সারাদেশ

প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবসায়িক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

ডেস্ক রিপোর্ট: চলমান ডলার সংকট এবং বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতিতে ক্রমেই ভারসাম্যহীন অর্থনীতির দিকে আগাচ্ছে দেশ। কয়েক দশক ধরে টেকসই জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক সূচকে উন্নতি সত্ত্বেও মুদ্রাস্ফীতিতে বাংলাদেশকে চরম অবনতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ২০২৪ এর ১০ জানুয়ারির সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশের রিজার্ভ ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়নে নেমে এসেছে, যা ২০২১ সালের অর্ধেকেরও কম। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে মুদ্রা সংকটের ধাক্কা।

বৃহস্পতিবার (১১ জানুয়ারি) গত সংসদের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছ থেকে দেশের অর্থনীতির দায়িত্বভার হস্তান্তরিত হয় নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে। বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ এসব চাপের মধ্যেই এমন নড়বড়ে অর্থনীতির উত্তরণের দায়িত্বভার এখন এই নতুন উত্তরাধিকারীর।
টানা ১৫ বছরের ক্ষমতা শেষে আবারও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের থেকে নবনির্বাচিত অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলীকেই সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ উভয় কারণে অর্থনীতির সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে দেশের। সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক কাজটিই হবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা। গত বছরগুলোতে করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের ফলে দেশের অর্থনীতিতে যে বড় আঘাতে আসে, তা মোকাবিলায় জরুরিভিত্তিতে কাজ করতে হবে তাকে।

করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের প্রভাব অনেক দেশের অর্থনীতিতেই ধস এনেছে। এর প্রভাবে উল্লেখযোগ্য হারে অনেক উন্নয়নশীল দেশের অগ্রগতি হ্রাস পেয়েছে। নীতিগত প্রতিক্রিয়ার অপর্যাপ্ততার কারণে বাংলাদেশেও এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। মাঝারি রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স প্রাপ্তির বিপরীতে আমদানির উচ্চ শুল্ক এবং ডলার সংকট এর প্রধান কারণ। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা সম্প্রতি ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি কমে গেছে। হুন্ডির প্রচলিত অর্থে রেমিটরদের ডলার দেশে প্রবেশ করছে না। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও হ্রাস পেয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থমন্ত্রীর একটি উজ্জ্বল ব্যর্থতা হল আর্থিক খাতে টেনে আনা শৃঙ্খলাহীনতা। অধিক সংখ্যক ব্যাংক শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে আর্থিক খাতের নাগাল প্রসারিত হলেও আরও গভীর হয়েছে অনিয়ম। উদাহরণস্বরূপ, জুন মাসে ব্যাংকিং খাতে অ-পারফর্মিং ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

গত দুই বছরে ব্যাঙ্কিং সেক্টরের কেলেঙ্কারির পরিস্থিতি এতোটাই গুরুতর হয়ে উঠেছে যে অনেক আমানত জমাদানকারী গ্রাহক তাদের আমানত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। দেওলিয়াত্ব এবং ঋণ খেলাপির নানা সংকটের পাশাপাশি এমন গুরুতর তহবিল সংকট ব্যাংকগুলোকে আরও বিপাকে ফেলেছে।
সুশাসনের অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিল নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং অনিয়ম এনপিএলের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এমন পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু অর্থমন্ত্রণালয় দুর্দশা হ্রাসে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি। একইভাবে নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাত, বীমা খাত এবং পুঁজিবাজারের অন্যায়কারীদেরও আইনের আওতায় আনা হয়নি।

২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের শীর্ষ নির্বাহীরা আগামী দুই বছরের জন্য জ্বালানি ঘাটতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ এবং বেকারত্বকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। চলমান পরিস্থিতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকট এখনও দেশটির নিম্ন-মধ্যম আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার ক্রয়-ক্ষমতাকে হ্রাস করছে।

মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব হলেও গত সাত বছর ধরে শীর্ষ আমলাদের নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এর কারণ হতে পারে এটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি বা সরকারের নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।

উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যাংকগুলোর উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। আমানত জমাদানে গ্রাহকদের অনাগ্রহ এবং ঋণ খেলাপি হয়ে অধিকাংশ ব্যাংকই ঋণ সংকটে ভুগছে। এসব ব্যাংকগুলোর ঋণের হার যখন প্রায় ৯ শতাংশ ছিল তখনই দেশটি ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলা করতে বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। বর্তমানে প্রায় এক বছর ধরে ঋণের হার ৯ শতাংশেরও বেশি যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

নতুন অর্থমন্ত্রীকে ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বর্তমান এই নিম্ন প্রবৃদ্ধির অর্থনীতিকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির গতিপথে নিয়ে যাওয়ার গুরুদায়িত্ব এখন তার।

বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৩-২৪ সালে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ পণ্যের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদি আশঙ্কাটি বাস্তবে রূপান্তরিত হয় তবে ‘কোভিড-হিট ২০১৯-২০২০’ এর পর এটি হবে এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ।

সাবেক অর্থমন্ত্রীর আরেকটি বড় ব্যর্থতা হল সরকারকে কর্মক্ষম রাখার জন্য ধার দেওয়া এবং প্রয়োজন ছাড়াই পর্যাপ্ত ট্যাক্স বাড়ানো। এটি দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতিকে এতোটাই ভঙ্গুর করে দিয়েছে যে জরুরি প্রয়োজনেও ব্যয় করার ক্ষমতা যথেষ্ট সীমিত হয়ে গেছে।

অন্যদিকে টানা ১১তম বছরেও কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এর ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এই ধরনের ঋণ মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়েছে। নির্ভরতা বেড়েছে বেসরকারি খাতেও। এমন পরিস্থিতিই উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বাধার সম্মুখীন করছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসাইন বলেছেন, ‘নতুন অর্থমন্ত্রী এমন একটি সময়ে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন যখন তার ঘোরাঘুরি করার মতো কোনো সময় থাকবে না। তাকে অবিলম্বে কাজে নামতে হবে। এমন জরুরি মুহূর্তে নতুন অর্থমন্ত্রীকে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিতে হবে।’

সূত্র: ডেইলি স্টার থেকে অনুদিত, অনুবাদক: আসমা ইসলাম

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *