আন্তর্জাতিক

গাড়ি চালকের সহযোগিতায় অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়ে নির্যাতন

ডেস্ক রিপোর্ট: শেরপুর জেলার নকলা থানার মৃত আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে সামিদুল ইসলাম (৩০)। একটা সময়ে ট্রাক চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। পরবর্তীতে ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজী হাসিবুর রহমান হিমেলের বাবার সান্নিধ্য পেয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি চালক হিসেবে নিয়োগ পান। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে হয়ে ওঠেন বিশ্বস্ত। আর এই সুযোগেই হিমেলের পরিবারের আর্থিক ও ব্যাংকে থাকা সম্পত্তি সংক্রান্ত তথ্য জেনে নেয়। এরপরই সেই তথ্যকে পুঁজি করে গত ১৬ ডিসেম্বর পেশাদার অপহরণকারী মালেকের নেতৃত্বে উত্তরায় এই অপহরণের পরিকল্পনা করা হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী হিমেলকে শেরপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাটারি বিক্রির সম্ভাবনার কথা জানায় সামিদুল। বিভিন্নভাবে লাভের প্রলোভন দেখিয়ে হিমেলকে শেরপুরে যেতে আগ্রহী করে। গত ২৬ ডিসেম্বর সকালে শেরপুরের উদ্দেশে রওনা করে। গাজীপুরের সালনা এলাকায় সামিদুলসহ হিমেলকে গাড়িসহ আটকে জিম্মি করা হয়। এরপর ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এলাকা ধোবাউড়ায় নেয়া হয়। এরপর গ্রেফতার রাসেল ও বিল্লাল তাদেরকে ধোবাউড়ায় পৌঁছে দিয়ে গাড়িটি নিয়ে গাজীপুরে এসে বাসন এলাকায় সড়কে ফেলে যায়। বিল্লাল পুঃনরায় ময়মনসিংহ চলে যায়। রাসেল উত্তরাতে হিমেলের মায়ের গতিবিধি অনুসরণ করেন।

ধোবাউড়ায় ৩ দিন অবস্থানের পর বিল্লাল ছাড়া মালেক, ছামিদুল ও অপহরণ চক্রের অন্য সদস্যরা হিমেলকে নিয়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী সুন্দরবন এলাকায় নিয়ে যায়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সদস্য রনি নাবালের সহযোগিতায় তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী পাহাড়ী এলাকায় একের পর এক পাহাড় পরিবর্তন করে আসছিল তারা। এসময় তারা হিমেলকে পাশবিকভাবে নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে মায়ের নাম্বারে পাঠিয়ে দুই কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন।

অপহৃত হিমেলকে উদ্ধার ও চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতারের পর র‌্যাব বলছে, চক্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাশবিক নির্যাতন ও হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে হিমেলকে ছেড়ে দেয়া। 

স্থানীয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক অপহরণকারী চক্রের হোতা মালেক। মালেক শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতের ত্রিপুরা ও মেঘালয়েও অপহরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তার নামে শুধু দেশেই রয়েছে ১৪টি মামলা। একই চক্রের সদস্য রনির বিরুদ্ধে মেঘালয় রাজ্যে একাধিক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন অপহরণ ও উদ্ধার অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, গত ২৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯ টায় রাজধানীর উত্তরা এলাকায় বসবাসকারী কাজী হাসিবুর রহমান ওরফে হিমেল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে অপহরণ করা হয়। সম্প্রতি বাবা মারা যাওয়ায় ব্যবসা দেখাশোনা করতেন তিনি। সম্প্রতি ব্যবসায়ীক কাজে সামিউলকে নিয়ে শেরপুর যাওয়ার পথে অপহরণের শিকার হন।

পরবর্তীতে পরিবার একাধিকবার হিমেলের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে ফোন করলে বন্ধ পান হিমেলের মা তহুরা বিনতে হক। অনেক যোগাযোগ করেও মা তহুরা ছেলের সন্ধান না পেয়ে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। যার ডায়েরি নং-২৪৪৪। গত ২৮ ডিসেম্বর গাজীপুরের বাসন এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হিমেলের গাড়িটি উদ্ধার করে।

পরবর্তীতে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি অপহৃত হিমেলের মায়ের হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে অপহরণের বিষয়টি জানায় এবং ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে তারা হিমেলকে পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও পাঠায়।

পরবর্তীতে হিমেলের মামা বাদী হয়ে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় গত ৬ জানুয়ারি একটি অপহরণের মামলা দায়ের করেন; যার মামলা নং-৬। মা তহুরা ছেলেকে উদ্ধারে র‌্যাবের নিকটও অভিযোগ দায়ের করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ জানুয়ারি র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-১, র‌্যাব-৯ ও র‌্যাব-১৪ এর দল সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে অপহরণকারী চক্রের মূলহোতা ও পরিকল্পনাকারী মো. আব্দুল মালেক (৩৫), তার অন্যতম সহযোগী ও পরিকল্পনাকারী ড্রাইভার সামিদুল ইসলাম (৩০) কে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত রাতে অপহৃত ভিকটিম হাসিবুর রহমান ওরফে হিমেলকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় রনি নাবাল (৪১) কে।

তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত রাতে রাজধানীর উত্তরা হতে রাসেল মিয়া (৩৪), ও বিল্লাল হোসেন (২৪) নামে চক্রের আরও দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে উদ্ধার করা হয় ১টি বিদেশি পিস্তল, ২ রাউন্ড গুলি ও ২টি ওয়াকিটকি সেট।

স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, হিমেলের বাবা ব্যাটারি বিক্রির ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি(আইইউবিএটি) এর চতুর্থ বর্ষের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হিমেল। বাবা ৪ মাস পূর্বে মৃত্যুবরণ করায় পড়াশুনার পাশাপাশি ব্যবসায় নামে হিমেল।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভয়ংকর অপহরণকারী ভুক্তভোগী হিমেলের মাকে একটি বিদেশি হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার থেকে ফোন করে অপহরণের বিষয়টি জানিয়ে প্রথমে ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করে এবং তার ছেলেকে পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও পাঠানো হয়। পর্যায়ক্রমে এক কোটি তারপর ৫০ লাখ তারপর ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা হয়।

অপহরণকারীরা গত ২৩ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে আসতে বলে। বিষয়টি তিনি র‌্যাবকেও জানান। পরবর্তীতে গত ২৩ জানুয়ারি অপহৃত হিমেলের মা নেত্রকোনায় পৌঁছলে মালেক ও সামিদুল তাকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে আসতে বলে। তখন র‌্যাবের একটি দল সুনামগঞ্জের তাহিরপুরেঅভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

কমান্ডার মঈন বলেন, মালেক পেশায় একজন গাড়ি চালক। তিনি গাড়ি চালানোর পেশার আড়ালে একটি সংঘবদ্ধ অপহরণ চক্রের নেতৃত্ব দিতেন। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে থাকে মালেক। মুক্তিপণ দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা পৈচাশিক নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে আত্বীয়-স্বজনের নিকট পাঠিয়ে মুক্তিপন আদায় করতো। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অপহরণ, অস্ত্র আইন, বিষ্ফোরক আইন, ডাকাতি-ছিনতাই ও খুনসহ ১৪টির অধিক মামলায় ৮ বছরের অধিক সময় কারাভোগ করেছে। সর্বশেষ ময়মনসিংহের একজন অধ্যাপকের ছেলে অপহরণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ৩ বছর কারাভোগ করে ২০২২ সালের ডিসেম্বর ছাড়া পায়।

রনি পেশায় একজন অটো চালক। সে মালেকের প্রধান সহযোগী। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহ তার পরিচিত মালেকের নির্দেশনায় বিভিন্ন সময় অপহৃতদের সীমান্তবর্তী পাহাড়ী ও দুর্গম এলাকায় আটকে রেখে নির্যাতন করত। অস্ত্র ও ডাকাতিসহ ২টি মামলায় ৬ বছরের বেশি সময় কারাগারে ছিলো।

রাসেল ও বিল্লাল পেশায় গাড়ি চালক। তারা গ্রেফতার মালেকের সহযোগী। রাসেল ময়মনসিংহ থেকে ফিরে এসে রাজধানীর উত্তরায় অবস্থান নিয়ে হিমেলের মা এবং তার পরিবারের সদস্যদের গতিবিধি অনুসরণ করার দায়িত্ব পালন করে। তারাও একাধিক মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *