আন্তর্জাতিক

হামাস নেতা সালেহ আল-আরৌরির উত্থান ও বর্তমান ফিলিস্তিন

ডেস্ক রিপোর্ট: ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার পশ্চিম তীরের হামাসের সামরিক শাখা ইজ আদ-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহের একজন সহকারী সালেহ আল-আরৌরি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলে পরিচালিত নৃশংস হামলার সাথে জড়িত হামাসের অন্যতম নেতা তিনি। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় তিনি নিহত হয়েছেন। হামাসের কার্যালয় লক্ষ্য করে পরিচালিত এই ড্রোন হামলার লক্ষ্যবিন্দুতে ছিলেন আরৌরি।

স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর উপপ্রধান সালেহ আল-আরৌরি ১৫ বছর ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী থাকার পর ২০০৭ সালে মুক্ত হয়েছিলেন। সম্প্রতি ইসরায়েলে ড্রোন হামলা সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করা হলেও কোনো উত্তর দেননি তিনি। এমনকি হামাসের বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগেরও জবাব দেননি। তবে হামাসের উল্লেখিত টার্গেট তালিকার অন্যতম নাম ছিল আল-আরৌরি। ৭ অক্টোবরের হামলার অন্যতম ব্যক্তি হিসেবে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা তার নাম উল্লেখ করে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে (হামাস) ধ্বংস করার চেষ্টা হিসেবে হামাস নেতাদের টার্গেট করে পরিচালিত এক হামলাতেই মৃত্যু হয় আরৌরির।

২০০৭ সালের ২৫ মার্চ সালেহ আল-আরৌরির সরাসরি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তখনকার টাইমসের এবং বর্তমান রয়টার্সের আন্তর্জাতিক সম্পাদক এবং লেখক ব্রনওয়েন ম্যাডক্স। সংবাদমাধ্যম চ্যাথাম হাউসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তিনি তার সেই সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ইসরায়েলি সৈন্যরা অক্টোবরের শেষের দিকে রামাল্লার পশ্চিম তীরের পাহাড়ের উঁচুতে অবস্থিত অরোর গ্রামে আল-আরৌরির পারিবারিক বাড়িটি ধ্বংস করে। অনুসন্ধান করে সেখান থেকেই তার নামটি নিয়েছিল ইসরায়েলি সেনারা। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মাথার জন্য ৫মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্য ট্যাগ নির্ধারণ করেছিল।

কারাগারে থাকা অবস্থায় পশ্চিম তীর বা গাজায় ফিলিস্তিনিদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কিনা- এমন প্রশ্ন করা হলে, আল-আরৌরি প্রশ্নটি খারিজ করে দেন। তিনি দাবি করেন যে আদৌ এমন কিছু ছিল না। আল-আরৌরি যে কৌশল নির্ধারণ করেছিলেন তা বিজনেস স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের মতোই স্পষ্ট। আল-আরৌরি যে কৌশল নির্ধারণ করেছিলেন তা বিজনেস স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের মতোই স্পষ্ট। ইসরায়েলদের প্রতি সবসময় ফিলিস্তিনিদের মনোভাব যেন নেতিবাচক থাকে সেজন্যই প্রয়াস ছিল তার।

তিনি বলেন, আল-আরৌরি তখন মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমাদের কাজ হল ফিলিস্তিনিদের উগ্রবাদী রাখা, তাদের রাগান্বিত রাখাটা দরকার ছিল। তাদের বেশিরভাগই শান্তির জন্য মুহুর্তের মধ্যেই স্থির হতে চাইবে, কিছু চুক্তি দিয়ে তারা জীবন চালিয়ে নিতে চাইবে। কিন্তু তাদের রাগ থাকলে এমনটা তারা করতে রাজি হবেনা।’

তিনি আরও বলেন, গাজার স্কুলগুলোতে পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলবিরোধী মতাদর্শ শেখানোর বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন তিনি। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের ক্ষুব্ধ রাখতে ইসরায়েলের চেয়েও ভালোভাবে ফিলিস্তিন পরিচালনার বিষয়গুলোকে বারবার সামনে নিয়ে আসতেন তারা। তিনি ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার কথা উল্লেখ করে বৃটিশদের ওপর তার সমস্ত রাগের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।

হামাসের পক্ষে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নেওয়ার সময় এসেছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি দেশটির বৈধতা অস্বীকার করে বলে জানন ব্রনওয়েন ম্যাডক্স। তিনি বলেন, এই প্রসঙ্গে আল-আরৌরি জোর দাবি করে বলেন, ‘হামাস ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, শেষ পর্যন্ত জয়ীও হবে। আমরা ১ হাজার বছরের জন্য পরিকল্পনা করছি, এর মধ্যেই ইসরায়েল পরাজিত হবে’।

ম্যাডক্স বলেন, এরপর আর কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি তিনি। সেই বছরেরই শেষের দিকে আল-আরৌরিকে আবার গ্রেফতার করা হয় এবং ২০১০ সালে ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। তারপর থেকেই সিরিয়া এবং লেবানন অঞ্চল থেকে তিনি হামাসের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। ২০১১ সালে ইসরায়েলি সেনা গিলাত শালিতের মুক্তির বিনিময়ে বহু ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্ত করার শর্তারোপ করে ফিলিস্তিনি বন্দী উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর আগেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন।

তার হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে বলে মন্তব্য করেন ব্রনওয়েন ম্যাডক্স। একটি হল- ড্রোন হামলা লেবাননে হিজবুল্লাহর সাথে ইসরায়েলের উত্তেজনা বাড়াবে কিনা?

ইসরায়েলের সেই ‘দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ খোলার আপাতত কোনো ইচ্ছা নেই। এরই মধ্যে গাজা থেকে কিছু ইসরায়েলি সেনাও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। হামাসের সাথেই তাদের মূল লড়াই এবং হামাস নেতাদের ও হামাসকে নির্মূল করতেই বদ্ধ পরিকর তারা। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক রেগেভ স্পষ্টভাবে বলেছেন, লেবানন বা হিজবুল্লাহর ওপর হামলা করছেননা তারা। তাদের উদ্দেশ্য হামাস নির্মূল করা। তাই হিজবুল্লাহ- ইসরায়েল উত্তেজনা বাড়াতে এ ঘটনা ততটা প্রভাব ফেলবে না।

আরৌরির মৃত্যু আরেকটি প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে তা হলো- গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের গতিবিধি লেবাননের বুদ্ধিমত্তার চেয়ে শক্তিশালী কিনা?

আরেকটি যুদ্ধবিরতি গ্রহণ করার আগে ইসরায়েলের একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য প্রয়োজন। এখনও অনেক হামাস নেতারা মুক্ত রয়েছেন এবং এর তিনজন শীর্ষ নেতা কাতারে বসবাস করছেন। এই প্রেক্ষিতে আল-আরৌরির একা মৃত্যু ইসরায়েলের প্রতিশ্রুতির চিহ্ন ব্যতীত সংগঠনের উপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।

তিনি বলেন, ২০০৭ সালে তার সাথে কথা বলার পর থেকে এখন পর্যন্ত এতোটা সময়ে ফিলিস্তিনের একটি নতুন প্রজন্ম সেসব স্কুল দ্বারা অনেকটাই উগ্রবাদী হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনিদের উগ্র মনোভাব ধরে রাখতে তিনি যে কৌশল নির্ধারণ করেছিলেন তা সমৃদ্ধ হচ্ছে। বর্তমানে তাই ইসরায়েলের পক্ষে একা হামাসকে নির্মূল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। গাজায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ ফিলিস্তিনিদের বাইরেও বিশ্বজুড়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ইসরায়েল সমালোচনার সেই ফাঁদ ৭ অক্টোবরের হামলার মধ্য দিয়েই শুরু করেছে হামাস।

সূত্র: চ্যাথাম হাউস থেকে অনুদিত, অনুবাদক: আসমা ইসলাম

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *