সারাদেশ

বন্ধের পথে ই-টিকিটিং মেশিন: বিফলে প্রকল্প

ডেস্ক রিপোর্ট: আগামী ৮ মার্চ ঢাকা থেকে ফ্লাইট পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স। ফ্লাইট পরিচালনার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে এয়ার সার্ভিস এগ্রিমেন্টও স্বাক্ষর করে ফেলেছে।

জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে তারা সপ্তাহে ৫টি ফ্লাইট পরিচালনা করবে। এই সংখ্যা পরে আরো বাড়ানো হবে। ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে সরাসরি আদ্দিস আবাবা হয়ে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্বের নানা গন্তব্যে যাত্রী নিয়ে যাবে তারা। বলা হচ্ছে ‘পে লোকাল, ফ্লাই গ্লোবাল’ এই মূলমন্ত্রে যাত্রীদের আকৃষ্ট করার জন্য মার্কেটিং করা হচ্ছে। আফ্রিকা মহাদেশের শীর্ষ এই এয়ারলাইন্সটি ঢাকা থেকে যাত্রী পরিবহন শুরু করলে বিমান চলাচল খাতে নাকি নতুন মাত্রা যোগ হবে। ঢাকায় এর জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) হিসেবে থাকছে রিদম গ্রুপ।

আফ্রিকা মহাদেশের গরীব দেশ ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের এই ফ্লাইট পরিচালনায় বাংলাদেশের কি লাভ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে বার্তা২৪.কম। আর এই অনুসন্ধানের খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এতে দেশীয় স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে নাকি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

যে-সব বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ এ ধরনের যত্রতত্র বিদেশি এয়ারলাইন্সের পক্ষে কথা বলে থাকেন, তারা বরাবরই একই ধরনের বক্তব্য দেন। এবারও তারা সেই সুরেই বলছেন, সাধারণ যাত্রীরা কম মূল্যে টিকেট পাবেন। এতে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা হবে, যার ফলে লাভবান হবে সাধারণ যাত্রীরা।

যাত্রীদের এই বিষয়টি মাথায় রেখেই ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সটি ‘পে লোকাল, ফ্লাই গ্লোবাল’ মন্ত্র নিয়ে নতুন মার্কেটিং কৌশলে মাঠে নেমেছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সস্তা স্লোগান কিংবা যাত্রীদের কম মূল্যের টিকেটের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে রমরমা ব্যবসা হবে এমনটিই আশা করছে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স। বাস্তবে বাংলাদেশের আদৌ কি কোনো লাভ হবে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকাতে দুই লাখের বেশি বাংলাদেশি বসবাস করছেন। অবৈধদের সংখ্যা হিসেব করলে এই সংখ্যা আরো বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থ বছরে যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে তার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থান ছিল ১২। এই দেশ থেকে ৩১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স আসে।

দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও মোজাম্বিক, মরিশাস, লিবিয়া, সুদানে বাংলাদেশিরা রয়েছেন। যদিও সবমিলিয়ে এই সংখ্যা খুব বেশি নয়।

বিমানের মার্কেটিং বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের সূত্রে জানান, শুধু আফ্রিকার সুনির্দিষ্ট দেশগুলোতে বছরে কয়েক লাখ বাংলাদেশি যাতায়াত করেন। এই যাত্রীদের সবাইকেই টার্গেট করছে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স। শুধু আফ্রিকা মহাদেশই নয়, ঢাকা থেকে সৌদি আরব, ওমান, কাতার, কুয়েত, আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ যে-সব দেশে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক থাকেন তাদেরও টার্গেট করছে আফ্রিকা মহাদেশের এই এয়ারলাইন্সটি।

কম মূল্যে টিকেট বিক্রির মন্ত্র নিয়েই এসব যাত্রীকে আকৃষ্ট করবে ইথিওপিয়ান। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই থাকেন ২০ লাখ বাংলাদেশি। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে থাকেন আরো ১০ লাখের বেশি বাংলাদেশি। এই বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশিকে টার্গেট করে ঢাকা থেকে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স।

ইথিওপিয়ান এয়ার বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ এয়ারলাইন্স, তাই আদ্দিস আবাবা থেকে লন্ডন, টরন্টো রুটে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। অন্যদিকে বিমান এইসব রুটে সপ্তাহে দুই থেকে চারদিনের বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করে না। যখন ইথিওপিয়ানের মাধ্যমে সপ্তাহের ৭দিনই মানুষ উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের গন্তব্যগুলোতে যেতে পারবে, তখন তারা সহজেই ইথিওপিয়ানকেই বেছে নেবে।

বিমানের এক কর্মকর্তা বলেন, এক সময় পার্শ্ববর্তী ভারতেও বিমান ইচ্ছেমতো যাত্রী নিয়ে যেতে পারতো না। দেখা গেছে, প্রতি ফ্লাইটে ১৫০ এর বেশি যাত্রী হলে যাত্রী প্রতি একটি লেভী দিতে হতো। এভাবে বিভিন্ন দেশ তাদের স্বার্থ সুরক্ষা করে অন্যদের ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয়।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৮০’র দশকেও ঢাকা থেকে বিভিন্ন বিদেশি গন্তব্যে যে যাত্রী পরিবহন হতো তার ৭৫ শতাংশের বেশি যাত্রী বিমান পরিবহন করতো। আর এখন বিমান, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স মিলিয়ে ২৫ শতাংশ। যেভাবে একের পর এক বিদেশি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকা এয়ারলাইন্সসমূহকে ঢাকা থেকে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে খুব শিগগির বিমান ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের যে ২৫ শতাংশ মার্কেট রয়েছে তাও ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

বেসামরিক বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, যখন দুটি দেশের মধ্যে এয়ার সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর হয়, তখনই কোন দেশ কতগুলো ফ্রিকোয়েন্সি পাবে তা চূড়ান্ত হয়। এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ই এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে সেই বিষয়টি তখনই চুক্তির ধারায় উল্লেখ থাকতে হয়।

‘যে অ্যাগ্রিমেন্টই হোক না কেন, দেশের স্বার্থ বিশেষ করে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর স্বার্থকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। নতুবা আপনি এই চুক্তির মাধ্যমে কিছু পাবেন না। তাই যারা এই চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে জড়িত তাদেরকে বিমান চলাচল বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা চাই। তা না হলে এই ধরনের নেগোসিয়েশনে আপনি হেরে যাবেন। আপনি হেরে যাওয়া মানে বাংলাদেশই হেরে যাওয়া,’ যোগ করেন তিনি।

তবে এ বিষয়ে কেউ কেউ বিমান কিংবা ইউএস-বাংলার মতো দেশীয় এয়ারলাইন্সের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এটিএম নজরুল ইসলাম মনে করেন, দেশীয় এয়ারলাইন্সের সক্ষমতা বাড়াতে সরকারকে কাজ করতে হবে। অন্যথায় বিশ্বের শীর্ষ এয়ারলাইন্সগুলোকে যখন অবাধে এখান থেকে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হবে তখন দেশীয়দের পক্ষে সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। এতে যাত্রী হারাবে বিমান ও ইউএস-বাংলার মতো এয়ারলাইন্সগুলো।

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজিম বার্তা২৪.কমকে বলেন, এ ধরনের অ্যাগ্রিমেন্ট হওয়ার আগে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া উচিত। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যদি বিমান ফ্লাইট করতে চায়, সেইসব দেশের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্সের সবুজ সংকেত ছাড়া কেউই ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পায় না। আবার যদি কেউ অনুমতি পায়ও তাহলে দেখা যাবে, প্রাইম টাইমে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয় না। গভীর রাতে অথবা ভোররাতে ওইসব দেশে ফ্লাইট অবতরণ ও উড্ডয়নের অনুমতি মেলে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *