আন্তর্জাতিক

‘গ্যাসর লাই তিনদিন ধরি ঘরত ভাত হাইত নফারির’

ডেস্ক রিপোর্ট: ‘কি হইতাম ভাই! আজিয়ে তিনদিন ধরি ঘরত ভাত হাইত নফারির। রেস্টুরেন্টত্তুন অর্ডার গরি পার্সেল আনি হাইজ্জি। আর গাড়ির হতা কি হইয়ুম। রাস্তাত বাস ত নাই। রিকশাত গরি আইয়ুন পরেদ্দে। সিএনজি নাই কিচ্ছু নাই। আধা ঘন্টা তিয়ে তাহি আইস্সি।’ (কি আর বলব! তিনদিন ধরে ঘরে ভাত খেতে পারছি না। রেস্তোরাঁ থেকে পারসেল অর্ডার করে খেতে হচ্ছে। রাস্তায় বাস নাই। রিকশা করে আসতে হচ্ছে। আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে মুরাদপুর আসছি।)

শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) বিকেলে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় দাঁড়িয়ে এভাবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় নিজের কষ্টের কথা বার্তা২৪.কম‘র প্রতিবেদককে জানাচ্ছেন যুবক আরশ বিন রাকিব।

চট্টগ্রামজুড়ে গ্যাস সংকট চলছে দীর্ঘদিন। নগরীর বেশিরভাগ এলাকায় প্রায় দিনভর বন্ধ গ্যাস সরবরাহ থাকত। আবার কোথাও সকালে থাকলে দুপুরে বা বিকেলে নাই হয়ে যেত। গ্যাস সংকটের ভোগান্তি নগরবাসীর জন্য বহু পুরোনো। তবে এবারের ভোগান্তি যেন সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেল। শুক্রবার সকাল থেকে চট্টগ্রামের কোনো লাইনেও গ্যাসের দেখা মিলছে না। ফলে বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে সিএনজিচালিত গাড়িতেও এর প্রভাব পড়েছে। দিনভর ঘরে-বাইরে দুর্ভোগ নগরবাসীর।

চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় শীত মৌসুমের শুরু থেকেই গ্যাসের সংকট শুরু হয়। কিছু কিছু এলাকায় গ্যাস থাকলেও বেশিরভাগ এলাকায় সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাস থাকত না। কিন্তু মহেশখালীর এলএনজি (তরলীকৃত ন্যাচারাল গ্যাস) সরবরাহের এফএসআরইউয়ের (ফ্লোটিং স্টোরেজ রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট) কারিগরি ত্রুটির কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় শুক্রবার সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। (এ তথ্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়।) পাশাপাশি চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডও (কেজিডিসিএল) তাদের ওয়েবসাইটে একই বিষয়টি জানিয়েছে।

এদিকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের কারণে চট্টগ্রামের প্রায় বাসা-বাড়িতে সকালে থেকে রান্না বন্ধ রয়েছে। কেউ কেউ আবার অস্থায়ী মাটির চুলা বসিয়ে কোনো মতে রান্না করেছে। আবার অনেককে নগরীর বিভিন্ন হোটেল থেকে খাবার কিনে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

গতরাত থেকে গ্যাস না থাকায় রান্না হয়নি। দুপুরেও রান্না না হওয়া ছোট বোনকে নিয়ে হোটেলে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ওপি। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘গতকাল সন্ধ্যা থেকে গ্যাস নেই বাসায়। রাতে রুটি পাউরুটি কিনে খেয়েছিলাম। আজকে তো আর ভাত না খেয়ে থাকতে পারব না। তাই ভাত নিতে আসছি।’

মুরাদপুরের এক রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখা যায় ২ ঘণ্টার মধ্যে সব খাবার শেষ। ওই রেস্তোরাঁর কর্মচারী ইরফান করিম বলেন, ‘আমাদের হোটেলে প্রতিদিন খাবার আসে ৮টায়। গ্যাস না থাকায় আজকে খাবার আসছে দুপুর ১২টায়। এর মধ্যেও মাত্র দুই ঘণ্টার ভেতর সব খাবার শেষ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ পারসেল নিয়েছে।’

একই রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার সময় ঐশী নামের এক মেয়ে বলেন, ‘গতকাল রাতে বাসায় অনেক কষ্ট করে ইট দিয়ে রান্না করছে। বাসায় ছোট বাচ্চা আছে। আমি ত করিনি আমার মামি করছে। আমরা কোনোভাবে খাইলাম। পাশের বাসায় ওদের জন্যও রান্না করছে। আমার মায়ের বাসায়ও গ্যাস না থাকায় খেতে পারে নাই ওরা। এখন পর্যন্ত রান্না হয়নি। বাসা থেকে বের হয়েছি ১১টায়, এখনো বাসায় যায় নি। দুপুরে খাবারের বদলে দোকানে এসে জিলাপি খাইলাম।’

চকবাজার এলাকার এক খাবার হোটেল মালিক বলেন, ‘আজকের সারাদিন গ্যাস না থাকায় ক্রেতা বিক্রেতা সবারই দুর্ভোগ। যেমন আজকের সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়াতে এলপিজি গ্যাসের দোকান বন্ধ। তাই আমরা রান্না করতে পারি নাই। দোকানে খাবারের আয়োজন করতে পারি নাই।’

শুধু খাবারেই নয়, এই দুর্ভোগ ছিল নগরের গণপরিবহনেও। গ্যাস না থাকায় নগরীর বেশিরভাগ গ্যাস পাম্প বন্ধ ছিল সকাল থেকে। ফলে নগরীর সড়কগুলোতেও তেমন সিএনজি বা গ্যাসচালিত পরিবহন চোখে পড়েনি। ছুটির দিনে ঘুরতে বা জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তিতে পড়ছে হয়।

নগরীর কাঠগড় থেকে অক্সিজেন যাচ্ছেন কলেজ পড়ুয়া মনিকা। মুরাদপুর পর্যন্ত এসেছে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন গাড়ির জন্য। জানতে চাইলে তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি গাড়ির জন্য। একটি আসলে সেটিতের ওঠার প্রতিযোগিতা চলে। ওঠা-নামা ১০ টাকা করে নিচ্ছে।’

মুরাদপুরে রুবেল নামের এক টেম্পু চালক বলেন, ‘পাঁচদিন ধরে ঠিক মত গাড়ি চালাতে পারতেছি না। গ্যাসের জন্য সিরিয়াল দিয়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। গতকাল বিকেলে গ্যাস নিয়েছিলাম। আজকে সকালে গ্যাস পাম্পে গিয়ে দেখি গ্যাস নাই, পাম্প বন্ধ। গতকালেরগুলো দিয়ে এখন চালাচ্ছি। যতক্ষণ চালাতে পারি। এরপর বন্ধ করে বসে থাকতে হবে।’

নগরীর চকবাজার এলাকায় গিয়ে কথা হয় সিএনজি চালক মোহাম্মদ সাইফুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কি করব। গতরাতেও পাইনি। আজকে সকালেও গিয়েও পাম্পে গ্যাস নাই। তাই বাধ্য এএলপি গ্যাস ঢুকিয়ে চালাতে হচ্ছে। না হলে না খেয়ে মরতে হবে।’

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী আমিনুর রহমানের কাছে গ্যাস সরবরাহ কবে স্বাভাবিক হবে জানতে চাইলে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘রাত ১০টায় মোটামুটি একটু ভালো পরিস্থিতি হতে পারে। গ্যাস সরবরাহ লাইনে পুরোপুরি ঢুকতে পারে। আর ১২টার ভেতরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করা যায়।’

মূলত চট্টগ্রাম অঞ্চলে কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান দুটি টার্মিনাল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এই দুটি টার্মিনালের একটির নির্মাতা মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জি, অন্যটি নির্মাণ করেছে সামিট গ্রুপ।

কেজিডিসিএল জানিয়েছে, দুই টার্মিনালের মধ্যে এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি ১ নভেম্বর থেকে সংস্কারের জন্য বন্ধ ছিল। ওই টার্মিনালটি বিচ্ছিন্ন করে সেসময় সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়েছিল সংস্কার করতে। সেটি কয়েকদিন আগে দেশে আনা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি গ্যাস সরবরাহের জন্য যুক্ত করার পর সামিটের টার্মিনালটি খুলে নেওয়া হয়। সংস্কারের জন্য সেটিও সিঙ্গাপুর পাঠানোর কথা রয়েছে। কিন্তু সরবরাহ চালুর পর এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালে কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এ কারণে এই টার্মিনাল থেকেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।

কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী আমিনুর রহমান জানিয়েছেন, সিঙ্গাপুর থেকে বিশেষজ্ঞ টিম এসেছে ত্রুটি সমাধানের কাজ করছে। এর মধ্যে কিছু জায়গায় গ্যাস সরবরাহ শুরুও হয়েছে। তবে চাপ কম।

কেজিডিসিএলের মোট গ্রাহক সংযোগ রয়েছে ৬ লাখ ১ হাজার ৯১৪ টি। এরমধ্যে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১ টি গৃহস্থালি সংযোগ ও বাকিগুলো বাণিজ্যিক। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা থেকে ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এখন গ্যাস না থাকায় এই বিপুল সংখ্যক গ্রাহক ভোগান্তিতে পড়েছেন।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *