সারাদেশ

টুঙ্গিপাড়ায় নির্বাচনী জনসভায় যোগ দিয়েছেন শেখ হাসিনা

ডেস্ক রিপোর্ট: নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ করে নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টিকে (বিএসপি) যতটা না স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল, তারচেয়ে বেশি সরকারের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দল হিসেবে ভাবা হচ্ছিল। তারা নিজেদেরকে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে দাবি করে, ‘কিংস পার্টি’ বললে নিজেদের অস্বস্তির কথা জানায়। তবে দলগুলো সরকার-দল আওয়ামী লীগের অনেকটা উপকারই করেছে। নির্বাচনে এসেছে, এবং বিএনপির বেশ কিছু নেতাকে নির্বাচনে নিয়েও এসেছে। যদিও আখেরে কেমন হবে ফল, এনিয়ে সন্দেহ আছে, তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে তারা বড় ভূমিকা পালন করছে।

এরবাইরে আছে আরেকটা দল; বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। এই দলটি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী জোটের অংশ ছিল। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগে ভোল পালটে তারা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কল্যাণ পার্টির প্রতিষ্ঠা হয় ওয়ান-ইলেভেনের সময় সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে। মাইনাস-টু ফর্মুলা কার্যকরের চেষ্টার সময়ে দলটির জন্ম। মুহাম্মদ ইবরাহিমের দলটি প্রকৃতই কিংস পার্টি; কারণ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাদের জন্ম, বিকাশ এবং বর্তমান সরকারের আমলে এসে শেষ মুহূর্তে তারা খুঁজেছে সরকারের আশ্রয়।

মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের আসনভিত্তিক ‘সমঝোতা’ হয়নি ঠিক, তবে এই মুহূর্তে তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থনে আছেন নির্বাচনের মাঠে। আওয়ামী লীগ এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলমকে মনোনয়ন না দিয়ে মনোনয়ন দিয়েছিল সালাহউদ্দিন আহমেদকে। কিন্তু তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে এই আসন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের কোনো প্রার্থী নেই। জাফর আলম স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন, কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ জানাচ্ছে কেন্দ্রের নির্দেশ আছে মুহাম্মদ ইবরাহিমের পক্ষে কাজ করার, যদিও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সমর্থন দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি।

মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান রঞ্জন ছিলেন বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য। তিনি কোন কিংস পার্টিতে যোগ না দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। কিশোরগঞ্জ-২ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ মনোনয়ন পাননি। আওয়ামী লীগ এই আসনে নতুন একজনকে মনোনয়ন দিয়েছে, এবং মনোনয়নবঞ্চিত এক আওয়ামী লীগ নেতাও স্বতন্ত্রভাবে করছেন নির্বাচন। তবে এই আসনের বর্তমান এমপি নিজের দলের কোন নেতাকে সমর্থন না দিয়ে সমর্থন দিয়েছেন বহিস্কৃত বিএনপি নেতা মেজর আখতারুজ্জামানকে। এছাড়া মেজর আখতারুজ্জামানের পক্ষে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বাধ্য করছে বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. সোহরাব উদ্দিন।

বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই বিএনএমের হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন—এমন হাঁকডাক ছেড়ে শেষ পর্যন্ত বড়ধরনের কিছু করতে পারেনি দলটি। তবে সাবেক পাঁচ সংসদ সদস্য ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামানকে নির্বাচনে নিয়ে এসেছে দলটি। নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন ডলি সায়ন্তনীর মতো তারকা সংগীতশিল্পী, যিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিএনএমের প্রার্থীদের কোন আসনে সরকার-দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ছাড় পাওয়ার তথ্য গণমাধ্যমে আসেনি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা কিছু এলাকায় কিংস পার্টি হিসেবে আখ্যা পাওয়া এই দলের প্রার্থীদের পক্ষ কাজ করছেন বলে গণমাধ্যমের খবর। নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)। এই দলটি কোন আসনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছে বলে খবর নেই।

বিএনপিবিহীন আসন্ন নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য দল তৃণমূল বিএনপি। বিএনপি সরকারের সাবেক তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা প্রতিষ্ঠিত দলটির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৃণমূল বিএনপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। দলটি এবারই নিবন্ধন পেলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সময় নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। তখন নিবন্ধন না পাওয়ায় আদালতের দ্বারস্থ হন নাজমুল হুদা। এরপর আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দলটিকে নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন। এই দলের উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে নির্বাচন করছেন চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরী (সিলেট-৬), মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার (নারায়ণগঞ্জ-১), এবং অন্তরা সেলিমা হুদা (মুন্সিগঞ্জ-১)। তৈমূর আলম খন্দকারের প্রতিদ্বন্দ্বী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। এই আসনে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সহায়তা পাওয়ার খবর নেই। অন্তরা সেলিমা হুদা যে আসনে নির্বাচন করছেন সে আসনেও আছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী, আছেন বর্তমান সংসদ সদস্য বিকল্পধারা বাংলাদেশের মাহী বদরুদ্দোজা চৌধুরী।

শমসের মুবিন চৌধুরী যে আসনে নির্বাচনে নির্বাচন করছেন সেই আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সরওয়ার হোসেন। ভোটের মাঠের চিত্রে শমসের মুবিন চৌধুরী বেশ পিছিয়ে। নির্বাচনী প্রচারণাও তেমন ছিল না অনেকদিন। সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকায় জনসমর্থনও তেমন নেই। তবে গতকাল থেকে এলাকায় ব্যাপক গুঞ্জন সরকারের সমর্থন পাওয়ার। সমর্থনের বিষয়টি আনুষ্ঠানিক নয় যদিও, তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যানের পক্ষে গতকাল শুক্রবার থেকে মাঠে নেমেছে। নির্বাচনের শেষ সপ্তাহে এসে গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজারে তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। দেখার বিষয় শমসের মুবিন চৌধুরী শেষ পর্যন্ত কত দূর যেতে পারেন!

শমসের মুবিন চৌধুরীর সমর্থকদের দাবি তারা ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছেন। তাদের এই দাবি সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারনার বাইরের। তিনি যদি সত্যি এই আসন থেকে জিতে যান, তবে তিনিই কি হতে যাচ্ছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা? মাত্র একটি আসনে জিতে গিয়ে কারো বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে যাওয়ার ঘটনা এখানে ঘটে যেতে পারে, যদি স্বতন্ত্র এবং অন্য দলের প্রার্থীরা বর্তমান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির চাইতে বেশি আসন পেয়ে যান। জাতীয় পার্টির চাইতে বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। এক্ষেত্রে এটা ঘটে গেলেও যেতে পারে! তবে তার আগে শর্ত থাকে যে, প্রথমে শমসের মুবিন চৌধুরীকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচত হতে হবে!

‘কিংস পার্টি’, ‘কিংস পার্টি’—এই যে এত এত আলোচনা, তাতে বিব্রত এই রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনএম দলের মহাসচিব মো. শাহজাহান দাবি করেছেন, ‘কারও পৃষ্ঠপোষকতা, কারও আনুকূল্য, কারও প্রভাবে বিএনএম গড়ে ওঠেনি। বিএনপি ভাঙাও আমাদের উদ্দেশ্য নয়।’ তিনি বিএনএমকে ‘কিংস পার্টি’ নামে অভিহিত না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, ‘শুরুতেই আমাদের কিংস পার্টি বলা হচ্ছে। এসবে আমরা দুঃখ পাই। আমাদের নামের সঙ্গে কিংস পার্টি জুড়ে দেবেন না।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘রাজার পার্টি, প্রজার পার্টি—এসব অভিধায় কারও সম্পর্কে মন্তব্য করা সঠিক না।’ তার প্রশ্ন—’কিংস পার্টি আসবে কোত্থেকে? আমরা কি অস্বাভাবিক সরকার? আমরা গণতন্ত্র নিয়ে লড়াই করছি। সংবিধান রক্ষা, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এই নির্বাচন আমরা করতে চাই।’

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নতুন দলগুলো নিজেদেরকে কিংস পার্টি বলে মনে করে না। তবে আলোচনার বাইরে থাকা সবচেয়ে বড় কিংস পার্টি কিন্তু জাতীয় পার্টিই (জাপা)। ২০১৪, ২০১৮ থেকে এবারের ২০২৪ সালের নির্বাচনেও তারা সরকার-দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ব্যাপক সহায়তা নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটের শরিক হিসেবে আসন ভাগাভাগি করেছে, এবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট না করেও তারা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বিশাল সুবিধা নিয়েছে। আগে জাতীয় পার্টির কয়েকজন মন্ত্রিসভায় যুক্ত ছিলেন, আবার দলের অন্যরা ছিলেন বিরোধী দলেও।

এটা উল্লেখ না হলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কিংস পার্টি হিসেবে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী জাপা। তৃণমূল বিএনপির শমসের মুবিন চৌধুরীকে নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে তাতে তারাও আছেন এর অংশ হয়ে। এর বাইরে দৃশ্যমান নয় এমন অনেক দলও আছে সুবিধাভোগীর তালিকায়। কেবল আসন ভাগাভাগি নিয়ে কিংস পার্টির প্রাপ্তি আলোচনা করা উচিত হবে মনে হচ্ছে না। জাতীয় সংসদের আসন দিয়ে প্রাপ্তির ক্ষেত্র সঙ্কুচিত করা উচিত হবে না!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *