মতামত

‘বিরোধী দল খোঁজার নির্বাচন’ নয়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রত্যাবর্তনের আয়োজন

বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি ২০২৪ যা ঘটার আয়োজন করা হয়েছে, সরকারি দল তাকে নির্বাচন বলে অভিহিত করছে। কিন্তু একে যে নির্বাচন বলার অবকাশ নেই তা মনোনয়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে আসন ভাগাভাগিতেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান, গত দেড় বছর ধরে যিনি বলে আসছিলেন যে, ক্ষমতাসীনরা কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে, তারা সব কিছু দখল নিতে চায় এবং তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় সেই দল ঐ একই নেতার ভাষায় ‘ভিক্ষার সিট’ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের শরিকরা কীভাবে নির্বাচন গেছেন তা সকলেই অবহিত – তাদের অনুনয়ে কাজ হয়নি, গত নির্বাচনে যত আসন পেয়েছিলেন তার অর্ধেকের কম বরাদ্দ পেয়েই তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায় যা ‘নূহের নৌকা’ তাতে উঠে পড়েছেন। অন্যদের কথা আলোচনারও দরকার হয়না। কথিত কিংস পার্টিগুলো ও সেগুলোর নেতারা কে কোথায় আছেন কেউ জানেন বলে মনে হয় না।

এই প্রেক্ষাপটে যে কথাটি এখন মুখে মুখে তা হলো এই নির্বাচন হচ্ছে ‘বিরোধী দল খোঁজার নির্বাচন’। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন সম্প্রতি সিজিএস আয়োজিত আলোচনায় এই কথাটি সুস্পষ্ট করেই বলেছেন। অবস্থা দৃষ্টে এটা ঠিক, এই কথার মর্মবস্তু বোঝা যায়। বাস্তবতা হচ্ছে এই কথিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় আওয়ামী লীগও এখন ঠেকাতে পারবে না। ‘বিরোধী দল’ খুঁজতে নির্বাচন হচ্ছে, আর সেই অনুসন্ধান প্রক্রিয়া বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত ৬ ডিসেম্বর বলেছেন ‘“দাঁড়িয়ে যাবে বিরোধী দল”।

কিন্তু গত কয়েক দশকে সারা বিশ্বের কোন গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দল খোঁজার জন্যে নির্বাচন হয়েছে কেউ কি বলতে পারবেন? একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী দল নির্বাচনে অংশ নিলে এই প্রশ্ন উঠতে পারে যে একটি দলের বিজয়ের সম্ভাবনা বেশি, প্রশ্ন হচ্ছে দ্বিতীয় হবে কোন দল। এখনকার অবস্থা তো তা নয়। সেই বিবেচনায় এই প্রশ্ন করা হচ্ছে না সেটা আমরা জানি।

 

যে সাংবাদিকরা বাংলাদেশের রাজনীতির বিশ্লেষকদের কাছে এই প্রশ্ন করছেন যে, ‘বিরোধী দল কারা হবে’ তারা আসলে ক্ষমতাসীনদের এই বয়ান বা ন্যারেটিভকেই স্বাভাবিক করছেন যে, দেশে যেন এখন বিরোধী দল বলে কিছু নেই, ক্ষমতাসীনরা এখন খুঁজতে বেরিয়েছেন। কিন্তু, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের বিরোধী দল নেই এই কথাকে বৈধতা দেয়ার দায়িত্ব সাংবাদিকরা কি জেনে বুঝে স্বেচ্ছায় নিচ্ছেন? বাংলাদেশে বিরোধী দল আছে কিনা সেটা আওয়ামী লীগের নেতা কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলে দিয়েছেন – বলেছেন বিএনপির ২০ হাজার নেতা-কর্মীকে কেনো আটক করা হয়েছে, তাদের কীভাবে নির্বাচনে আনার জন্যে ‘চেষ্টা’ করা হয়েছে। প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে লোককে দণ্ড দেয়া হচ্ছে। এর বাইরে নির্বাচন কমিশনে ১৪টি নিবন্ধিত দল যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। নিবন্ধিত নয়, কিন্তু রাজনীতির মাঠে সরব দলের উপস্থিতি আছে এমন দল অনেক। তারপরে এই প্রশ্ন কেন করছেন যে, ‘বিরোধী দল কারা হবে?’ প্রশ্ন যদি করতেই চান তা হলে প্রশ্ন করুন – ক্ষমতাসীনরা কাকে সংসদে বিরোধী দল সাজাতে চায়। তো সেই প্রশ্ন ক্ষমতাসীন দলের কাউকে করুন।

এই আয়োজন ক্ষমতাসীনদের, সেখানে জনগণের কোনও ভূমিকা নেই। বিশ্বাস না হয় নৌকার প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কথা শুনুন, ভোটের দরকার হবে না। প্রশ্ন করতে পারেন তা হলে এই যে ‘নির্বাচন-নির্বাচন’ ভাব হচ্ছে সেটা কী? সেটার একটা উত্তর নির্বাচনের আগেই সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট পত্রিকায় আছে– ফার্স, প্রহসন। আর যারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে আরেকটু গভীরভাবে দেখেন তারা বলবেন-এটি হচ্ছে বাংলাদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রত্যাবর্তনের আয়োজন।

[লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *