আন্তর্জাতিক

যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তি ও আলোকায়ন

ডেস্ক রিপোর্ট: প্রায়-শতবর্ষীয় যুদ্ধ, আগ্রাসন ও গণহত্যার পটভূমিতে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য দশকের পর দশক ধরে যে প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে, বাস্তবে তা একধরনের ধোঁকাবাজি এবং ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্নকরণ অব্যাহত রাখতে ইসরায়েলি কূটকৌশল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর নিজেদের শক্তিমত্তা ও ক্ষমতা প্রবলতর হয়ে ওঠায় জাইয়নবাদী রাষ্ট্রটি কথিত এই শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়ায় তিনটি দিকনির্দেশনা বা স্বতঃসিদ্ধ নির্ধারণ করে।

প্রথমত, ‘ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মূল রয়েছে ১৯৬৭ সালে, যা সমাধানে দরকার একটি চুক্তি, যা পশ্চিম তীর ও গাজার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। অন্য কথায়, যেহেতু এই এলাকাগুলো ফিলিস্তিনের মাত্র ২২ শতাংশ, সেহেতু ইসরায়েল এক ধাক্কায় শান্তিপ্রক্রিয়াকে মূল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ক্ষুদ্র একটি অংশে সীমিত করে ফেলে।

ইসরায়েলের দ্বিতীয় স্বতঃসিদ্ধটি হলো, পশ্চিম তীর ও গাজায় দৃশ্যমান সবকিছুই ভাগ করা হবে। আর এই বিভক্তিকরণ শান্তির অন্যতম স্তম্ভ। ইসরায়েলের জন্য দৃশ্যমান সবকিছুর ভাগ শুধু ভূখণ্ড নয়, বরং মানুষ ও প্রাকৃতিক সম্পদসমূহও এই ভাগের অন্তর্ভুক্ত।

ইসরায়েলের তৃতীয় স্বতঃসিদ্ধ হলো, ১৯৬৭ সালের আগে জাতিগত নিধনসহ যা কিছু ঘটেছে, সেগুলো কখনোই আলাপ-আলোচনায় আসবে না। এর তাৎপর্য খুব পরিষ্কার: এটা শান্তি আলোচনা থেকে শরণার্থীদের বিষয়টি পুরোপুরি সরিয়ে ফেলে ও ফিলিস্তিনিদের ফিরে আসার অধিকারকে নাকচ করে দেয়। ইসরায়েলি দখলদারির সমাপ্তিকে সংঘাতের সমাপ্তির সঙ্গে সমর্থক করে তোলা হয় এই স্বতঃসিদ্ধটির মাধ্যমে, যা কিনা আগের দুটি স্বতঃসিদ্ধ থেকে উৎসারিত। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জন্য অবশ্যই ১৯৪৮ সাল হলো সবকিছুর প্রাণ এবং কেবল অতীতের অন্যায়গুলোকে সংশোধন করা হলেই এই অঞ্চলে সংঘাতের অবসান হতে পারে।

সকল ধর্মে এবং যাবতীয় আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনে হত্যা যদি নশ্বর পাপ ও দণ্ডণীয় অপরাধ হয় তাহলে আমরা যুদ্ধকে কিভাবে ন্যায্যতা দিতে পারি? মানুষ কি তার বিবেক ও মনুষ্যত্ব হারিয়ে হিংস্র জানোয়ার হতে পারে? কিসের কারণে যুদ্ধ হয় এবং এগুলো কিসের দিকে পরিচালিত করে? পণ্ডিত, গবেষক, দার্শনিক, সাহিত্যিকগণ শত শত বছর ধরে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। বিশ্ববিখ্যাত বইয়ের তালিকায় উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে যুদ্ধের নৈতিক জটিলতা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনামূলক গ্রন্থগুলো।

ফলে মানব সভ্যতার শুরু থেকেই সাহিত্যে যুদ্ধ একটি পুনরাবৃত্ত বিষয়। সমস্ত মহান মহাকাব্য আচ্ছন্ন ছিল যুদ্ধ ও সংঘাতের বিষয়াবলীতে। মহাকাব্য ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘ইলিয়াড’ এবং “ওডিসি”তে যুদ্ধ এবং যোদ্ধাদের রোমান্টিকভাবে চিত্রিত করা হয়েছিল। তবে আধুনিক বিবেচনায় তা সমালোচিত এবং যুদ্ধ ও সংঘাত নিন্দনীয় বিষয় হিসাবে স্থান পেয়েছে।

বিশেষত, বিংশ শতাব্দীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর, সাহিত্যের একটি নতুন ধারার আবির্ভাব ঘটে যা যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং অসারতাকে চিত্রিত করেছিল। যুদ্ধবিরোধী সাহিত্য রূপে পরিচিত কতিপয় বিশ্ববিশ্রুত উপন্যাস শুধু যুদ্ধের সমালোচনাই করেনি বরং এর সাথে যুক্ত বীরত্বের ধারণাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। মূলত ইংরেজি সাহিত্যে যুদ্ধবিরোধী উপন্যাসের তাৎপর্য এবং আধুনিক সময়ে তাদের প্রাসঙ্গিকতার অন্বেষণ এখন গবেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যয়নের ক্ষেত্র।

বস্তুতপক্ষে, আধুনিক ও উত্তরাধুনিক লেখকগণ ঐতিহাসিক ঘটনা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, যুদ্ধ খারাপ ও পরিত্যাজ্য। কিন্তু ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে, এবং একুশ শতকে নতুন নতুন সংঘাত ও যুদ্ধের মুখোমুখি হয় মানবতা, যা অব্যাহত রক্তপাত ও মৃত্যুর কারণ হয়ে মানবিকতাকে পীড়া দিচ্ছে। যে কারণে, আমাদের সকলের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার, যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে রচিত সাহিত্য পড়ার এবং তাদের ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার উপযুক্ত পরিস্থিতি আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে এবং অতীতের মতো বর্তমানেরও যুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষের যুক্তিগুলো নিয়ে তর্ক হচ্ছে। কিন্তু কোনও যুক্তিতেই যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে সৃষ্ট ধ্বংস ও হত্যালীলা সম্পর্কে নিস্পৃহ, নিরপেক্ষ ও প্রতিবাদহীন থাকার অবকাশ নেই।

ডব্লিউ বি. ইয়েটস সম্পর্কে অমর্ত্য সেন তার ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, নীৎসের লেখা The Genealogy of Morals-এর নিজস্ব কপিটির মার্জিনে ইয়েটস লিখেছিলেন, ‘কিন্তু নীৎসে এ কথা কেন মনে করলেন যে রাত্রিতে কোনও তারকা থাকে না, শুধু থাকে বাদুড় আর পেঁচা আর পাগলা চাঁদ?’ মানবতা সম্পর্কে ‘রক্ত হিম করা’ চিত্রটি বিংশ শতাব্দীর ঠিক আগের। পরের শতাব্দীর ঘটনাগুলো হয়েছিল আরও মর্মান্তিক। যার মধ্যে ছিল যুদ্ধ, ব্যাপক সংহার, গণহত্যা, এবং নিয়মিতরূপে ঘটতে থাকা নৃশংসতা ও উদ্বাস্তুকরণ। যে কারণে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক জনাথন গ্লভার, তার খুবই আগ্রহোদ্দীপক ‘বিংশ শতাব্দীর নৈতিক ইতিহাস’ নামক রচনায় এই ধারণা ব্যক্ত করেছেন যে, ‘গত শতাব্দীতে যা যা ঘটেছে শুধু তাই নিয়েই চিন্তা করলে আমাদের চলবে না। আমাদের মনের মধ্যে যেসব দানব বাসা বেঁধেছে তাদের দিকেও খুব ভালো করে, পরিষ্কার চোখে তাকাতে হবে। ভেবে দেখতে হবে কী উপায়ে তাদের আমরা খাঁচায় পুরতে পারি। পোষ মানাতে পারি।’

অতএব, সঙ্কুল বিশ্বপরিস্থিতিতে যুক্তি ও আলোকায়নের ভিত্তিতে যুদ্ধ ও সংঘাতকে পরাজিত করা কেবল রণাঙ্গণেই নয়, চৈতন্যের স্তরেও আবশ্যিক। কারণ, যুদ্ধের বীভৎস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্ধকারাচ্ছন্ন এই পৃথিবীতে নরহত্যা ও নৃশংসতা থামিয়ে আশা ও ভরসার পথে অগ্রসর হওয়ার উৎস হচ্ছে যুক্তি: যা মানবতাকে আলোকের পথ দেখায়।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *