জাতীয়

ঘরে-বাইরে বড্ড একা নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সঙ্গী তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। জামায়াতবিরোধী কঠোর অবস্থান, নির্বাচন কমিশনকেন্দ্রিক বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ, শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা প্রচারিত হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে জাতীয় রাজনীতিতে আলোচনায় আসেন তিনি। এরমধ্যে সমপ্রতি দুই ছেলের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার জেরে সরকারকে উদ্দেশ্য করে ক্ষুদ্ধ বক্তব্যের জেরে আরও লাইমলাইটে চলে আসে নৌকায় চড়ে তিনবার সংসদে যাওয়া ভাণ্ডারী। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ফটিকছড়ির আসন থেকে ভাণ্ডারীই নৌকা পাচ্ছেন বলে ধরে নিয়েছিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও। তবে শেষ পর্যন্ত রহস্যজনক কারণে নৌকার বৈঠার নাগাল পাননি রাজনীতির এই গায়েবি পীর। আর এতেই অনেকটা নির্বাচনী ট্র?্যাক থেকে হারিয়ে গেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের লোকজনের সমর্থন তো পাচ্ছেনই না, নিজের পরিবার ও দলের লোকদের বড় একটি অংশও এড়িয়ে যাচ্ছেন ফুলের মালা গলায় দিয়ে এবারের সংসদে যাওয়ার দৌড়ে থাকা ভাণ্ডারীকে।

গত ৩০শে নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল বশর মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের হাতে মনোনয়নপত্র জমা দেন নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। সে সময় হাস্যোজ্জ্ব্বল ভাণ্ডারী এই নির্বাচনেও তার নৌকা প্রাপ্তি নিশ্চিত বলে উপস্থিত সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছিলেন। সে সময় তার সঙ্গে অন্যদের মধ্যে বাগানবাজার ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সাজু, হারুয়ালছড়ির চেয়ারম্যান ইকবাল চৌধুরী, পাইন্দংয়ের চেয়ারম্যান সরোয়ার হোসেন স্বপন, ভুজপুরের সাবেক চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ ছিলেন। তবে ভাণ্ডারী নৌকাবঞ্চিত হতেই রাতারাতি তারাও নেতা পাল্টে ফেলেন।

এখন এদের কেউ উঠেছেন খাদিজাতুল আনোয়ার সনির নৌকায়। আবার কেউ ভিড়েছেন হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈয়বের তরমুজ বাগানে। শুধু তারা নন, ফটিকছড়ির ১৮ জন চেয়ারম্যান ও দুইজন পৌর মেয়রের এখন কেউ নেই ভাণ্ডারীর সঙ্গে। এমনকি কোনো ইউপি মেম্বার বা পৌর কাউন্সিলরকেও কাছে পাচ্ছেন না জাতীয় রাজনীতিবিদ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী।

এদের মধ্যে ভাণ্ডারীর সঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যাওয়া শাহাদাত হোসেন সাজুর কাছ থেকে বর্তমান অবস্থান জানতে চাইলে তিনি  জানান, ‘সেদিন আমরা আরও কয়েকজন চেয়ারম্যান এমপি (ভাণ্ডারী) সাহেবের সঙ্গে মনোনয়নত্র জমা দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তো নৌকা পাননি। তাই আমরা এই মুহূর্তে উনার সঙ্গে কাজ করতে পারছি না। তবে উনার সঙ্গে আমার ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে। আমরা ফটিকছড়ির ১৬ জন চেয়ারম্যান আবু তৈয়ব ভাইয়ের সঙ্গে আছি। তিনিই আমাদের নেতা।’

নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর নির্বাচনী আসন চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) থেকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার সনিসহ মোট ৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে বর্তমানে ভোটযুদ্ধে এগিয়ে আছেন তরমুজ প্রতীকের প্রার্থী ও ফটিকছড়ি উপজেলার সদ্য পদত্যাগকারী চেয়ারম্যান আবু তৈয়ব। একসময় পুরো উত্তর চট্টগ্রামে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন আবু তৈয়ব। ছাত্রলীগের সাবেক এই জেলা সেক্রেটারির এখনও ফটিকছড়িতেই আছে নিজস্ব বাহিনী। ফটিকছড়ির আওয়ামী লীগের কমিটিতে থাকা অধিকাংশ নেতা বিরুদ্ধে থাকলেও শুরু থেকেই আবু তৈয়বকে কাছে পেয়েছিলেন ভাণ্ডারী। নিজের দল তরীকতের ফটিকছড়িতে কোনো অবস্থান না থাকলেও তৈয়বের লোকবলের উপর ভর করে টানা ১০ বছর ফটিকছড়ির রাজনীতিতে একচ্ছত্র প্রভাব রেখেছিলেন ভাণ্ডারী। আর এখন সেই তৈয়বও ভাণ্ডারীর সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন।

দেশের তরীকত পন্থিদের অন্যতম তীর্থস্থান বলে পরিচিত ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার দরবারে ১৯৫৯ সালের ২রা ডিসেম্বর নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর জন্ম। বাবা শফিউল বশর মাইজভাণ্ডারী ছিলেন এই দরবারের অন্যতম পীর। মূলত এই মাইজভাণ্ডার দরবারকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ভাণ্ডারী। আর এখন সেই রাজনীতিকে কেন্দ্র করে সেই দরবারেও অবস্থান হারিয়েছেন নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। এই দরবারের অন্যতম পীর ও সমপ্রতি নিবন্ধন পাওয়া দল সুপ্রিম পার্টির প্রধান সৈয়দ সাইফুদ্দিন মাইজভাণ্ডারী আসন্ন নির্বাচনে একতারা প্রতীক নিয়ে চাচা নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর সঙ্গে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন। ফলে আসন্ন নির্বাচনে দরবারের ভোটগুলোও সম্পূর্ণভাবে পাচ্ছেন না নজিবুল বশর। জায়গা সম্পদের বিরোধকে কেন্দ্র করে সাইফুদ্দিন মাইজভাণ্ডারীর আপন ভাই ও বোনদের নজিবুল বশরের কাছে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও পরিবারের অনেকেই প্রকাশ্যে ফুলের মালার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এদের অনেকেই আবার নৌকা ও তরমুজের পক্ষে কথাবার্তা বলছেন।

জানা যায়, শুধু আওয়ামী লীগ ও নিজ পরিবারে বঞ্চিত হচ্ছেন এমন নয়- নিজের হাতে গড়া তরীকত ফেডারেশনের ফটিকছড়ি শাখার নেতাকর্মীদেরও সেভাবে সহযোগিতা পাচ্ছেন না নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। এদের অনেকে এখন নিষ্ক্রিয়, অনেকে আবার গোপনে নৌকা, তরমুজ ও একতারার পক্ষে কাজ করছেন। এদের মধ্যে ভুজপুর থানা তরীকতের সভাপতি হাফেজ বেলাল উদ্দিন স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু তৈয়বের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন, এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দীর্ঘদিন ধরে ফটিকছড়ি উপজেলা তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে কাজ করা বেলাল উদ্দিন শাহকেও দেখা যাচ্ছে না ভাণ্ডারীর নির্বাচনী কাজকর্মে।

এদিকে দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী নীরব থাকলেও ভাণ্ডারীর এই দুঃসময়ে অনেকটা একাই লড়ে যাচ্ছেন তরীকত ফেডারেশনের নাজিরহাট পৌরসভার সভাপতি মোহাম্মদ শাহজালাল। ফটিকছড়ির বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ভাণ্ডারীর মানুষ বলে পরিচিত শাহজালাল ফুলের মালার পক্ষে বিভিন্ন জায়গায় লিফলেট বিতরণ ও প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাকে ভাণ্ডারীর নির্বাচন পরিচালনায় গঠিত ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সদস্য সচিবও করা হয়েছে। ভাণ্ডারীর নির্বাচনী কার্যাক্রম নিয়ে জানতে শাহজালালকে ফোন দেয়া হলে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় আছেন বলে সংযোগ কেটে দেন। এরপর তার মোবাইলে আর সংযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি।

সুয়াবিল ইউনিয়নের তরীকতের ফেডারেশনের আহ্বায়ক মাহবুবুল আলম বলেন, ফুলের মালায় ভোট চেয়ে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও বাজারে আমরা গণসংযোগ করেছি। আমাদের নির্বাচনী কমিটি যে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে সেটা অনুসারে কাজ করছি। আমরা এখনও আশা রাখছি, আমাদের নেতার ‘নীরব’ জয় হবে। আর তরীকত নেতাকর্মীদের প্রতি ভাণ্ডারী সাহেব কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। এরমধ্যে একটা হলো- কারও সঙ্গে ভোট নিয়ে ঝগড়া বা কথাকাটাকাটিতে লিপ্ত হওয়া যাবে না।

এদিকে চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী মানবজমিনকে বলেন, ‘ফটিকছড়িতে তো আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এখানে আমি সবার অভিভাবক। নেত্রীর (শেখ হাসিনা) কথায় এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। দেশ ও জাতির স্বার্থে ভোটে আছি। কেন না আমি সরে গেলে অন্যরকম পরিস্থিতি তৈরি হতো।’

তিনি বলেন, ‘আমি তো প্রথমে চেয়েছিলাম আমার সব প্রার্থীকে নিয়েই নির্বাচন থেকে সরে যেতে। পরে নেত্রী আমাকে অনুরোধ করেছেন না যেতে। তিনি বলেছিলেন, আমি সরে গেলে অন্যরা সুযোগ  নেবে। দেশদ্রোহী শক্তি আস্কারা পাবে। যে কারণে আমি সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। আমু ভাই, কাদের ভাই, হাছান মাহমুদ ভাইও আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। তবে আমি নির্বাচনের পর সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলবো। আর আগামী বারও শেখ হাসিনা সরকার গঠন করছেন- সেটা ধরে নেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *