সারাদেশ

মালয়েশিয়ার জোহরবারুতে ১০৯ বাংলাদেশি আটক

ডেস্ক রিপোর্ট: পশ্চিমা পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর বৈশ্বিক আধিপত্যের প্রতিষ্ঠিত ধারা ভেঙে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমেই বিপরীত শক্তিবলয় তৈরি করেছে রাশিয়া, ভারত ও চীন, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। একসময়ে এতোটা প্রাধান্য দেওয়া না হলেও বর্তমানে চীনের আধিপত্য দমাতে পশ্চিমাদের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয়তা এবং আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান চলমান যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা, ফ্রান্সের বাংলাদেশের বাণিজ্যে সম্পৃক্ততার আগ্রহ বৃদ্ধি ইত্যাদি এরই প্রতিক্রিয়া!

প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভৌগোলিক অবস্থান এবং অসীম সম্ভাবনাময় অর্থনীতির জন্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ। সমুদ্র বিজয়ে বেশকিছু দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠা, চীনের অন রোড ইনিশিয়েটিভ বা সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ায় চীনভিত্তিক বাণিজ্যিক তৎপরতা, ভারতের সেভেন সিস্টার্স বা সাত রাজ্যের প্রবেশ মুখ এবং কৌশলগত আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্থানে ভেীগোলিক অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে প্রতিটি সম্মেলনেই বাংলাদেশের শক্ত ও নেতৃস্থানীয় অবস্থানের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমা আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ ভারত নিয়ে পশ্চিমাদের অনেক বেশি আগ্রহ রয়েছে। সদ্য-বিগত ২০২৩ সালের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইস্যু ছিল শিখ নেতা হারদীপ সিং নিজ্জার হত্যায় ভারত-কানাডা দ্বন্দ্ব এবং বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা। হুট করে গণতণ্ত্রের প্রতিষ্ঠার কথা বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয়া থাকার প্রবণতা এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্কে অবনতির পর কানাডা এবং পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া দেখলেই এই অঞ্চলে তাদের আধিপত্য বিস্তারের প্রয়াসের বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়।

কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো ভারতের বিরুদ্ধে কানাডার ভারতীয় বংশদ্ভূত নাগরিক শিখ নেতা নিজ্জার হত্যার অভিযোগ আনার পর ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল চোখে পড়ার মতো। কানাডার রাষ্ট্রদূতদের অপসারণ, নাগরিকদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং বিভিন্ন কুটনৈতিক পর্যায়ের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে দেশ দুটির। এতোকিছুর পরেও কানাডার বন্ধুরাষ্ট্ররা ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলেনি। অন্যদিকে সম্প্রতি চলমান ইসরায়েল-হামাস সংঘাতে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের বিপক্ষে ভোটও দিয়েছে ভারত। প্রথমদিকে হামাসের হামলার সমালোচনা করলেও শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলারই বিরোধিতা করেছে দেশটি এবং হামাসকেও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তার নাকচ করে দেয়।

চলতি বছরের বৈশ্বিক ভূরাজনীতির চিত্র বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, শক্তির ভারসাম্যে নাটকীয় পরিবর্তন শুরু হয়েছে বেশকিছু ইস্যু ধরেই। রাশিয়াকে ছাপিয়ে যেতে পারছেনা সামরিক সংগঠন ন্যাটো। ফলে দীর্ঘতর এ যুদ্ধে ক্রমেই আগ্রহ হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে চরম আয়বৈষম্য, আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অতিরিক্ত ইসরায়েল প্রীতি সবকিছুই যেন শক্তিহ্রাসের অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক সংগঠনগুলোকে দীর্ঘসময় ধরে অকেজো রেখে নিজ স্বার্থে কাজে লাগালেও বর্তমানে জাতিসংঘের গঠননীতি নিয়েও কথা বলছে অন্যান্য রাষ্ট্র। ইরাক যুদ্ধের সময়েই পর্যবেক্ষকদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়, শান্তিপূর্ণভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সংঘাত নিরসনে জাতিসংঘ এখন আর আগের মতো কার্যকর ভূমিকা নিতে পারছে না। অন্যদিকে সামাজিক-প্রাকৃতিক নানা সংকট মোকাবেলায় ব্যর্থতার কারণে অর্থনৈতিক বিপত্তি শুরু হয় পশ্চিমা বিশ্বের। তারপরেও রাশিয়া-চীনের আধিপত্য বিস্তাররোধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিকে পাখির চোখে নজরে রেখেছে পশ্চিমা গোষ্ঠী।
যুক্তরাষ্ট্র মূলত নানাভাবে বাংলাদেশকে চাপে রেখে চীনের বলয়ের বাইরে আনতে চায়। এটাই বাংলাদেশের ওপর চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ঠেকানোর যুক্তরাষ্ট্রের মূল কৌশল হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চুপসে না গিয়ে প্রতিবাদ করতেই বেশি দেখা গেছে এবং ক্ষমতাসীন দলের তত্ত্বাবধানেই জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্নের দ্বারপ্রান্তে। গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত এই বিষয়গুলোতে পশ্চিমাদের আধিপত্য যেন আগের মতো আর কাজ করছে না।

অন্যদিকে সম্প্রতি জলবায়ু সম্মেলনেও সরব থাকতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশকে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে পশ্চিমাদের বিপক্ষে কথা বলার মতো একটা শক্তিবলয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গড়ে উঠার ফলেই নড়েচড়ে বসেছে যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যকে গত কয়েক দশকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে একেবারে দুমড়েমুচড়ে দিতে সক্ষম হলেও দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রশান্ত সাগরীয় বলয়ে সেটা কেমন হবে তাই দেখার বিষয়।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রশান্ত মহাসাগরীয় বলয় নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ পায় ২০২১ সালে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করার মাধ্যমে। সেখানে দেখানো হয়েছে-ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূমি বিশ্বের ২৫ শতাংশ ও সমুদ্র ৬৫ শতাংশ। এ অঞ্চলের জনসংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি, যার প্রায় ৫৮ শতাংশই তরুণ বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারা। এ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ, জিডিপি ৬০ শতাংশ ও ভোক্তা ৬০ শতাংশ। এ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন, ভারত, পাকিস্তান, জাপান ও কোরিয়াসহ বেশ কয়েকটি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ আছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশও প্রবেশ করবে মধ্যম আয়ের দেশে। এখানে উদীয়মান অর্থনীতির বেশকিছু দেশ রয়েছে যাদের সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অনেক ভালো। আবার রাশিয়ার সাথে মিযানমারের গভীর বন্ধুত্বও এই ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সব মিলিয়ে এ অঞ্চল বৈশ্বিক রাজনীতির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রেট আগ্রহের কারণও মূলত এটিই।

এর আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনীতি পাল্টে গিয়েছিল। এ অঞ্চলে রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের বিস্তার ও সামরিক সহায়তার প্রভাব বেড়ে গিয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে ধীরে ধীরে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদ ছড়িয়ে পড়ে আর ভাটা পড়ে রাশিয়া তথা সাবেক সোভিয়েতের আদর্শগত তৎপরতায়। ১৯৯১ সালে শীতল যুদ্ধের পুরোপুরি অবসানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ বড়সর রাজনৈতিক পরিবর্তন হলেও ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পশ্চিমাদের কাছে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব কখনোই কমেনি। বর্তমানে উদীয়মান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ায় আবার যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, মনোযোগ বেড়ে হয়েছে কয়েক গুণ। গত ৫২ বছরে ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে একটি পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যা খুবই স্পষ্টভাবে দেখা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধনীতিতেও অনেকটাই নড়বড়ে অবস্থা দেখা গিয়েছে ২০২৩ সালে। সেই ২০২২ সালের এর ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে মানবাধিকার নিয়ে সরগরম থাকা যুক্তরাষ্ট্রই আবার ইসরায়েল-হামাস সংঘাতে যুদ্ধবিরতির বিপক্ষে ভোট দেয় জাতিসংঘে। সংঘাত নিরসনের এমন দ্বিমুখী নীতির জন্য দেশটির সমালোচনা কম হচ্ছে না। কিন্তু তবুও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে ইসরায়েলের বর্বরতা থামাতে তৎপর হতে দিচ্ছে না দেশটি। তাদের এমন প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য ইসরায়েলপ্রীতি ভূ-রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। ক্ষমতার বিস্তারে মধ্যপ্রাচ্যকে ছাড়িয়ে এখন এই প্রশান্ত মহাসাগরীয় বলয়েও আসতে চায় তারা। কিন্তু আসার এজেন্ডা সেই পুরনো বক্তব্যই। গণতন্ত্র এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার নামে মূলত দেশটির মূল অর্থনীতি এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই ধ্বংসে তৎপর থাকে যুদ্ধবাজ যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিপক্ষ চীন এবং রাশিয়ার কাছে অনেকটাই নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে দেশটি। ন্যাটোর পরপর ব্যর্থতায় ইউক্রেনের অধিকার থেকে অনেকটাই বিমুখ যুক্তরাষ্ট্র এখন ইসরায়েলকে আত্মরক্ষার অযুহাতে সংঘাত চালিয়ে যেতে মদদ দিচ্ছে।
ইরাক, ইরান, সিরিয়া, ফিলিস্তিনের মতো দেশগুলোতে বছরের পর বছর ধরে সামরিক অভিযান আর দ্বন্দ্ব পরিচালনা করে এসেছে পুরাতন শক্তিবলয়। কিন্তু বর্তমানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন এই চীন- ভারত বলয়ে তাই চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনীতি। বন্ধু রাষ্ট্র কানাডার নিজ্জার হত্যার ইস্যুতে তাই নিরব দর্শকই ছিল দেশটি। আবার যুক্তরাষ্ট্রেও আরেক শিখ নেতা হত্যার ঘটনায় এতো তোরজোর করতে দেখা যায়নি।

বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে নিজেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ২০২৩ সালেও যেন অপূর্ণই রয়ে গেলো যুক্তরাষ্ট্রের। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক এবং সামরিক সংকট সৃষ্টির পর থেকে এখন বিষয়টি উপলদ্ধির যে, সব দেশই নিজস্ব সংস্কৃতি-ইতিহাস ও স্বকীয় রাজনৈতিক বাস্তবতা দ্বারাই পরিচালিত হয়। অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপ ওই দেশটির অবস্থা নাজুক করে তোলে।

চলতি বছরের বৈশ্বিক ভূরাজনীতির চিত্র বিশ্লেষণে শক্তির ভারসাম্যে নাটকীয় পরিবর্তন স্পষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের বিস্তারও লক্ষণীয়। বেশকিছু ইস্যু ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা হচ্ছে উদীয়মান বিশ্বশক্তি চীন, রাশিয়া ও ভারতের। রাশিয়া-চীনের আধিপত্য বিস্তাররোধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা গোষ্ঠী। ভূরাজনৈতিক বলয়ে এসব পট পরিবর্তনের প্রভাব নতুন বছর ২০২৪ সালে আরও প্রকট হবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশও বৈশ্বিক আগ্রহের কেন্দ্রস্থলে চলে আসবে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *