আন্তর্জাতিক

ইসলামে বিজয় ও দেশপ্রেম

ডেস্ক রিপোর্ট: প্রতিটি বিজয় উচ্ছ্বাসের, উল্লাসের। আর নিজ মাতৃভূমি বিজয় মহোৎসব ও মহানন্দের। কেননা কোনো জাতির ছোটবড় যেকোনো উৎসব-উদযাপন এবং আনন্দানুভূতির মুহূর্ত তৈরি হওয়ার জন্য প্রথমেই চাই স্বাধীন ও নিরাপদ ভূখণ্ড। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা এমন একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ডের মালিক হই। আমাদের অদম্য বীর সৈনিকরা মহোৎসব ও মহানন্দের এই বিজয় ছিনিয়ে আনেন পাকিস্তানি দখলদারদের পরাজিত করে।

পবিত্র কোরআনে বিজয়ের দুটি রূপ সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। তা হলো- স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী বিজয়ের রূপ এবং কল্যাণ ও আদর্শবাদী বিজয়ের রূপ। স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী বিজয়ের রূপ সম্পর্কে কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে, ‘রাজা-বাদশাহরা যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে তখন তা বিপর্যস্ত করে এবং সেখানকার মর্যাদাবান ও সম্মানিত লোকদের অপদস্থ করে।’ -সুরা নামল : ৩৪

স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী বিজয়ের এই রূপটি ছিল পাকিস্তানিদের। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান আলাদা ভূখণ্ডে বিভক্ত হলেও উভয় ভূখণ্ডের মানুষই ছিল মুসলমান। ব্রিটিশদের দুইশ বছর শোষণ-পীড়নের পর আমরা আশাবাদী ছিলাম, আমাদের মুসলমান ভাই পাকিস্তানিদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার ও লুণ্ঠিত হওয়া অধিকার ফিরে পাবো। কিন্তু তেমনটি হয়নি। ক্রমেই পাকিস্তানিরা ভয়াবহ জালেম শাসক হয়ে উঠে।

আমরা মুসলমান, শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত। ইসলামের বিধানে, ‘মুসলমান ভাই ভাই। মুসলমানের রক্ত ও মান-মর্যাদা একে অপরের জন্য আমানতস্বরূপ।’ পাকিস্তানি নেতা ও শাসকবর্গ সেই আমানত রক্ষা করেনি। ১৯৪৭ সাল থেকে দীর্ঘ চব্বিশ বছরের শাসনে তারা আমাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন করেছে, অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে। সর্বশেষ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বাঙালি জাতির ওপর চালিয়েছে বর্বরোচিত গণহত্যা। এতে আমরা হারিয়েছি দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। শহিদ হয়েছেন অসংখ্য যোদ্ধা। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এ দেশের মাটি। সম্ভ্রম হারিয়েছেন অসংখ্য মা-বোন। কিন্তু অদম্য বীরদের হার না মানা সংগ্রামে দেশের আকাশ থেকে দূর হয় সেই ঘনঘটা মেঘ। উদিত বিজয়ের রক্তিম সূর্য।

কল্যাণ ও আদর্শবাদী বিজয়ের রূপ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি পৃথিবীতে তাদের প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা নামাজ আদায় করবে, জাকাত দেবে, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর সব কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে।’ -সুরা হজ : ৪১

কল্যাণ ও আদর্শবাদী বিজয়ের এই রূপটি হলো- আমাদের। এটি হচ্ছে সত্য ও আদর্শের বিজয়। মানব ও মানবতার বিজয়। আমাদের সৌভাগ্য, মহান আল্লাহ আমাদেরকে এমন বিজয় দান করেছেন। এই বিজয়ের মাধ্যমে আমরা নিজ ভূখণ্ডে সামাজিক, নাগরিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয়সহ সব ধরণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।

মাতৃভূমি থেকে দখলদারদের বিতাড়িত করা, স্বাধীনতা অর্জন করা এবং স্বাধীন থাকা কতটা তৃপ্তি, আনন্দ ও নিরাপত্তার- তা হয়ত নতুন প্রজন্মের অনেকেই পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারবে না। তবে বর্তমান ফিলিস্তিনের দিকে তাকালে আমরা তা যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারব। ফিলিস্তিনের মুসলমানরা নিজ ভূখণ্ডে এতটাই অসহায় ও অনিরাপদ যে, ইবাদতরত অবস্থায় কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের সময়ও দখলবাজ শত্রুদের হামলায় শহিদ হতে হচ্ছে।

পাকিস্তান ও ইসরায়েল দখলদার বাহিনীর যদি তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে- অনেকে ক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনী ইসরায়েলের বাহিনী থেকেও বর্বর। ইসরায়েলিরা মুসলিম নয়, কিন্তু পাকিস্তানিরা মুসলিম হয়েও নামাজরত মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে। তাদের অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায়, মহান আল্লাহ তাদের শক্তি ও জুলুমকে নয় মাসের ভেতরে স্তিমিত করে আমাদের দান করেন- বিজয়।

মক্কা বিজয়ের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তা ছিল রক্তপাতহীন মহাবিজয়। সেদিন মক্কায় প্রবেশের সময় সাহাবিদের কেউ কেউ বলেছিল ‘আজ রক্তপাতের দিন।’ এ কথা শুনে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তা বলতে নিষেধ করেন। অতঃপর তিনি বলেন ‘আজ দয়া ও করুণার দিন।’ সেদিন তিনি পুরো মক্কাবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। অথচ মক্কার কাফের-মুশরেকরা রাসুল (সা.) কে নানাভাবে হেনস্তা করেছে তার কোনা ইয়ত্তা নেই। একসময় নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে। আর মক্কা বিজয়ের আগে দীর্ঘ দশ বছর নানাভাবে শত্রুতা পোষণ করেছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। এতকিছুর পরও রাসুল (সা.) কাফের- মুশরেকদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, এটা তার মহানুভবতা।

১৯৭১ সালে আমাদের বিজয় দিবসের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, দুপুর ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য নারী-পুরুষের সমাগম ঘটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তাদের মুখে ছিল হাসি, প্রাণে ছিল বিজয়ের সুর। সেদিন কোনো রক্তপাত হয়নি, নিরুপায় পাক হানাদারদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল।

সুরা হজের ৪১ নং আয়াত থেকে জানা যায়, বিজয়ীদের উচিত নামাজ আদায় করা, জাকাত প্রদান করা এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা।

এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের জন্য দোয়া করা এবং কোরআন তেলাওয়াতসহ বিভিন্নভাবে সওয়াব পৌঁছে দিয়ে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা।

আমাদের বিজয় অর্জনের মূল শক্তি ছিল বীর সৈনিকদের অকৃত্রিম দেশপ্রেম। সে সময় অসংখ্য বাঙালি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অসংখ্য শহিদের রক্তে রঞ্জিত হয় এই দেশের মাটি। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা বিজয় লাভ করি। মুক্তিযোদ্ধারা এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা যুদ্ধে অংশগ্রহন করে, নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, নিজ নিজ মাতৃভূমিকে ভালোবাসা। এটাই রাসুল (সা.)-এর আদর্শ।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *