সারাদেশ

দীঘিতে ভেসে উঠল শরীর বিহীন দুই পা

ডেস্ক রিপোর্ট: ২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মানুষের সংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) যে তথ্য দিয়েছে, তার চেয়ে সাত গুণ বেশি মানুষ আহত হয়ে সাতটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির দাবি, ২০২৩ সালে দেশের সাতটি হাসপাতালেই আহত হয়ে ৫৩ হাজার ২০৭ জন ভর্তি হয়েছিল। তবে বিআরটিএর তথ্য বলছে মাত্র ৭ হাজার ৪৯৫ জন আহত হয়েছে।

রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত ‘এসডিজি’র লক্ষ্য অর্জনে সরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক উৎস থেকে সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক ডাটা ব্যাংক চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব জানানো হয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গত বছর থেকে প্রথমবারের মত বিআরটিএ সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা গেছে, বিআরটিএ প্রতিবেদনের সঙ্গে পুলিশের প্রতিবেদন ও যাত্রী কল্যাণ সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবেদনের ব্যাপক অমিল রয়েছে। বিআরটিএ’র সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে ৫,৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫,০২৪ জন নিহত, ৭,৪৯৫ জন আহত হয়েছে।

পুলিশের প্রতিবেদনে, ২০২৩ সালে ৫,০৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪,৪৭৫ জন নিহত হয়েছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে, ২০২৩ সালে ৬,২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭,৯০২ জন নিহত, ১০,৩৭২ জন আহতের তথ্য মিলেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল রোড সেফটি রিপোর্ট ২০২৩ এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২১ সালে ৩১,৫৭৮ জন নিহত হয়েছে। বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার কোন প্রকার খতিয়ে দেখা ছাড়াই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টকে অবাস্তব, যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনকে অতিরঞ্জিত বলে দাবি করেছে।

অন্যদিকে, বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা নিহত এবং আহতের সংখ্যা কাছাকাছি হওয়ায় বিআরটিএ’র সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতিসহ সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করে, যে কোন ঘটনায় একজন নিহতের পেছনে ৩ থেকে ১০ জন পর্যন্ত আহত হয়ে থাকে। যা বিআরটিএ’র রিপোর্টে আসেনি। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন তথা সেকেন্ডারি সোর্সের সমপরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য বিআরটিএ’র বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে তুলে আনতে না পারায় এই রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ না করায়, বিআরটিএ’র মাঠ পর্যায়ে তাদের রিপোর্টের উৎস ও রিপোর্ট তৈরির মেকানিজম সর্ম্পকে সম্যক ধারণা না থাকায়, রিপোর্টে এহেন দুর্বলতা ফুটে উঠেছে বলে পরিবহন সংশ্লিষ্ট ও বুয়েটের দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা মনে করে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব আরও বলেন, বিআরটিএ’র রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৩ সালে ৫৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০২৪ জন নিহত, ৭৪৯৫ জন আহত হয়েছে। এই সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য বিআরটিএ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে তৈরি করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও এখানে কোন হাসপাতালের তথ্য নেওয়া হয়নি। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ তাদের সড়ক ঘটনার পরিসংখ্যান সঠিক এবং নির্ভুল দাবি করলেও যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল) ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ১৪,৩৫৭ জন রোগী জরুরি বিভাগে ভর্তি হয়েছে। একই সময়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৯,৮৭৯ জন। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৯,২৯৩ জন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৪,৭৮৪ জন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ৩,৫৬৩ জন। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৬,৭৪৮ জন। ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ খানপুর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৪,৫৮৩ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ভর্তি হয়েছে। দেশের মাত্র ৭টি হাসপাতালেই ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জরুরি বিভাগে ভর্তির তথ্য মিলেছে ৫৩ হাজার ২০৭ জন।

বিআরটিএ’র প্রতিবেদনে দেশের একটি বিভাগীয় সদর হাসপাতালে ভর্তিকৃত সড়ক দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যাও সারাদেশ থেকে তুলে আনতে পারেনি দাবি করে তিনি বলেন, যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সারাদেশে ৬৪টি জেলা সদর হাসপাতাল প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ জন। ৮ বিভাগে ১০টি বিভাগীয় বড় হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ২০ জন হারে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তি হচ্ছে। সারাদেশে ৮০০০ নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতালের চিত্রও অনুরূপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীর ১৫ শতাংশ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এমন আহত আড়াই থেকে তিন লাখ রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় কি পরিমাণ মারা গেছে তার চিত্র বিআরটিএ’র রিপোর্টে আসেনি। ফলে বিআরটিএ’র রিপোর্টে হতাহতের সংখ্যা ও দুর্ঘটনার সংখ্যাতে যে বিভ্রান্তি রয়েছে তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

সভায় বক্তারা দাবি করেন, গত এক দশকে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ১৫ লাখ থেকে ৪৫ লাখে উন্নীত হয়েছে, একই সময়ে ৩০ লাখের বেশি ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ ছোট ছোট যানবাহন বেড়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসবিহীন যানবাহনও দ্বিগুণ হয়েছে। কৃষি শ্রমিকেরা বেশি লাভের আশায় ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছে। এসব কারণে সড়কে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে, এর সাথে পাল্লা দিয়ে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, ২০১২ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২১,৩১৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। যা ২০১৫ সালে ২৪, ১৯৫৪ জনে উন্নীত হয়। ২০২৩ সালের গ্লোবাল রোড সেফটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১,৫৭৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এবং আহতের সংখ্যা নিহতের প্রায় ৯ থেকে ১০ গুণ। দেশের মাত্র ৭টি হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তির চিত্র এহেন হতাহতের সাক্ষ্য দেয়।

সভায় বাংলাদেশ সরকারকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যকে আমলে নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বক্তারা বলেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যে রিপোর্টটি দিয়েছে এটা বাংলাদেশের জন্য আলাদাভাবে করা হয়নি, যা সব দেশের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর ও একটি বেসরকারি সংস্থা পর্যবেক্ষণে ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩,৩৬০ জন নিহতের তথ্য পেয়েছে। তখন সরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল মাত্র ২,০০০ জন।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসরণ করে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই সড়ক দুর্ঘটনা কমে এসেছে। ২০১০ সালের তুলনায় মৃত্যুর হার কমেছে অন্তত ১০৮টি দেশে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা, বেলারুশ, ব্রুনাই দারুসসালাম, ডেনমার্ক, জাপান, লিথুয়ানিয়া, নরওয়ে, রাশিয়া, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভেনিজুয়েলার মত ১০টি দেশে মৃত্যুর হার অর্ধেকের বেশি কমিয়ে এনেছে। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে সড়ক নিরাপত্তায় বড় ধরনের অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার ডাটাবেজ সিস্টেম আধুনিকায়নের প্রকল্পও এতে সংযুক্ত রয়েছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মনে করে, বিআরটিএ প্রাথমিক উৎস থেকে সড়ক দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ডাটা সংগ্রহ করলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টের সমপরিমাণ হতাহত ও দুর্ঘটনার তথ্য উঠে আসবে। কিন্তু বিআরটিএ সেকেন্ডারি সোর্স ব্যবহারের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র তুলে আনতে পারছে না। ফলে দেশের মানুষের জীবন বাঁচাতে সরকার সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে এসডিজি’র লক্ষ্য অর্জনে সরকারি উদ্যোগে বিআরটিএ মাধ্যমে প্রাথমিক উৎস থেকে সড়ক দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ভাটা ব্যাংক চালুর দাবি জানান বক্তারা। একই সঙ্গে ছোট যানবাহন বন্ধ করে নিরাপদ সাশ্রয়ী ও স্মার্ট গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *