আন্তর্জাতিক

প্রশ্নবিদ্ধ-গণমাধ্যম

ডেস্ক রিপোর্ট: ভালো কথা, বাংলাদেশেও দেখছি সরকারি প্রচার মাধ্যম তো অবশ্যই, ব্যক্তিমালিকানাধীন গণমাধ্যমও সরকারের হয়েই প্রচার চালায়; সরকার-বিরোধীরা প্রশ্রয় পায় না। গণমাধ্যমের প্রচারে উন্নতির খবর পাওয়া যায়, দুর্দশার খবর ও কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে থাকে।

প্রচারের শক্তির চেয়েও অধিক শক্তিশালী হচ্ছে মতাদর্শের শক্তি। প্রচার অস্থায়ী, মতাদর্শ স্থায়ী। প্রচার পারে অত্যাচারকে আড়াল করে রাখতে, মতাদর্শ ইচ্ছা করলেই পারে মানুষকে আটক করে রাখতে। মতাদর্শকে রক্ষা করার জন্য মানুষ প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত থাকে; এবং প্রাণ দেয়ও।

মতাদর্শ অবশ্য দু’রকমের হয়। প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল। প্রগতিশীল মতাদর্শ বন্দি করে না মুক্তি দেয়, মানুষকে এগিয়ে নেয় মুক্তির অভিমুখে। ব্যক্তিকেই এগিয়ে নেয় বটে, কিন্তু কাজটা করে সমষ্টির ভেতরে থেকে এবং সমষ্টিকে সঙ্গে নিয়ে। তবে প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শেরই আকর্ষণ অধিক। কারণ ব্যক্তির ভেতর সুপ্ত থাকে স্বার্থপরতার যে বোধ তাকে সে উত্তেজিত করে, জাগিয়ে তোলে, ভাবতে শেখায় যে ব্যক্তিমালিকানাতেই বাস করে সর্বোচ্চ সুখ। ব্যক্তি যদি বিচ্ছিন্ন হয় তবে সে যে পক্ষ ধরে আত্মকেন্দ্রিকতার, নদীর ঢেউ না হয়ে এগিয়ে চলে পাড়ের বালুকণায় পরিণত হবার দিকে, সেই সত্যটা বেমালুম ভুলিয়ে দেয়।

প্রতিক্রিয়াশীলতা রং ঢং জানে, নিজেকে সাজাতে পারে নানান সাজে, কারণ তার চরিত্রটাই হচ্ছে প্রতারণার, লোক দেখানোর ও লোক ঠকানোর, জাদুকরেরা যেমনটা করে থাকে নিজেদের ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য। প্রগতিশীলতা সে কাজ পারে না। তার দায়িত্ব থাকে সত্য বলার এবং সত্যই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় এটা সত্য হলেও পথিমধ্যে আপাত-সুন্দর মিথ্যার মোহবিস্তারের ব্যাপারটা চলতে থাকে। বিশ্বে এখন যে মতাদর্শের কর্তৃত্ব চলছে তার নাম পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ এক সময়ে প্রগতিশীল ছিল, যখন সামন্তবাদের নিগড় ভেঙে সে পথ করে দিয়েছিল মানুষের জন্য মুক্তির; কিন্তু এখন সে তার প্রগতিশীলতা খুইয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে। তাই তো দেখি ইসরায়েল যখন ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালায় তখন পুঁজিবাদী বিশ্বের শাসকশ্রেণি প্রতিবাদ করবে কী উল্টো তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকে। সর্বাধুনিক অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে।

পিঠ চাপড়ে দেবার জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সশরীরে অকুস্থলে গিয়ে হাজির হন, এবং বিলম্ব না করে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকও দৌড় দেন; ইরাক আক্রমণের সময়ে জর্জ বুশের পিছু পিছু যেভাবে ছুটেছিলেন জন ব্লেয়ার। তাদের মোটেই মনে পড়ে না যে ফিলিস্তিনিরা লড়ছে তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত ও রক্ষা করার জন্য, আর ইসরায়েলিরা যা করছে তা হলো জবরদখলের এলাকাটাকে আরও বাড়ানোর চেষ্টা ভিন্ন অন্যকিছু। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ফিলিস্তিনিদের জন্য বোমার চাইতেও ভয়ঙ্কর যে বিপদ অপেক্ষা করছে সেটা হলো রোগের বিস্তার। ইতিমধ্যে হাসপাতালগুলো ধ্বংস হয়েছে, এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। বিশ্বখাদ্য সংস্থা শুনতে পাচ্ছে গাজাতে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি।

ইসরায়েল গাজাতে যে ভাবে মানুষ, বিশেষ করে শিশু হত্যা ঘটিয়ে চলেছে তা গণহত্যা ভিন্ন অন্যকিছু নয়, কিন্তু মিডিয়া তাকেই বলছে যুদ্ধ। বলে চলেছে যে সন্ত্রাসীদের দল হামাসের দলের সঙ্গে ইসরায়েলি নিয়মিত সেনাদের সংঘর্ষ বেঁধেছে। অথচ হামাস নয়, লড়ছে সকল ফিলিস্তিনিই, জবরদখলের বিরুদ্ধে। গাজা একটি কারাগার। গাজাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বোমার আতঙ্কে মানুষ সেখান থেকে পালাতে চায়। কিন্তু পালাবার জায়গা নেই, পথও নেই খোলা। সকল পথ অবরুদ্ধ। ফিলিস্তিন তো ফিলিস্তিনিদেরই আবাস। জর্ডান নদী এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে ঐতিহাসিক ভাবে অত্যন্ত মূল্যবান এই ভূখ-ে মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি সবাই সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে, এটাই হবার কথা ছিল। হয়নি। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইহুদিদের জন্য একটি বাসভূমি স্থাপনের ‘প্রয়োজনে’, মূলত কর্তৃত্বকারী ব্রিটিশের উদ্যোগে, ফিলিস্তিনের একটি অংশ কেটে নিয়ে ইসরায়েল নামে একটি ইহুদি বর্ণবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে ইসরায়েল তার দখলদারিত্ব বাড়াতে থাকে, এবং ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনিদের ২২ শতাংশ ভূমি ইসরায়েলের দখলে চলে গেছে। এখন তো মনে হয় ফিলিস্তিনিদের বসবাসের এলাকাটুকুও দখল করে নেবে।

মিডিয়া কখনোই নিরপেক্ষ নয়। সবসময়েই ক্ষমতাবানদের পক্ষে। তাই দেখি ইউক্রেনে রুশ হামলায় ২ জন মানুষ মারা গেলে মস্ত বড় খবর হয়, কিন্তু ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে গাজার হাসপাতালে যখন এক লহমায় ৫০০ মানুষ প্রাণ হারায়, যাদের অধিকাংশই শিশু ও নারী, তখন তা দাঁড়ায় একটা সংখ্যা মাত্র। মার্কিন গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে লেখা ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি বুদ্ধিজীবীদের একটি ‘খোলা চিঠি’তে যে প্রশ্নটা করা হয়েছে তা সহস্র সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হতো, বিশ্ববিবেক বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব যদি এখন সত্যি সত্যি থাকতো তাহলে। ‘খোলা চিঠি’টিতে প্রশ্নটা এই রকমের : “কেন আমরা সাংবাদিকতার জায়গা থেকে চাপ প্রয়োগ করছি না, কেনই-বা আমরা গাজায় যুদ্ধাপরাধের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের বানোয়াট ছবিগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলছি না?”

ইসরায়েলির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন যে ফিলিস্তিনিরা মানুষ নয়, মনুষ্যবেশধারী জানোয়ার বটে। মন্ত্রীর কথাটা এমন ভাবে প্রচার করা হয়েছে যেন ওটি কোনো ইতর প্রাণির আওয়াজ নয়, বীরের উক্তি।

বিবেকবান মানুষদের দিক থেকে প্রতিবাদ অবশ্য হচ্ছে। বিশ্বব্যাপীই হচ্ছে। তবে তা আগের দিনের মতো প্রবল নয়। প্রতিবাদের সংবাদ আবার প্রচারও পাচ্ছে না। খোদ ইসরায়েলেই প্রতিবাদ হয়েছে। হয়েছে রাষ্ট্রীয় হুমকির মুখেই। ইসরায়েলে বসবাস করে ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করায় বিক্ষোভকারীদেরকে ফিলিস্তিনে পাঠিয়ে দেয়া হবে বলে জানিয়েছে সে দেশের পুলিশ। ৬৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রথম পর্যায়েই। ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য ক্ষোভে পদত্যাগ করেছেন বাইডেনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন। উল্টো দিকে আবার ইংল্যান্ডের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন এই অভিযোগে যে, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে যারা বিক্ষোভ করছে তাদেরকে তিনি যথেষ্ট পরিমাণে দমন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

‘ইয়থ ম্যাটার্স’-এর জরীপে শতকরা ৭৫.৫ জানিয়েছে যে বাংলাদেশে তারা নিজেদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেই নিশ্চয়তা বোধ করে না। ৭১.৫ শতাংশের মতে মতপ্রকাশের ব্যাপারে তাদের ভেতর ভয় কাজ করে। ৫০ শতাংশের দেখতে পাচ্ছে দেশে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ নেই। ৮৮.৯ শতাংশের মতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। শতকরা ৬৮ জনের ধারণা গত পাঁচ বছরে অবস্থার উন্নতি নয়, অবনতিই ঘটেছে। তবে এসবের মধ্যেও ৪৮.৭ শতাংশ তরুণ কিন্তু জানিয়েছে যে ভবিষ্যতে তারা উদ্যোক্তা হতে চায়। এটা খুবই ভালো কথা। সংখ্যাটা আরও বড় হলে আমরা আরও উৎফুল্ল হতাম। কিন্তু আমরা জানি যারা উদ্যোক্তা হতে চায়, তারাও পারবে না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীরা যে পাঠ্যবইয়ের খোঁজ না করে বিসিএস পরীক্ষায় কাজে লাগবে এমন বই পড়তে যায় তার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়, দায়ী সেই ব্যবস্থা যা তাদেরকে উদ্যোক্তা হতে নিষেধ করে; বলে সরকারি চাকরির চেষ্টা করো, না-পারলে বেকার থাকো। হতাশায় নিমজ্জিত থাকো। তাহলেই তারুণ্যের বিদ্রোহের শক্তি-সাহস আর থাকবে না, শাসকদের অভীষ্ঠ লক্ষ্য তো সেটাই।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *