সারাদেশ

আরকান আর্মির গুলিতে প্রাণ গেল বাংলাদেশি যুবকের

ডেস্ক রিপোর্ট: ছেলের বয়স যখন দুই বছর সাত মাস, তখন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় স্বামী। হঠাৎ আলোর সংসারে নেমে আসে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার। একদিকে অবুঝ শিশু সন্তান, অপরদিকে নিজের বয়স কেবল আঠারোতে পড়েছে। এমন সময় ঝড়ে দুমড়ে-মুচড়ে যান তিনি। ঘোর অন্ধকারে তখন তার জীবনের একপাশে কুপির মতো আলো দিতে থাকে বাবা।

শিশু সন্তানের সঙ্গী হয়ে জীবন সংসার পার করার প্রত্যয় নিয়ে পথ চলা শুরু করেন তিনি। কিন্তু কি নিয়তি! তিন বছরের মাথায় মারা যান সেই অবলম্বন বাবাও। তবে, সব হারিয়েও দমে যাননি তিনি। স্বামীর রেখে যাওয়া জমিতে নিজ হাতে করেছেন চাষাবাদ। দীর্ঘ ৫ কিমি পথ হেঁটে আয়ার কাজ করেছেন ক্লিনিকে। হারতে নারাজ তিনি, বরং নিয়তি, মন এবং বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছেন সমাজে। মানুষ করছেন সন্তানকেও। একাকী মায়ের প্রবল পরিশ্রম এবং প্রচণ্ড প্রচেষ্টায় সেই দুই বছর সাত মাসের বাবা হারা অবুঝ শিশু এখন সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট কুড়িগ্রামের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী।

এ গল্প মোছাম্মৎ মরিয়ম বেগম (৪১) ও তার সংগ্রামী জীবনের।

আজ এই মা দিবসে সকল মায়েদের প্রতি অতল শ্রদ্ধা জানিয়ে এমনি এক অদম্য মায়ের সংগ্রামী জীবনের গল্প তুলে এনেছেন বার্তা২৪.কমের গাইবান্ধার করেসপন্ডেন্ট।

মোছাম্মৎ মরিয়ম বেগম (৪১)। বাবা মরহুম করিম মুন্সি। বাবার বাড়ি গাইবান্ধার পৌর এলাকার তিনগাছ তলা নামক এলাকায়। আট ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় মরিয়ম। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা অবস্থায় একই জেলার সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের পশ্চিম হরিপুর গ্রামের মৃত সমেশ উদ্দিনের ছেলে নুরুজ্জামানের সাথে বিয়ে হয় মরিয়মের। বিয়ের দেড় বছরের দিকে ঘরে আসে এক পুত্র সন্তান। যার নাম রাখা হয় মনোয়ার হোসেন মিজান।

কৃষক পরিবারে সন্তান নুরুজ্জামান সব ধরনের কাজই করতেন। যা নিয়ে সুখেই কাটছিল নুরুজ্জামান-মরিয়ম দম্পতির জীবন। কিন্তু মাত্র চার বছরের সংসারই সয়নি মরিয়মের কপালে। হঠাৎ প্রবল ঝড়ে কিডনি, ফুসফুস নষ্ট হয়ে রংপুরের চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকায় চিকিৎসা করাতে নিয়েই যাওয়ার পথেই ২০০৩ সালে ১৭ অগ্রহায়ণ জেলার ঢোলভাঙ্গা নামক স্থানে গাড়িতেই মৃত্যু বরণ করে নুরুজ্জামান।

স্বামী নুরুজ্জামানের সাথে মাত্র চার বছরের সংসারের ইতি টানতে টানতেও যেন শেষ করতে পারেনি ‘মা’ মরিয়ম। একমাত্র সন্তান মিজানের মুখপানে চেয়ে বারবার ভেঙ্গেছে হৃদয়। অগণিত সময় পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে দু’চোখ। হাজারো সুযোগ আসলেও কেবল সন্তানের কারণেই ঘর পাল্টাতে পারেনি অবলা এই নারী।

মন্দ ভাগ্যে যুবতী বয়সেই ‘বিধবা মরিয়ম’:

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মরিয়মের বিয়ে হয় মাত্র ১৪ বছর বয়সে। সংসার জীবনের চার বছরের মাথায় রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় স্বামী। মাত্র ১৮ বছর বয়সে নামের সাথে যোগ হয় বিধবা শব্দটি। স্বামী হারিয়ে ১৮ বছর বয়সেই ভাগ্য দোষে যুবতী মরিয়ম থেকে হতে হয়েছে বিধবা মরিয়ম।

সন্তানকে নিয়ে একাকী জীবন সংগ্রামে মরিয়ম:

কিডনি-ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত স্বামীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে আবাদি জমি, গাছপালা ঘরের যতটুকু ধান ছিল সবই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু মৃত্যু নামক দানব ছেড়ে যায়নি স্বামী নুরুজ্জামানকে। তাকে তো নিয়ে গেছেই সাথে নিঃস্বও হতে হয়েছে মরিয়মকে। পরে কেবল স্বামীর স্মৃতি আর একমাত্র সন্তানকে সঙ্গী করে জীবন সংসার পারি দেওয়ার স্বপ্ন বোনে মরিয়ম। এসময় আসহায়-বিধবা মরিয়মের পাশে কুপির মতো আলো দিতে থাকে সোনালী ব্যাংকের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বাবা। কিন্তু ‘অভাগা যেদিকে যায়, সাগরও শুকিয়ে যায়।’ এর তিন বছরের মাথায় মারা যায় শেষ অবলম্বন বাবাও।

এদিকে সন্তান মিজানের বয়স ছয় বছর ছুঁইছুঁই। বাবার মৃত্যুর আগেই কিনডার গার্ডেনে পড়ানোর ইচ্ছা ছিল মরিয়মের। কিন্তু অর্থাভাবে মিজানকে ভর্তি করে দেওয়া হয় রামচন্দ্রপুর ব্র্যাক স্কুলে।

স্বামীর পর বাবার মৃত্যুতে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে বিধবা মরিয়ম। এবার ঘুরে দাঁড়াতে চান তিনি। কেননা, হারলে মরিয়মদের চলে না। দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় সন্তানকে মানুষ করতে ঘর থেকে বের হন বাহিরে। স্বামীর রেখে যাওয়া ১২ শতাংশ জমিতে ফসল ফলান নিজ হাতে। পালন করেন হাঁস-মুরগি। এরপরে গাইবান্ধার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে আয়ার কাজও নেন তিনি।

একমাত্র ছেলেকে ঘিরেই যত স্বপ্ন, সংগ্রাম:

একমাত্র সন্তানকে কেজি স্কুলে (কিনডার গার্ডেন) পড়ানোর স্বপ্ন থাকলেও টাকার অভাবে ফরম তুলেও স্কুলে ভর্তি করাতে পারেনি। কিন্তু ছেলেকে কেজি স্কুলে পড়ানোর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার। গাইবান্ধার একটি ক্লিনিকে ৩ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নিয়ে ২০১৪ সালে ছেলেকে জেলার উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত ‘কল্পলতা স্কুল এন্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন মরিয়ম। স্বপ্ন দেখেন ছেলে একদিন অনেক বড় চাকরি করবে, দুঃখ ঘুচাবে মায়ের। কিন্তু সেখানে ভর্তি করে দেওয়ার পর আর্থিক খরচ দ্বিগুণ হয়। যা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে দমে যাননি তিনি।

সন্তানের জন্য খেয়ে-না খেয়ে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করে তার পড়া লেখায় কোনো ঘাটতি হওয়ার সুযোগ দেয়নি বিধবা মরিয়ম। এই টানা পোড়েনের মাঝেই গাইবান্ধার একটি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এসকেএস স্কুল এন্ড কলেজে আয়া পদে ৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি পায় মরিয়ম। তখন সন্তানের পড়ালেখার খরচের খানিকটা চিন্তামুক্ত হন তিনি। পরে মিজান একই প্রতিষ্ঠান থেকে জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পাশ করে গাইবান্ধার সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০১৯ সালে এসএসসি, একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২১ সালে এইচএসসি পাশ করে। পরে ২০২৩ সালে মেধাতালিকায়র কুড়িগ্রাম সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায়।

মরিয়মের দিন বদলের স্বপ্নে অঙ্কুর গজিয়েছে কেবল:

বাবা হারা মিজান যেদিন সরকারি পলিটেকনিকে ভর্তির সুযোগ পায়, সেদিন মরিয়মের মতো সুখী বুঝি পৃথিবীতে কেউ ছিল না। স্বপ্ন পূরণের পথে একধাপ এগিয়েছে তার ছেলে। এখন ভরসা হচ্ছে ছেলে একদিন বড় হবেই, মায়ের কষ্ট ঘুচাবে। এ যেন মরিয়মের দিন বদলের স্বপ্নে অঙ্কুর গজিয়েছে কেবল। এর থেকেই একদিন ফুল হবে, হবে ফলও। সেই প্রত্যাশায় দিন গুনছেন তিনি।

বার্তা২৪.কম-কে একান্ত সাক্ষাৎকারে মরিয়ম বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। ছোট্ট ছেলেটাকে জমির আইলে বসিয়ে রেখে ধানের বেছন (চারা) তুলেছি। ধান কেটেছি, মাড়াই করেছি। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়েছিল, ভাত পাইনি। এসময় হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন মরিয়ম। এসময় কান্নায় বেশ কিছুক্ষণ স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি।

পরে স্মৃতিচারণ করে কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ওকে (ছেলেকে) কেজি স্কুলের ভর্তি ফরম নিয়ে আসার পরেও এক হাজার টাকার জন্য ভর্তি করতে পারিনি। বাবার কাছে টাকা চেয়েছিলাম, পাইনি। বাধ্য হয়ে ব্র্যাকে পড়িয়েছি।

পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে ক্লিনিকে চাকরি করে ভাল স্কুলে পড়িয়েছি। এখনও কষ্ট করছি। এখন এসকেএস এনজিও’র স্কুলে ৮ হাজার টাকা বেতনে আয়া পদে চাকরি করছি। চাকরির বয়স সাত বছর হয়ে গেল। এই টাকায় অন্য কিছুই করতে পারি না। সবই ছেলেটার পিছনে খরচ হয়। হোক, তবুও আমি হারবো না, আসলে মায়েরা হারতে জানে না।

আমার সব স্বপ্ন ওকে নিয়েই। চোখ ভরা পানি নিয়ে তিনি বলেন, মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়েছি, তখন থেকেই বিধবা। মন্দভাগ্য যুবতী বয়সেই বিধবা হলাম। ছেলেটার বয়স তখন দুই বছর সাত মাস। জীবনে অনেক প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে অন্য কিছুই ভাবতে পারিনি।

মায়ের মতই ছেলের ভাবনাও:

যাকে ঘিরে মরিয়মের এত স্বপ্ন সেই সন্তানের ভাবনায় কী? তা জানতে ছেলে মিজান বলেন, তার ভাবনাও ঠিক মা মরিয়মের মতই।

ম্যাসেঞ্জারে এক প্রশ্নের উত্তরে মিজান লিখে পাঠান- প্রত্যেকটি পরিবারে রোজগার করে বাবারা, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে পুরাই ছিল ভিন্ন। ছোটবেলায় বাবা মারা যায় তখন থেকে মা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দিনরাত এক করে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতো আমার মুখে।

মাই আমার সব, বাবাও আমার মাই। মা আমাকে কখনো বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। মা আমার আগামী দিনের পথ চলার আলোকবর্তিকা। মা আমার অন্ধকারের আলো। মাকে নিয়ে আমি খুব গর্ব করি। মাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি। একদিন বড় হবো, চাকরি করবো। মায়ের সকল দুঃখ মুছে যাবে। মায়ের স্বপ্নইতো আমার স্বপ্ন। আল্লাহ যেন আমার মাকে হাজার বছর বেঁচে রাখেন।

সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য কামাল হোসেন বলেন, অল্প বয়সে বিধবা হয়ে শিশু সন্তানকে মানুষ করতে ওই নারী অনেক সংগ্রাম করেছেন, আজও করছেন। তার এই সংগ্রাম দেশে উদাহরণ হতে পারে। আমি আজ মা দিবসে তাকে একজন সংগ্রামী মা হিসেবে স্যালুট জানাই।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *