সারাদেশ

নিয়ন্ত্রণে নেই যানজট, আইন প্রয়োগের নির্দেশনা নেই পুলিশের

ডেস্ক রিপোর্ট: মঙ্গলবার দুপুর ১২টা। শাহবাগ মোড়ে হাতে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য। সিগন্যাল না মেনেই পুলিশ সদস্যের পাশ ঘেঁষে চলছে যানবাহন।

একই সিগন্যালে দায়িত্ব পালন করা আরেক পুলিশ সদস্য হামিদুল। সিগন্যাল সামলাতে তিনি এক প্রকার ভ্যাবাচেকা। এদিক সেদিক দৌড়েও যেন থামাতে পারছেন চালকদের। নিয়ন্ত্রণহীন যান চলাচলের এই দৃশ্যের পরিবর্তন দেখা যায় না সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত।

মহাসড়কে অটোরিকশার বেপরোয়া চলাচলও অস্থির করে তুলেছে রাজধানীবাসীকে। অবৈধ রিকশার মহড়ায় নিয়ন্ত্রণ নেই অন্যান্য যানবাহনের। আইনের তোয়াক্কা নেই চালকদেরও। সিগন্যাল অমান্যই যেন এখন অলিখিত নিয়ম। এতে বেড়েছে ঢাকার যানজট। অথচ এক মাস আগেও ছিল না এমন দৃশ্য। তাহলে হঠাৎ কেন বদলে গেল চিত্র?

মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বাংলামোটর, শাহবাগ, কারওয়ান বাজারসহ অন্তত ১০টি ট্রাফিক ইন্টার সেকশন ঘুরে দৃশ্যপট বদলে যাওয়ার কারণ খুঁজেছে প্রতিবেদক। সড়কে পুলিশের অসহায় আত্মসমর্পণ মূলত যানজট বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ।

শাহবাগ মোড়ে হাতে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই পুলিশ সদস্যের মতেই নিবর ভূমিকা ছিল সব ইন্টার সেকশনের ট্রাফিক পুলিশদের। আইনের প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণকারীরা যখন চুপ, তখন খুব সহজে সিগন্যাল অমান্য করছে চালকরা। এতেই সৃষ্টি হচ্ছে জটলার। আইনের ব্যবহার না থাকায় রাস্তায় নেমেছে অবৈধ যানবাহনও। অটোরিকশার মত নিষিদ্ধ যানবাহনও চলছে মহাসড়কে। অপ্রত্যাশিত যানবাহনের ফলে বহু আগে ধারণ সক্ষমতার বাইরে যাওয়া সড়কে বেড়েছে গাড়ির চাপ। অতিরিক্ত যানজট বাড়াচ্ছে সড়কের উপরেই গড়ে উঠা বিভিন্ন স্ট্যান্ড। যার মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।

আবু বক্কর নামের এক বাসযাত্রী বলেন, ফার্মগেট থেকে শাহবাগ আসতে আমার পুরো ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট প্রয়োজন হয়েছে। আমি হেঁটে আসলে হয়ত ১৫ মিনিট লাগত। পুলিশ কাউকে কিছু বলছে না। এত এই সমস্যা। অটোরিকশায় ছেয়ে গেছে ঢাকা। অন্য যানবাহন চলার উপায় নেই। এতে আমাদের সময় যাচ্ছে। আয়ের পরিধি কমছে।

ফাতেমা নামের আরেক যাত্রী বলেন, আসলে দেশ আইনবিহীন চলছে। তা না হলে এমন নৈরাজ্য কীভাবে হয়। আইনের প্রয়োগ ছাড়া কীভাবে চলতে পারে রাষ্ট্র। অতি দ্রুত আইন প্রয়োগ করে সড়ক থেকে এসব যানবাহন সরিয়ে সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

গবেষকরা বলছেন, ২০০৫ সালে ঢাকার সড়কের ঘণ্টায় যান চলাচলের গতি ছিল ২১ কিলোমিটার। সবশেষ গবেষণায় সেটি এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ কিলোমিটারে। যা একজন সুস্থ মানুষের হাঁটার গতির থেকেও কম। ফলে একদিকে যেমন চরম ভোগান্তিতে পড়েছে ঢাকার মানুষ, অন্যদিকে গতি কমায় কমেছে অর্থনীতির পরিধি। তথ্য বলছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩০ শতাংশ আসে ঢাকার সড়ক থেকে। ফলে যান চলাচলের এই ভঙুর দশার প্রভাব পড়ছে জিডিপিতে।

সড়কের এমন নৈরাজ্যের পিছনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন খোদ আইন অমান্যকারীরা। রাজধানীর মহাসড়কে চলাচল করা অন্তত ৫০টির বেশি অটোরিকশা চালকের সাথে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। তাদের প্রত্যেকের দাবি, পুলিশ বাধা না দেওয়ায় সড়কে চলছেন তারা। বাধা দিলে চালাবে না। একই অভিযোগ সিগন্যাল অমান্যকারী অন্য চালকদেরও।

মঙ্গলবার বিকেল তিনটায় বাংলামোটর ট্রাফিক ইন্টার সেকশনে সিগন্যাল অমান্য করে আসা মোটরবাইক চালককে থামান এ প্রতিবেদক। কেন অমান্য করেছেন সিগন্যাল জানতে চাইলে ইসমাইল নামের ওই চালক বলেন, দেখেন আমার তাড়া আছে। অনেক যানজট দ্রুত যেতে হবে। তাছাড়া পুলিশ তো কিছু বলছে না। আইন থাকলে মানতাম; এখন তো তা নেই, তাই না?

অটোরিকশা চালক মোবারক বলেন, এখন তো কেউ বাধা দেয় না। তাই চালাই। কী করব চালাতে তো হবে। আমাদের একটু সুযোগ দিয়েছে, তাই চালাচ্ছি।

আরেক অটোরিকশা চালক বলেন, আগে মানা করত, আগে আসিনি। এখন করে না তাই আসি। অটো চললে যদি সমস্যা হয় তাহলে কেন পুলিশ আটকায় না। আমাদের পেটে লাথি মাইরেন না। আমাদের জন্য যানজট হয় না।

খোদ আইন অমান্যকারীদের এমন বক্তব্যের পর- প্রশ্ন হলো পুলিশ দেশের প্রচলিত আইন ও সড়ক সুরক্ষার নীতিমালার অনুসরণ করছে না কেন?

এ বিষয়ে সড়কে ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের অনেকেই বলছেন গণঅভ্যুত্থানের পর অনেকটাই মনোবল ভেঙেছে পুলিশের। এতে ভয়ে আইন প্রয়োগ করছে না পুলিশ। তেমন নির্দেশনাও নেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের।

যার সত্যতাও মিলল শাহবাগে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য হারুনের বক্তব্যে। তিনি বলেন, অটোরিকশা নিষিদ্ধ করছিল, আবার চলে। আমরা কী করব। আমাদের আইন প্রয়োগ করার অনুমতি নেই। উপর থেকে অনুমতি না আসলে কি আমরা কিছু করতে পারি? ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেই। আগে মামলা দেওয়ার নিয়ম ছিল এখন সে অনুমতিও নেই।

যদিও আইন প্রয়োগের নির্দেশনা না দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক প্রধান খোন্দকার নজমুল হাসান।

তিনি বলেন, শুধু সড়কে যানবাহন থামিয়ে কাগজপত্র চেক করার কাজটা বন্ধ আছে। তবে সিগন্যাল অমান্য করলে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। সে নির্দেশনা দেওয়া আছে। একই সাথে অবৈধ যানবাহন যেন চলতে না পারে সে বিষয়ে কড়া নির্দেশনা দেওয়া আছে।

সড়কে পুলিশের নীরব ভূমিকা ও যানজটের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামানের সাথে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের মূল সড়কের সংখ্যা অনেক কম। সড়কের সক্ষমতার বাইরে আমরা অনেক আগেই চলে গেছি। যেখানে গণপরিবহনের প্রাধান্য থাকার কথা ছিল সেটাও কিন্তু নেই। সেই জায়গায় অটোরিকশার মত ছোট ছোট খুচরা যানবাহন যখন চলে আসছে সড়কে, তখন সড়কের সক্ষমতার অনেকটাই বাইরে চলে গেছি আমরা।

সড়কের সক্ষমতার বাইরে যাওয়ার ফলে একদিকে যেমন যানজট ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ঢাকা শহর অনেকটা অচলায়তন অবস্থা। গাড়ির চাকা নড়ছে না। এক ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিতে ৩ ঘণ্টা ৪ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। পাশাপাশি নিরাপত্তার ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

মহাসড়কে চলা এসব অবৈধ যানবাহনের যারা চালক, তারা কিন্তু রাতারাতি চালক বনে গেছে। শহরকেন্দ্রিক একটা নগরে কীভাবে গাড়ি চালাতে হয়, তার বিন্দুমাত্র নিয়মকানুন তারা জানে না। সিগন্যাল কীভাবে অনুসরণ করতে হয়। ট্রাফিক ইশারা দিকে কীভাবে থামতে হয়। কখন ইন্টার সেকশন ঢুকবেন। কিভাবে ইন্টার সেকশন থেকে বের হবেন, সেটার যেমন দক্ষতা নাই। তেমনি এসব অবৈধ যানবাহন চালকদের কোন ধরনের প্রশিক্ষণ নাই। যানবাহন যেহেতু অবৈধ, চালকও কিন্তু অবৈধ।

পুলিশের আইন প্রয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ একটি পেশাদারি সংস্থা। তাদের পেশাদারি নিয়েই কাজ করতে হবে। যেই ঘটনা ঘটে গেছে। সেটার জন্য তাদের মনোবলের আমরা যে একটা ধস দেখছি, সেই ধস নিয়ে যদি সড়কে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে হবে না। পুলিশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করার যে দায়িত্ব সেখান থেকে তারা অনেক দূরে সরে এসেছে। ফলে সড়কে আমি মনে করি অনেকটা স্বেচ্ছাচারিতা শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, নির্দেশনার জন্য আমাদের ডিএমপি কমিশনার আছেন। ট্রাফিক বিভাগের এডিশনাল কমিশনার আছে। তাদের একটা চেইন অব কমান্ড আছে। এই চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পুলিশ একটা পেশাদারি প্রতিষ্ঠান। তাদের বলে দেওয়া আছে কার কী দায়িত্ব। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠান, আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব তাদের এবং যে নাজুক অবস্থা আমরা দেখছি সেটার দায়ও তাদের। ফলে দ্রুত পুলিশের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করা উচিত।

অটোরিকশা যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, সেটা আরও খারাপের দিকে যাবে। পরে আরও বেশি কাঠকয়লা পুড়তে হবে। যারা সড়কে নেমে গেছে, চাইলেও তাদের রাতারাতি সরাতে পারব না। এর জন্য কৌশলী হতে হবে বলে জানান ড. হাদিউজ্জামান।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *