আন্তর্জাতিক

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেননি

ডেস্ক রিপোর্ট: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইনি ভিত্তি ছিল ১৯২০ সালের বঙ্গীয় আইনসভা বা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল কর্তৃক ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ পাস। ১৯২১ সালের ১লা জুলাই প্রথম পাঠদানের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। কলা, বিজ্ঞান ও আইন এই ৩টি অনুষদের অধীন ১২টি বিভাগের ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। প্রথম উপাচার্য ছিলেন মি. পি জে হার্টগ। প্রথম সমাবর্তন হয়েছিল ১৯২৩ সালে। পূর্ব বাংলার মুসলিমগণ তখনও লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকায় শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছিল হিন্দুধর্মাবলম্বী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তৎকালীন কলকাতার কিছু প্রভাবশালী মহল ইতিবাচক ছিল না। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন কলকাতার প্রভাবশালী মহলের একজন। এ কারণে কেউ কেউ ধারণা করেন, রবীন্দ্রনাথও ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন।

অবগতির জন্য এখানে আগেই একটা কথা বলে রাখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা তখন অনেকেই করেছিলেন; প্রভাবশালী হিন্দুদের থেকে প্রভাবশালী মুসলমানরাই বেশি বিরোধিতা করেছিলেন। এই বিরোধিতার বিষয়গুলির সাথে তৎকালীন প্রেক্ষাপটগত অনেক যৌক্তিক কারণ জড়িত ছিল। বিরোধিতার কারণগুলির পিছনের বোধ ও গভীরতার বিষয়গুলো আমলে নেবার মতো ছিল। বিরোধিতার পিছনে শুধু সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় কারণই লুকায়িত ছিল না। বিরোধিতার আঙ্গিক, গভীরতা ও মর্মার্থ ছিল আরও ব্যাপক। সাদামাটাভাবে এখনকার কিছু মানুষ বিরোধিতার বিষয়গুলোকে যেভাবে সরলীকরণ করে সরাসরি একটা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে যান, বিষয়গুলো এতো সরল ছিল না। শুধুমাত্র এমন নয় যে, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে পূর্ব বঙ্গের মানুষ বেশি শিক্ষিত হয়ে যাবে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিরোধিতা করেছে অথবা পূর্ব বাংলায় বেশি মুসলমান বাস করে বিধায় ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে পূর্ব বঙ্গের মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে এগিয়ে যাবে সে জন্য বিরোধিতা করেছে।

ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সেখানে হিন্দু শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি ছিল, ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে মুসলমানরা শিক্ষিত হয়ে হিন্দুদের চেয়ে এগিয়ে যাবে, সে ধারণাটি সঠিক নয়। লেখাপড়ায় পূর্ব বাংলার মুসলমানরা পিছিয়ে ছিল বলেই, এই অঞ্চলের মুসলমানদের এগিয়ে নেবার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ফলে, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে পূর্ব বঙ্গের মুসলমানরা বেশি শিক্ষিত হয়ে যাবে, সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা হয়েছে, এ ধারণাটি একেবারেই ঠিক নয় এবং এ ধারণা যারা প্রচার করেন, তারাও ভুল। তবে হ্যাঁ, ধর্মীয় কারণে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ এ উপমহাদেশে নতুন নয়- এখন যেমন আছে, আগেও তেমন ছিল। ফলে, এই বিভেদের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতামূলক কথা কেউ কেউ যে বলেননি তা নয়, তবে তা প্রণিধানযোগ্য নয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সে সবের কোনো ইমপ্যাক্ট পড়েনি। এ ধরনের কথা তখন যেমন বলা হতো, তেমনি এখনও বলা হয় কিন্তু এই বলাগুলি ওই বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, পলিসি লেভেলে এর ইমপ্যাক্ট খুব একটা পড়ে না।

এ সমস্ত বলাবলির কারণে সমাজে খানিকটা বিশৃঙ্খলা হয়, নানা মত, নানা পথের মানুষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার একটা অনুষঙ্গ তৈরি হয় কিন্তু পলিসি লেভেলে তেমন ইমপ্যাক্ট ফেলে না। যদি ইমপ্যাক্ট ফেলতো তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাই হতো না। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক কুলদা রায় তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, বিভিন্নজন বিভিন্ন কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। পশ্চিম বাংলা ও বিহার অঞ্চলের কিছু প্রভাবশালী মুসলমানও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।

তাঁদের মতে, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে তাতে পশ্চিম বাংলা ও বিহারে বসবাসকারী লোকজনের সন্তানসন্ততিদের কোনো লাভ হবে না, যদি কোনো উপকার হয়, তবে সেটা পূর্ব বাংলার মানুষেরই হবে। প্রভাবশালী মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাওলানা আকরম খাঁ, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, মৌলভি আবুল কাশেম, মৌলভি লিয়াকত হোসেন-সহ অনেকেই এই যুক্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।

পশ্চিম বাংলা ও বিহার অঞ্চলের কিছু মুসলমানই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন তাই নয়, তদানীন্তন পূর্ব বাংলার বেশ কিছু প্রভাবশালী মুসলমানও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল- পূর্ব বাংলায় যথেষ্ট পরিমাণ ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাস ছাত্র নেই, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন। এ কারণে তারা পূর্ব বাংলার ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে ওই টাকা দিয়ে পূর্ব বাংলায় আরও কিছু স্কুল ও কলেজ স্থাপন করার পক্ষে মত দেন। তারা পূর্ব বাংলা অঞ্চলের মুসলিম ছেলেমেয়েদের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার পরিধিটা বাড়াতে চেয়েছিলেন। তাদের ধারণা ছিল- বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে, পূর্ব বাংলার মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার জন্য যে বাজেট সরকার থেকে আসে, তা বাড়ানো হবে না। ফলে, বরাদ্দের এই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খরচ করলে স্কুল কলেজে পড়ুয়া মুসলিম শিক্ষার্থীদের উপরে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যদিও তাদের এই ধারণা সঠিক ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছিল।

আশ্চর্যর বিষয় হলো- কলকাতার হিন্দু সমাজের মানুষগুলোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন, কলকাতার হিন্দু সমাজের বাইরে থাকা দুই বঙ্গের অধিকাংশ হিন্দু-মুসলমানই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। বর্তমানে যারা রবীন্দ্রনাথ তথা হিন্দুদের বিরোধিতার ধারা অনুসরণ করেন, তারা এই সত্যটিকে স্বীকার করতে চান না। ইনিয়ে-বিনিয়ে নানান দুর্বল যুক্তি হাজির করে তারা প্রমাণ করতে চান যে, হিন্দুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল। লেখার শুরুতেই বলে নিয়েছি যে, বিরোধিতার কারণ শুধু সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় ছিল না। তাহলে মুসলমানরা এর বিরোধিতা করতো না। যা হোক, পরবর্তী আলোচনাগুলো এ বিষয়গুলোকে পরিষ্কার করবে।

চোখের সামনে একটা বিষয় খেয়াল করবেন, তৎকালীন পূর্ব বাংলার অধিকাংশ ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই কিন্তু হিন্দুদের করা- বিএল কলেজ, বিএম কলেজ, পিসি কলেজ, আনন্দ মোহন কলেজ, কেসি কলেজ, মদন মোহন কলেজ, মুরারি চাঁদ কলেজ ইত্যাদি ইত্যাদি। সে তুলনায় মুসলমানদের তৈরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কিন্তু কম। এখনকার মুসলমানদের মধ্যেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি না করার সেই প্রবণতাটি বিদ্যমান। বর্তমানে অনেক মুসলমানের কাছে অনেক টাকা আছে কিন্তু অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য সে টাকা তারা ব্যয় করে না, যদিও হিন্দু বিরোধিতাটা তারা ঠিকই করে।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি কলেজ ছিল। তার মধ্যে পূর্ব বাংলায় ছিল ৯টি এবং সমগ্র পশ্চিম বাংলায় ছিল ১০টি। ফলে,মুসলমানরা শিক্ষায় এগিয়ে যাবে বলে হিন্দুরা পূর্ব বাংলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার বিরোধিতা করেছে, এই ধারণা আমলে নেবার মতো নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন এমন ধারণার পিছনে যে তথ্য-উপাত্ত প্রচার করা হয় তা অত্যন্ত দুর্বল, অসত্য তো বটেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে এই দুজন ব্যক্তির খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। এ কারণে, অনেকে ধারণা করেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলে ধারণা পরিষ্কার হবে।

ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁর ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চান, তিনি কেন এর বিরোধিতা করছেন এবং কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে সরে আসবেন? বিনিময়ে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির দাবী করেন এবং সে দাবী পূরণ হলে তিনি তাঁর বিরোধিতা থেকে সরে আসেন।

পরবর্তীতে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক নিয়োগে সার্বিক সহযোগিতা করেন। এভাবে শেরে-বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরিবারও প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের চরম বিরোধিতা করেন কিন্তু পরবর্তীতে তারা আবার এটাকে সমর্থন করেন। এর পিছনের কারণগুলো পরে আলোচনা করছি। পূর্ব বাংলার মানুষ বিশেষ করে মুসলিম সমাজ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিলেন। তাদের ধারণা ছিল পূর্ব বাংলা আলাদা প্রদেশ হলে পূর্ব বাংলার সুযোগসুবিধা বাড়বে।

বঙ্গভঙ্গের পর ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ঢাকাকে পূর্ব বাংলার রাজধানী করা হয়। রবীন্দ্রনাথ-সহ দুই বাংলার অধিকাংশ মানুষই বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে ছিলেন। বিপুল মানুষের ব্যাপক বিদ্রোহের ফলে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে থাকায়, বঙ্গভঙ্গের পক্ষে থাকা পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজের একাংশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধী হিসেবে প্রচার করেন। কিন্তু তাদের এ ধারণা ঠিক নয়।

পরবর্তী আলোচনায় বিষয়টি পরিষ্কার হবে। কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি অংশ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে ১০-১২টি প্রতিবাদ সভা করেছিল। এর একটি ছিল কলকাতার গড়ের মাঠের প্রতিবাদ সভা, সময়টি ছিল ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ। ওই সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতিত্ব করেছিলেন বলে প্রচারণা করা হয়। কিন্তু এই তথ্যটি সঠিক নয়। ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ তারিখ ছিল ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ১৫ই চৈত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওই সময় তৎকালীন পূর্ববঙ্গের শিলাইদহে অবস্থান করছিলেন। শিলাইদহ থেকে তিনি কলকাতায় ফিরেছিলেন ১২ই এপ্রিল ১৯১২। ওই সময়ে শিলাইদহে অবস্থানকালে তিনি ১৭-১৮টি কবিতা ও গান লেখেন। ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’ গানটি তিনি রচনা করেন শিলাইদহে; তারিখ ১৪ই চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি দিনপঞ্জি অনুযায়ী যা হয় ১৯১২ সালের ২৭শে মার্চ। আরও একটি গান ‘এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার এই তরী’ এটিও শিলাইদহে বসেই কবি লিখেছিলেন ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ২৬শে চৈত্র, ইংরেজি দিনপঞ্জি অনুযায়ী যা ১৯১২ সালের ৮ই এপ্রিল।

তথ্যাবলি বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ শিলাইদহে ছিলেন, তাই কলকাতার গড়ের মাঠের সভায় তাঁর উপস্থিত থাকার বিষয়টি সত্য নয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পতিসর কাছারিবাড়িতে তাঁর হাতের লেখা কিছু চিঠি সংরক্ষিত আছে। এরমধ্যে একটি চিঠি আছে যেটি তিনি লিখেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রভোস্ট রমেশ চন্দ্র মজুমদারকে। রমেশ চন্দ্র মজুমদার, আরসি মজুমদার নামে পরিচিত, যিনি একসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। চিঠিটির বাংলা তারিখ ১৬ই মাঘ ১৩৩২ অনুযায়ী ৩০শে জানুয়ারি ১৯২৬।

চিঠিটি এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছি-

‘ওঁ কল্যাণীয়েষু, ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্যে দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুত হয়েছি। ৬ই তারিখে রাত্রে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাঁদেরই জলযানে ভেসে পড়ব। ১০ই তারিখ পর্যন্ত তাঁদের আতিথ্য ভোগ করে কর্তব্য অন্তে তোমার আশ্রমে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব। নইলে আমাকে দীর্ঘকাল ঢাকায় থাকতে হয়। আমার সময় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনোমতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে। তাই দুই নিমন্ত্রণ ক্ষেত্রে আমার সময়কে বিভক্ত করে দিলুম। যে কয়দিন তোমাদের দেব স্থির করেছিলুম সে কয়দিন সম্পূর্ণই রইল। ইতি ১৬ মাঘ ১৩৩২।

শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এই পত্র থেকেই জানা যায়, কবিকে ঢাকার সাধারণ মানুষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে তখন ঢাকার নবাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। ঢাকার নবাবদের ঢাকাকে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা ছিল। নবাবরা ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ব্যাপক সম্মান ও সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। ঢাকায় আগমন, মিউনিসিপ্যালিটির গণসংবর্ধনা, নবাববাড়িতে তাঁর নিমন্ত্রণ ও তাঁদের বোটে রাত্রিযাপন- এসবই বলে দেয় যে, ঢাকার মানুষ ও নবাবেরা নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কতটা সম্মান দিয়ে বরণ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নবাবদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করলে নবাবদের কাছ থেকে এমন অভ্যর্থনা পাবার কথা না।

১৯২৬ সালে ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সংবর্ধনা দিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, মুসলিম হল ছাত্র সংসদ, জগন্নাথ হল, জগন্নাথ কলেজ, হিন্দু মুসলিম সেবা সংঘ, ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিসহ অনেক সংগঠন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এতগুলো সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এবং গড়ের মাঠের কথিত সভার ১৪ বছরের মাথায় এত বিপুলাকার সংবর্ধনা দিতো না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকা সফরের ওই সময়ে অর্থাৎ ১৯২৬ সালের ১০ ও ১৩ই ফেব্রুয়ারি মোতাবেক ২৭ ও ৩০শে মাঘ ১৩৩২ বঙ্গাব্দে সমসাময়িক সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে কার্জন হলে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, ঢাকার সুধী সমাজ তা বহুদিন স্মরণে রেখেছে। এখনো সেই বক্তৃতার অনেক কথাই বেশ প্রাসঙ্গিক। সর্বোপরি ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখ কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডক্টর অব লিটারেচার বা ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কিন্তু কবি ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিময় পতিসরে তাঁকে দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি-লিট উপাধি প্রদানের সনদের যে প্রতিলিপি আছে, তার নিচে সনদ প্রদানকারী হিসেবে উপাচার্য স্যার এএফ রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে ডি-লিট উপাধি দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্যার এএফ রহমানের একক সিদ্ধান্ত ছিল না, এটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একজন বিরোধিতাকারীকে ডি-লিট উপাধি দেবার কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন-ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হলে উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষকদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় মানের শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবে। এই কথাটিকে অনেকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু সেটি যে
সঠিক নয়, এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান দেখলে সেটা প্রমাণিত হয়ে যায়। শিক্ষকের অভাব ছিল বলে তিনি শিক্ষক যোগাড়ের জন্য সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ-সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। যেমন-

১. শিক্ষক নিয়োগে সহযোগিতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নাম সুপারিশ করেছিলেন। তিনি শ্রীনিকেতন এবং শান্তিনিকেতনের মাধ্যমে শিক্ষাবিদদের প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন যেন তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। অনেকেই রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।

উল্লেখযোগ্য নামের মধ্যে একজন ছিলেন ড. রমেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আরেকজন ছিলেন ড. মহেন্দ্রলাল সরকার। তিনি ছিলেন বাংলা ও সংস্কৃতির একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। এছাড়াও যোগ দিয়েছিলেন, ড. প্রবোধচন্দ্র সেন, যিনি পরে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক হিসেবে পরিচিত হন। এসব নামকরা শিক্ষকদেরকে অনুসরণ করে আরও অনেক শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার অনুরোধ করেছিলেন।

২. বক্তৃতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা বৃদ্ধিতে অংশগ্রহণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশেষ বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদদের সাথে তাঁর সংযোগ বাড়িয়েছিল। এই বক্তৃতাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মননশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে প্রভাব ফেলেছিল।

৩. শিক্ষার উন্নয়ন ও সংস্কৃতি বিনিময়: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শিক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শান্তিনিকেতনের আদর্শের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উন্নয়নে একটি আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। তিনি সবসময় ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষার প্রসার ও সংস্কৃতির বিনিময়ে উৎসাহী ছিলেন এবং এই বিষয়ে তাঁর প্রভাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানকে উন্নত করতে সহায়ক ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে যেসব ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য।

এদের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুসম্পর্ক ছিল এবং তিনি এদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম ও পরিচয় উল্লেখ করছি- স্যার আশুতোষ মুখার্জী: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি শিক্ষার উন্নয়নে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।

পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী: তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত পণ্ডিত এবং শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলা সাহিত্যের গবেষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন।

রামাপ্রসাদ চক্রবর্তী: তিনি শিক্ষাবিদ এবং বিচারপতি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।

প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়: তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ এবং সমাজসেবক। শিক্ষার প্রসার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশে তার অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

এনামুল হক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং হিন্দু ও মুসলিম শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ: তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন কিন্তু হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহর মৃত্যু হলে, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন।

আবুল কাশেম ফজলুল হক: প্রথম দিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু পরে এসে পক্ষে কাজ করেছিলেন। এজন্য এই নামটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে ও বিপক্ষে অর্থাৎ উভয়পক্ষেই থাকবে।

রামচরণ রায়চৌধুরী: ইনি ছিলেন ঢাকার বালিয়াটির জমিদার। তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে জগন্নাথ হলের নামকরণ হয়। এছাড়াও, বহু হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দ, জমিদার, ও শিক্ষাবিদরা সম্মিলিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিশেষত পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার মুসলিম এবং হিন্দু নেতারা, এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

তাঁদের আপত্তি মূলত রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছিল, বিশেষ করে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের শিক্ষানীতি ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের আশঙ্কার কারণে তারা বিরোধী ভূমিকায় ছিলেন। তবে অনেকে প্রথম দিকে বিরোধী ভূমিকায় থাকলেও পরে পক্ষে কাজ করেছিলেন। নিচে এই নেতাদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির নাম ও পরিচয় দেওয়া হলো-

মুসলমান নেতৃবৃন্দ:

সোহরাওয়ার্দী পরিবার: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও গবেষক। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। সিরাজুল ইসলাম সোহরাওয়ার্দী এবং তার পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ তাঁরা মনে করেছিলেন এটি শিক্ষার মান বাড়ানোর পরিবর্তে পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করতে পারে। তবে সিরাজুল ইসলাম সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থকও হয়েছিলেন।

এ. কে. ফজলুল হক: পূর্ব বাংলার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা যিনি কলকাতার রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। প্রথম দিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন তবে পরবর্তীতে আবার সমর্থন করেছিলেন। তাঁর আপত্তির পেছনের মূল কারণ ছিল, তিনি ভেবেছিলেন ব্রিটিশরা এর মাধ্যমে মুসলমানদের
আলাদা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ঢুকিয়ে তাদের রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করবে। পরবর্তীতে যখন দেখলেন এটি সার্বিক শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তখন তিনি এটাকে সমর্থন দেন।

হিন্দু নেতৃবৃন্দ:

বিপিনচন্দ্র পাল: একজন বিশিষ্ট বাঙালি নেতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি মনে করতেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা মূলত হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন বাড়াবে। তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার পক্ষে ছিলেন, ফলে এটা ভেঙে যাবার শঙ্কা থেকে বিরোধিতা করেছিলেন। আরেকটি কারণে তিনি বিরোধিতা করেছিলেন- তিনি ভেবেছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সরবরাহ করতে হবে, ফলে, শিক্ষক স্বল্পতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান পড়ে যাবে।

অশ্বিনী কুমার দত্ত: তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক এবং শিক্ষাবিদ। তাঁর আশঙ্কা ছিল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য আলাদা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন।

পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য: তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মালব্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিপত্তির ক্ষতির আশঙ্কায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার বদলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে শক্তিশালী করা উচিত। সকল তথ্য-উপাত্তের আলোকে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা তো করেনইনি, বরং প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উদ্যোগী ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাঁর আমৃত্যু অটুট বন্ধন ছিল।

তথ্যসূত্র:

১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথ, বিচারপতি
ওবায়দুল হাসান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ, ঢাকা, দৈনিক প্রথম
আলো, ০২ জুলাই ২০২১।

২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা, সৈয়দ আবুল মকসুদ।

৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন যারা, ফারহানা পারভীন,
বিবিসি বাংলা, ঢাকা, ১লা জুলাই ২০১৮।

৪. ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা প্রদানের ঘটনা,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা।

৫.পলিটিক্স অব পাবলিক স্পেস: ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট,
পৃষ্ঠা ১৪০-১৫০, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ২০০৫।

৬. রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সময়, নির্মল বসু, ১৯৮৮।

৭. সঞ্চয়িতা, অষ্টম মুদ্রণ, প্রতীক প্রকাশন সংস্থা, পৃষ্ঠা ৩৩১।

৮. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: প্রতিষ্ঠা ও প্রথম যুগ, মহিউদ্দিন আহমদ।

৯. প্রাচীন ঢাকা ও তার সামাজিক রাজনীতি, রনজিত দাসগুপ্ত, কালিকা
প্রকাশনী,১৯৮৫।

১০. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্কাইভ।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *