সারাদেশ

দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় এই নির্বাচন যুগান্তকারী: প্রধানমন্ত্রী

ডেস্ক রিপোর্ট: ভোটের আগে নিবন্ধন এবং আনুকূল্য পাওয়া ‘কিংস পার্টির’ বেহাল দশা নির্বাচনে। আলোচিতরা বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হওয়া দূরের কথা, কোন আসনেই ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারেনি তারা। প্রায় সবগুলো আসনেই জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার পথে তাদের। নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী, একটি নির্বাচনি এলাকায় যত ভোট পড়ে তার সাড়ে ১২ শতাংশ কোনো প্রার্থী না পেলে প্রার্থিতার সঙ্গে জমা দেওয়া জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হয়।

‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন, মহাসচিব ও নির্বাহী সভাপতি হেরেছেন নিজেদের আসনে। হারই কেবল নয় তাদের, তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন না। ছিলেন কেবল আলোচনায়, কিন্তু এর প্রকাশ হয়নি ভোটের চিত্রে।

সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার) থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরী বীর বিক্রম। সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভোটের রাজনীতিতে নতুন হলেও ছিলেন আলোচনায়। নির্বাচনে বিএনপি না আসার প্রেক্ষিতে তিনি ছিলেন রাজনীতি ও গণমাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রে। বিএনপির কতজন নেতাকে নির্বাচনে আনা যায় সে চেষ্টাও ছিল তার। একেবারে ব্যর্থ হয়ে যাননি। সাবেক বেশ কজন সংসদ সদস্যকে নিয়ে এসেছিলেন নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট কিংবা ‘আসন ভাগাভাগির সমঝোতা’ না করলেও নির্বাচনি এলাকায় তাকে সঙ্গ দিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ। নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে সেটা যথেষ্ট ছিল না যদিও, তবে মুখরক্ষা হয়েছে তার। আওয়ামী লীগের একাংশ না থাকলে এরচেয়ে ভয়াবহ হতে পারত ফল, এমনটাই মনে করছেন নির্বাচনি বিশ্লেষকেরা।

শমসের মুবিন চৌধুরী ভোট পেয়েছেন ১০ হাজার ৯৩৬; হয়েছেন তৃতীয়। তার আসনে বিজয়ী হয়েছেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। নাহিদ সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য। দ্বিতীয় হয়েছেন আওয়ামী লীগেরই আরেক নেতা সরওয়ার হোসেন। তার প্রাপ্ত ভোট ৩৯ হাজার ৪৮৮। এই আসনে প্রার্থী ছিলেন ছয়জন।

তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের অবস্থা আরও শোচনীয়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া তৈমূর আলম পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৯০ ভোট। শমসের মুবিন চৌধুরীর মতো আসনভিত্তিক তারও অবস্থান তৃতীয়। বিজয়ী গোলাম দস্তগীর গাজী পেয়েছেন ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৩ ভোট। দ্বিতীয় হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভুঁইয়া পেয়েছেন ৪৫ হাজার ৭৫ ভোট। এই আসনে প্রার্থী ছিলেন নয়জন। নিয়মের ফেরে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হচ্ছে এবার।

এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মেয়ে ও নির্বাহী সভাপতি অন্তরা সেলিমা হুদা নির্বাচন করেছেন মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে। অন্তরা হুদা পেয়েছেন মাত্র ৬ হাজার ৩৩৭ ভোট। বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিউদ্দিন আহমেদ, দ্বিতীয় হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম সারোয়ার পেয়েছেন ৬১ হাজার ৫৪০ ভোট। তৃতীয় হওয়া বিকল্পধারা বাংলাদেশের সংসদ সদস্য মাহী বি চৌধুরী পেয়েছেন ১৭ হাজার ৯৩৩ ভোট। এই আসনে জামানত বাজেয়াপ্ত হচ্ছে আলোচিত তৃণমূল বিএনপির অন্যতম শীর্ষ নেতা অন্তরা সেলিমা হুদার।

ভোটের আগে নিবন্ধন পাওয়া আরেক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর প্রার্থী হয়েছিলেন ফরিদপুর-১ আসনে। তিনি এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। তবে ভোটের মাঠে সুবিধা করতে পারেননি। আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুর রহমান পেয়েছেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৩৩১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঈগল প্রতীকের আরিফুর রহমান দোলন পেয়েছেন ৮৪ হাজার ৯৮৯ ভোট। ভোটের আগে নিবন্ধন পাওয়া আরেক দল বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির সভাপতি সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ মাইজভাণ্ডারী চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে নির্বাচন করলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই আসতে পারেননি। তার প্রাপ্ত ভোট মাত্র ৩ হাজার ১৩৮।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি ১৩৫, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ৫৬ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি ৭৯টি আসনে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন দেয়। এই দলগুলো সরকারের সঙ্গে সরাসরি সমঝোতায় আসন ভাগাভাগিতে ছিল না। তবে তাদের প্রতি সরকার-দল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সহায়তা ছিল। ফলে অনেক আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতারা প্রকাশ্যে-গোপনে অনেক প্রার্থীর সঙ্গে ছিলেন। তবু ভাগ্য বদলায়নি তাদের।

এবারের নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে নতুন নিবন্ধিত দলগুলোকে সহায়তাই কেবল নয়, নিজ দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থিতা উৎসাহিত করেছিল আওয়ামী লীগ। অনেক হেভিওয়েটকে হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেছেন। গতকাল (৭ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৯৯টি আসনের নির্বাচন। ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের জেরে ময়মনসিংহ-৩ আসনের একটি কেন্দ্রের ভোট বাতিল হওয়ায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ভোটের পার্থক্য ওই কেন্দ্রের মোট ভোটারের চেয়ে কম থাকায় ফল স্থগিত রয়েছে ওই আসনের। আর একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে নওগাঁ-২ আসনের নির্বাচন আগেই বাতিল করা হয়েছিল। এরই মধ্যে ২৯৮টি আসনের বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২২৫টিতেই নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ এককভাবে ২২৩টি আসনে এবং নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা ১৪-দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ একটি করে আসনে জিতেছে। নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ৬১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী, জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১টি আসন এবং দীর্ঘদিন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে শেষ মুহূর্তে এসে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি পেয়েছে একটি আসন।

নির্বাচনে বিএনপির দলছুট নেতাদের নিয়ে গঠিত এই সময়ের ‘কিংস পার্টি’র ভরাডুবি ঘটলেও ওয়ান-ইলেভেনের ‘কিংস পার্টি’ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তার বিজয়ে রয়েছে নৌকা প্রতীক না থাকার সুবিধা এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহায়তা।

তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, সুপ্রিম পার্টি, কল্যাণ পার্টিকে বলা হচ্ছে ‘কিংস পার্টি’। কিন্তু এর বাইরে কি কিংস পার্টি নেই এবার? ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, এমনকি জাতীয় পার্টির যে সকল প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন এবারের নির্বাচনে তারা কি সরকারি আনুকূল্য পাননি? পেয়েছেন। ১৪-দলের শরিকদের যারা জিতেছেন তারা সরাসরি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন, জাতীয় পার্টির যারা জিতেছেন তারা সমঝোতায় নৌকা প্রতীক ভোটে না রেখে জিতেছেন। তৃণমূল বিএনপিসহ নতুনদের কেবল কিংস পার্টি বললে কি তবে আংশিক উল্লেখ হয়? সম্ভবত হয়! নির্বাচনে বিজয়ী স্বতন্ত্রীরা ছাড়া বাকিরা আদতে কিংস পার্টি। তবু নির্বাচনি ফলাফলে তাদের বেহাল হাল!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *