশ্চিত করবে, যা পরিচালন ও প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সহজতর করবে। অভিন্ন পদসোপান কাঠামো ব্যাংকগুলোর মধ্যে পার্থক্য দূর করবে এবং ক্যারিয়ার উন্নয়ন ও মূল্যায়নে এক ধরনের সামঞ্জস্য বজায় রাখবে।

ডিজিটাল লেনদেনের বাধ্যবাধকতা

অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চতকল্পে ও দুর্নীতি রোধে no-frill ক্যাটাগরির ব্যক্তিগণ বাদে অন্যদের ক্ষেত্রে ৫ হাজার টাকার অধিক লেনদেন ডিজিটাল চ্যানেলের মাধ্যমে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা জরুরি। এই পদক্ষেপ টাকা ছাপানোর খরচ কমাবে এবং নগদ অর্থের অনিয়ন্ত্রিত ও ট্রেসলেস প্রবাহ কমিয়ে এনে লেনদেনের যথাযথ ট্র্যাকিং এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।

এক ব্যক্তি, এক পরিচয়পত্র নীতি

একজন ব্যক্তির নামে একাধিক পরিচয়পত্র, যেমন- একইসাথে জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি থাকার সুযোগে একজন ব্যক্তি একাধিক সেভিংস একাউন্ট খুলতে পারছে এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে সেবা গ্রহণ করতে পারছে। ফলশ্রুতিতে, ঘুষ, দুর্নীতি এবং মানি লন্ডারিং অনেকটাই সহজ এবং অলিখিতভাবে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। বেনজীরের তো পাসপোর্টও আছে একাধিক! এইসব অপরিপক্ক রাষ্ট্রনীতির কারণে দুর্নীতিবাজরা একেক ব্যাংকে একেক পরিচয়পত্র দিয়ে হিসাব খুলতে পারছে এবং বিভিন্ন অবৈধ সম্পদ গড়তে পারছে। পরিচয়পত্রের নম্বরের ভিন্নতার সুযোগে এবং ব্যক্তির নামের বানানে ও শব্দে ভিন্নতার কারণে প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের এই স্বর্ণযুগে এসেও রিয়েল টাইমে একজন ব্যক্তির সম্পদ ও দায়ের সার্বিক চিত্র উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই একজন ব্যক্তির নামে একাধিক পরিচয়পত্রের বিধান বাতিল করতে হবে। একজন ব্যক্তির নামে কেবল একটিমাত্র পরিচয়পত্র থাকবে। জন্ম নিবন্ধন এবং এনআইডি— একজন ব্যক্তির নামে একসাথে দুইটি পরিচয়পত্র থাকার কোন প্রয়োজনীয়তা নাই। শিশু থেকে বৃদ্ধ– সবার পরিচয়পত্র হিসেবে শুধু এনআইডি বিবেচিত হবে। জন্ম নিবন্ধন / জন্ম সনদ বাতিল করে দিতে হবে। নিয়ম করতে হবে- শিশুর জন্মের এক মাসের মধ্যেই বাধ্যতামূলকভাবে তার নামে এনআইডি গ্রহণ করতে হবে এবং সকল ব্যাংক হিসাব খোলা থেকে শুরু করে সকল নাগরিক সেবা এই একটি এনআইডির বিপরীতেই সে গ্রহণ করতে পারবে। শুধু পাসপোর্ট, বিভিন্ন পেশাদার সনদ (যেমন- ড্রাইভিং লাইসেন্স) বা অন্য কোনো পরিচয়পত্র দিয়েই কোনো রাষ্ট্রীয় সেবা গ্রহণ কিংবা ব্যাংক একাউন্ট খুলা যাবে না। এগুলো এনআইডির অতিরিক্ত হিসেবে কাজ করতে পারে, কিন্তু বিকল্প হতে পারবে না।

এক ব্যবসা, এক BIN

ব্যক্তির একক পরিচয়পত্রের মতো প্রত্যেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেই বাধ্যতামূলকভাবে Business Identification Number (BIN) গ্রহণ করতে হবে, যা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি, প্রতিটি গ্রুপ অব কোম্পানির জন্য একটি অভিন্ন বিজনেস গ্রুপ আইডি থাকা উচিত। এই গ্রুপ আইডি নম্বরগুলো সরকারি ডেটাবেজে সংরক্ষণ করা হবে এবং তা মালিকদের এনআইডি ও সহযোগী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের BIN এর সাথে লিংকড করা থাকবে।

সিআইবি রিপোর্টে সম্পদের এক্সপোজার অন্তর্ভুক্তকরণ

ঋণ দেওয়ার সময় একজন ব্যাংকারের তার ঋণগ্রহীতার দায়ের পরিমাণ জানার অধিকার থাকলে ঋণগ্রহীতার সম্পদের পরিমাণ জানারও অধিকারও থাকা উচিত। তাই সিআইবি রিপোর্টে লোন এক্সপোজারের পাশাপাশি সম্পদের এক্সপোজারও সন্নিবেশিত করতে হবে। একই সাথে সিআইবি রিপোর্টের স্টেকহোল্ডার বাড়িয়ে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, জুয়েলারি সেলার, কার সেলার, সঞ্চয় অধিদপ্তর, ডাকঘর, এনবিআর, দুদককসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ঋণের দ্বৈততা রোধকরণ

এক ব্যাংকে ঋণ থাকাবস্থায় যদি একজন ঋণগ্রহীতাকে দ্বিতীয় আরেকটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ দিতে চায়, তাহলে দ্বিতীয় ব্যাংকটিকে প্রথম ব্যাংকের অনাপত্তিপত্র গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় দ্বিতীয় ব্যাংক ঋণ দেওয়ার পর প্রথম ব্যাংকের ঋণটি খেলাপি হয়ে পড়লে, দ্বিতীয় ব্যাংক সেই ঋণ পরিশোধ করার জন্য দায়বদ্ধ থাকবেন।

বন্ধককৃত জামানতের ডেটাবেজ তৈরি ও নির্দায় সনদের অর্থবহতা নিশ্চিতকরণ

একই সম্পদের দ্বৈত বন্ধক রোধে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধককৃত সকল জামানতের একটি ডেটাবেজ তৈরি করে নির্দায় সনদকে (Non-Encumbrance Certificate) অর্থবহ করা উচিত।

৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করা

৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট ব্যাংকে জমা প্রদানের ১৫ দিন সময় দিয়ে বাতিল বলে ঘোষণা করা যেতে পারে। এই সময়ে মোট এক কোটি টাকার অধিক অংকের নগদ জমার ক্ষেত্রে উৎস সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে (প্রামাণিক ডকুমেন্ট গ্রহণ) জমা গ্রহণ করতে হবে এবং মোট ১০ লক্ষ বা তদোর্ধ টাকার জমার ক্ষেত্রে শর্ত থাকবে যে, আমানতকারী পরবর্তী এক মাসের মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমা প্রদান করবেন। এছাড়াও শর্ত থাকবে- এই জমা কোনো নতুন একাউন্ট খোলে জমা করা যাবে না—নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা CASA (কারেন্ট এন্ড সেভিংস) ধরনের একাউন্টেই জমা রাখা যাবে। এও শর্ত থাকবে- উক্ত ১৫ দিন সময়ে মোট জমাকৃত টাকা এক কোটির বেশি হলে এক কোটির অতিরিক্ত টাকা পরবর্তীতে আর নগদে উত্তোলন করা যাবে না, কেবল একাউন্ট টু একাউন্ট ট্রান্সফার বা ডিজিটাল চ্যানেলে ট্রান্সফার করা যাবে।

ব্যাংক হিসাবের আবগারি শুল্ক বাতিলকরণ

আমানতের সুদের বিপরীতে আয়কর প্রদানের পরেও ব্যাংক হিসাব থেকে আবগারি শুল্ক কর্তন করা পরিষ্কার জুলুম, যা মানুষের ব্যাংক-বিমুখতা বাড়িয়েছে। সাধারণ মানুষকে ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট করতে এবং ব্যাংকিং সেবার ব্যবহার বাড়াতে ব্যাংক হিসাবের উপর আরোপিত আবগারি শুল্ক অবিলম্বে বাতিল করা উচিত।

যে ব্যাংক খাতের সর্বাঙ্গে ব্যথা, তার কোন অঙ্গে আগে ওষুধ দেওয়া উচিত– এই সিদ্ধান্ত নেয়া খুবই দুষ্কর। তবে আমাদের দেশের ব্যাংক খাত সাধারণ কোনো ব্যথায় আক্রান্ত নয়, বরং এটি মারণব্যাধী ক্যানসারে আক্রান্ত। তাই এর চিকিৎসাও হতে হবে বিশেষ ও বড় রকমের। আর ক্যানসারের চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু করা যায়, আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা ততোই বেশি হয়। অতএব, আর কালক্ষেপণ না করে ব্যাংকিং খাতে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা হলে, দেশের ব্যাংক খাতে প্রাণ ফিরে আসা শুরু হবে বলে বিশ্বাস করা যায়।

মোশারফ হোসেন: লেখক ও ব্যাংকার

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *