সারাদেশ

গণপরিবহন সমাচার ও ঈদযাত্রায় সড়ক নিরাপত্তার অগ্রাধিকার 

ডেস্ক রিপোর্ট: গণপরিবহন সমাচার ও ঈদযাত্রায় সড়ক নিরাপত্তার অগ্রাধিকার 

ছবি: সংগৃহীত

ঘটনাটি উপনিবেশিক বাংলার প্রথম আমলের। কন্ডাকটর অতিরিক্ত যাত্রী তোলায় কলকাতার বিডন স্ট্রিট থেকে ট্রামে উঠে পুলিশ কোর্ট পর্যন্ত পুরো রাস্তা বাবু আহুরলাল সেনকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছে। নামার সময় তাই তিনি ভাড়া দিতে অস্বীকার করলেন।

সেই নিয়ে বাগবিতণ্ডা। গ্রেফতার করে তাকে আদালতে চালান করা হল। মামলা উঠল প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে। চললো পক্ষে-বিপক্ষে সওয়ালজবাব, জেরা।

সব শুনে অবশেষে বিচারপতি রায় দিলেন, ভাড়া না দিয়ে যাত্রী কোনও অন্যায় করেননি! যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের খেয়াল রাখা ট্রাম কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। মামলা ডিসমিস। 

১৮৮০ সালের এই বিবরণ আজ পড়ে আশ্চর্য লাগলেও এ কথা সত্যি, কলকাতার গড়ে ওঠা ও প্রসারের সঙ্গে গত দেড়শো বছর ধরে জড়িয়ে আছে ট্রামের প্রসার ও গণপরিবহনের ইতিহাস। 

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো এই যে, শতাধিক বছর পেরিয়ে গেলেও পরিবহনকর্মীদের বেপরোয়া আচরণ ও নিষ্ঠুরতা থামছে না। বিষয়টি উদ্বেগজনক । কারণ, বর্তমান বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর সবচেয়ে বেশি ঘটনাগুলো হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে জড়িয়ে আছে গণপরিবহন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। 

বেপরোয়া গাড়ি চালনায় সৃষ্ট দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর তালিকা বেশ দীর্ঘ। প্রতিদিনই শীর্ষ সংবাদের স্থান দখল করে এইসব দুর্ঘটনার মর্মান্তিক বিবরণ। এছাড়াও রয়েছে চলন্ত বাস থেকে লাথি মেরে বা ধাক্কা দিয়ে যাত্রীদের ফেলে হত্যা করার মতো পৈশাচিক ঘটনা।

ঘটনাগুলো পরিবহন খাতে বিদ্যমান অরাজকতারই প্রমাণ দেয়। গণপরিবহনে চলাচল করতে গিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ধরনের যাত্রীরাই নানাভাবে নিগৃহীত হন। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সংঘটিত ঘটনাগুলো আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় ঈদ ও বিভিন্ন ছুটির সময়ে। ভাড়া বৃদ্ধি ও অমানবিক আচরণে সেই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে জিম্মি হতে হয়। 

কোনো কোনো পরিবহনকর্মীর আচরণ কতটা নিষ্ঠুর ও অমানবিক হতে পারে, যা বলার মতো নয়। অনেকগুলো দৃষ্টান্তের মধ্যে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পায়েলের হত্যাকারীরা শাস্তি পেয়েছে আদালতে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এরপরও খুব কমসংখ্যক পরিবহনকর্মীর আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন ও পেশাদারিত্বের লক্ষণ দেখা গেছে। তাদের বেপরোয়া আচরণ স্তিমিত হলেও মোটেও বদলে যায় নি।  

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২৩৭ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। ২০২২ সালের দিকেও শতাধিক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার শিকারের বড় একটা অংশ পথচারী। রাতে ও ভোর রাতে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটেছে। শীতের মাসে কুয়াশা থাকায় এসব ঘটনা আরও বেশি ঘটলেও ঈদ বা বিভিন্ন উৎসবে তা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। 

বেশির ভাগ দুর্ঘটনা হয় গাড়িচাপায় বা গাড়ির ধাক্কায়। যার জন্য দায়ী করা হয় চালক ও হেলপারের অবহেলা, অসতর্কতা ও অমনোযোগকে। তাদের কারণে একজন মানুষ আহত বা নিহত হচ্ছে বা আস্ত একটি পরিবার বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক যে ক্ষতি হচ্ছে, তার হিসাব তৈরি করেছে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বলছে- ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। আর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে মানবসম্পদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার আর্থিক মূল্য ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।

সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে গত এক যুগে জাতীয় বাজেটে ধারাবাহিকভাবে বরাদ্দ বেড়েছে। এ সময়ে নতুন সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি পুরোনো সড়কও চওড়া হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সড়ক আইন পাশ করেছে সরকার; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সড়কে কোনোভাবেই মৃত্যু কমছে না। গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী দেশে সড়ক দুর্ঘটনার পিছনে মোটা দাগে কয়েকটি কারণ পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে, চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অতিরিক্ত গতি, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও সড়ক।

তবে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যু নিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে এমন এক তথ্য বলেছে যে, সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়া, যত্রতত্র রাস্তা পারাপার, মোবাইল ফোনে চোখ রেখে চলাচল এবং যানবাহনে সংখ্যা বেড়ে যাওয়া অন্যতম কারণ। এর বাইরে রয়েছে চালকের বেতন, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকায় মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর প্রবণতা, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জনসাধারণের ওভারব্রিজ, ফুটপাত না মানা এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে, একটা সুশৃঙ্খল নিয়মনীতি তৈরি করতে হবে যাতে চালক ও সাধারণ মানুষ সেই আইন মানতে বাধ্য হয়। যথাযথ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা যেন কমানো যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমাতে সারা বছর যে তৎপরতা, তা ঈদের আগে ও পরে আরও বাড়াতে হবে। সে সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণের টানে বড় শহর থেকে দেশগ্রামের বাড়িতে যায়। শেষ পর্যায়ে ছুটি পাওয়ায় পরিকল্পনা করে ট্রেন বা বাসের টিকেট করা নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। তারা চলাচল করেন চরম ঝুঁকি নিয়ে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার শিকার হন।

গণপরিবহনের সমস্যা ও বিপদগুলো বিবেচনায় নিয়ে ঈদযাত্রা প্রাক্কালে সড়ক নিরাপত্তার অগ্রাধিকারকে নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের বিশেষভাবে তৎপর হওয়া বাঞ্ছনীয়। নচেৎ সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমবে না এবং ঈদের আগে ও পরে যেমন দেখা যায় প্রতিবছর, তেমনই ভয়াবহ চিত্র এবারও দেখা যাওয়ায় আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতএব, আগেভাগের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপই কেবল সড়কের প্রাণঘাতী বিপদ হ্রাস করতে পারে। 

পথহারা পথিক ও পণ্যবর্জনে বিচলিত জন

ছবি: বার্তা২৪.কম

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের ভয়াবহ নৃশংসতা, শিশুহত্যা, ত্রাণসামগ্রী ঢুকতে না দেওয়াসহ আরও নানাবিধ কারণে গোটা বিশ্বে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে ইসরাইলি বর্বরতার প্রতিবাদ হিসেবে দেশটির পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হয়েছিল গত প্রায় ছয়মাস আগে। ইসরাইলি পণ্যবর্জনের ডাক অমুসলিম দেশ থেকে শুরু হয়েছিল। সেটা এখন আরও বেশি সরব হয়েছে। মার্চ ২৬ তারিখে জাতিসংঘে যুদ্ধ বন্ধের জন্য সারা বিশ্বের আহবান পাস হয়েছে। কিন্তু পণ্য বর্জনের ঘটনা ইসরায়েলকে অনেকটা বিপাকে ফেলে দিয়েছে। কারণ, তাদের নিত্যপণ্যে ব্যবসা সারা বিশ্বজুড়ে। মানুষ ক্রমাগতভাবে তাদের পণ্য ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে থাকলে বিপদ অনিবার্য।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের গুঞ্জন শুরু হয়েছিল গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকে। ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য নামক একজন সাংবাদিকের থেকে এই আহবান সর্বপ্রথম করা হয়েছে বলে জানা গেছে। শুরুর দিকে এটাকে কেউ ততটা আমলে নেয়নি। কারণ, ভারত এতবড় দেশ, এত বিস্তৃত তাদের পণ্যের বাজার তা শুধু বাংলাদেশের মানুষ বর্জন করলে কিছু যায়-আসে না। কিন্তু ভারতীয় পণ্য সারা বিশ্বে বসবাসকারী প্রায় তিন কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি এবং দেশে দেশে তাদের সুহৃদরাও বর্জন করতে শুরু করলে ইসরায়েলের মতো অবস্থা শুরু হতে কতক্ষণ?
শুরু থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহবান দিনে দিনে বেশ জোরদার হয়েছে। আমাদের দেশের কর্ণধার থেকে নীতিনির্ধারণীদের মুখেও ‘শাড়ি, ডিম, তেল, পিঁয়াজু, কাবাব’ ইত্যাদিকে সম্পৃক্ত করে রসালো বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। যেটা আরও বেশি প্রচারিত হয়ে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে।

বিএনপির-মতো বড় রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চায়নি। কারণ বিএনপি শাসনামলেও অনেক বেশি ভারতীয় নিত্যপণ্য আমদানি করা হতো। পুনরায় ক্ষমতায় এলে ভারতীয় পণ্য আমদানি করতে হবে। তাই এতদিন বিএনপি শুধু নির্বাচন নিয়ে বিরোধিতা করে আসছিল। শুরুতে আমলে না নিলেও বাংলাদেশে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের সাম্প্রতিক অতিকথনের জেরে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ইস্যুটি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশেষ করে দুজন মন্ত্রী এব্যাপারে বেশি ভূমিকা রেখেছেন। একজন মন্ত্রীর সেদিনের বক্তব্য শুনে একটি পত্রিকা মন্তব্য করেছে- ‘মন্ত্রী ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাককে আরও বেগবান করলেন।’‘মন্ত্রিদের এমন বেফাঁস বক্তব্য শুনে হয়তো ভারত সরকার নিজেরাই বিব্রত ও লজ্জাবোধ করছেন।’ভারতের সবাইতো বাংলাদেশের একটিমাত্র রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন না।

অনেক পত্রিকায় এব্যাপারে সংবাদ হয়েছে। গত জাতীয় নির্বাচনে ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছে এমন কথা মন্ত্রির বক্তব্য হিসেবে প্রচারিত হবার পর থেকে অফিসিয়ালি ভারতের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে। তা হলো- ‘ভারত একতরফা আওয়ামী লীগের পক্ষে সহায়তা করেছে।’এখানে ভারতের পক্ষে থেকে বাংলাদেশের আপামর মানুষের কল্যাণের দিকটি উপেক্ষা করা হয়েছে। তাই কমবেশি বাংলাদেশের ৬০-৭০ ভাগ মানুষ এটা নিয়ে গোস্বা করেছে। ভারতের বিরোধী দলগুলোও তাদের সরকারের এই পক্ষপাতমূলক আচরণকে মেনে নেয়নি। সেদিন একজন বাজারে গিয়ে ক্ষোভ ঝাড়লেন, ‘বাংলাদেশিদের ভারতীয় পণ্য বর্জন শুধু বিজেপি সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, গোস্বা, মান-অভিমান সবকিছুকে কেন্দ্র করে।

বিএনপি এই বক্তব্যকে রাজনৈতিক ইস্যু বানাতে দেরি করেনি। কারণ, নানা কারণে, বহু বছর যাবত বাংলাদেশের মানুষ ভারতের ওপর নাখোশ হয়ে আছেন। তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়ার সাথে বেশি সরব হয়ে উঠেছে।

এই ক্ষোভের সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত বিষয়গুলো ভারত সবসময় উপেক্ষা করে আসছে। অভিন্ন নদীর পানিবন্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা বন্ধ না হওয়া, গরু রফতানি নিষিদ্ধ, পেঁয়াজের ওপর বাড়তি কর বসানো ইত্যাদি বাংলাদেশের মানুষ ভালভাবে নেয়নি। ২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে বিএসএফের গুলিতে সীমান্তে ১,২৭৩ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ১,২৮৩ জন। ফেলানি হত্যার বিষয়টি বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছিল। এবছর স্বাধীনতা দিবসের দিনেও সীমান্তে দুজন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষকে অবহেলা ও হেয় চোখে দেখাটা আজকাল ভারত ফেরত যাত্রীদের মুখে মুখে আলোচনার বিষয়। বিশেষ করে চিকিৎসার জন্য গেলে বলা হয় তোমরা কেন এখানে আসো? বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ, জুম্মার নামাজে নামাজরতদের ওপর মোদি পুলিশের লাথি, গুজরাটে তারাবির নামাজে মুসলিম শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, ইত্যাদি ইস্যু শুধু বিএনপি বা বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ আওয়ামী লীগের সমর্থকগণ নয়- সারা বিশ্বের মুসলিমদের ওপর ক্ষত তৈরি করে দিয়েছে। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে বিদেশি শিক্ষার্থীরা। কিন্তু মোদি সরকার সেদিকে কর্ণপাত না করে চুপ করে আছেন। বিগত নির্বাচনে মোদি সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ বাংলাদেশের মানুষকে চরমভাবে আহত করেছে। তাই ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ না থেকে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যে অসম অবস্থা বিরাজমান। দুই দেশের বাণিজ্যে ঢেড় পার্থক্য থাকলেও এটাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। এক হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। শিক্ষার্থী, পুণ্যার্থী ও ভ্রমণকারীর সংখ্যা আরও বেশি।
ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রফতানি বাংলাদেশে হয় ও সেভেন সিস্টারে পণ্য পাঠানো বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সূচিত হয়। ভারত সয়াবিন, পেঁয়াজ, মশলা, কসমেটিকস্ ইত্যাদি বাংলাদেশে রফতানি করে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের মানুষ ৭ লাখ ২৭ হাজার টন পেঁয়াজ খেয়েছে তার ৭ শতাংশ ভারত থেকে এসেছিল।

কথায় কথায় দেশটা স্বাধীন করে দিয়ে ভুল করেছি বলে তারা খোটা দেয়। যেটা বাংলাদেশের অনেকে পছন্দ করেন না। সীমান্ত হত্যা, ফারাক্কা ও তিস্তা নদীর পানির ন্যয্য হিস্যা দিতে গড়িমসি নদীপাড়ের ভুক্তোভোগী মানুষের দীর্ঘদিনের কষ্টকে আরও বেশি খোঁচা দেয়। ভারতের ফেনসিডিল ও অন্যান্য মাদকের জন্য বাংলাদেশের কিশোর, যুবসমাজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

তবে বিএনপি ভারতীয় পণ্যবর্জনের সমর্থন দেওয়ায় ভারত কি বিএনপির প্রতি আরও বেশি হোস্টাইল হবে? তাহলে ভারতের এদেশের মানুষের প্রতি একচোখা নীতির আরও বেশি প্রতিফলন ঘটবে এবং তারা ভারতের প্রতি আরও বেশি বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকবে। যা উভয় দেশের মধ্যে সৎপ্রতিবেশীসুলভ বৈশিষ্ট্যকে ধুলিস্মাৎ করে দেবে।

তাহলে নেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী কেন ভারত শুধু একটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য সহায়তা করলো? তারা একটি দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে এদেশের সিংহভাগ মানুষকে হেয় করেছে। কেড়ে নিয়েছে তাদের অধিকার। এখন একটি দল ক্ষমতায় বসে ভারতের স্তুতি গাইতে গিয়ে নিজেদের গোমর ফাঁস করে দেওয়ায় ভারতের অনেকেই বিব্রত বোধ করছেন। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই তাদের বক্তব্যে অনেকটা বিব্রত হয়ে পড়েছেন।

এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় এখন ভারতীয় পণ্য বর্জনের ইস্যু। ইতোমধ্যে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, বিএনপি কি পথহারা পথিকের মতো দিশেহারা হয়ে নিজের গায়ের চাদর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আগুন লাগিয়ে প্রতিবাদ করছে? নাকি তামাশা করছে ? কেউবা বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা হতে কাজী নজরুলের কপালকুন্তলায় উদ্বৃত বনানী -কুন্তলা ষোড়ষীর বনের বুক চিড়ে বেড়িয়ে পথহারা যুবক-পথিকের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?’ হয়তোবা কারো কারো মনে সেটার উদ্রেক হতে পারে।

কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায় তারাও সেটা ভালভাবে জানেন। পথহারা পথিক বনের মধ্যে দিশেহারা হয়ে সুন্দরের দর্শনে নির্বাক হয়ে যাওয়ায় কোন উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু বিএনপির সামনে সব কিছু পক্ষপাতমূলক, অসুন্দর ও দৃষ্টিকটু মনে হওয়ায় দীর্ঘদিনের নির্বাক গোস্বা হঠাৎ সবাক ক্ষোভে পরিণত হয়ে যাওয়ায় একজন নীতিনির্ধারক কঠিন শীতে উষ্ণতাদানকারী তার গায়ের প্রিয় চাদরটিকে ছুঁড়ে দিয়ে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মাত্র। পাশাপাশি একই ক্ষোভে বিহ্বল বাকিরা সেটাকে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করেছে। সাধারণত: এক প্রিয়জনের নির্মম আঘাতে অপর প্রিয়জনের প্রতিবাদের ভাষা এমনই প্রতিঘাত ও ঘৃণা হিসেবে প্রকাশিত হয়। যেখানে পথিক কোন শিশুও নয়, অবুঝও নয় এবং নিজে থেকে পথহারা নয়। তারা ক্ষমতালোভীদের রোষানলে কঠিন পরিস্থিতির শিকার হয়ে এটাকেই প্রতিবাদের ভাষা মনে করে।

তাই ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবার জন্য ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকে বিএনপির সমর্থন একটি চমৎকার প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের মাধ্যমে বিএনপি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভারতের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক মেসেজ দিতে পারে। যেটা তাদের ভবিষ্যতে দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার পথকে প্রশস্ত করতে পারে। অনেকে এটা অবমূল্যায়ন করে বিতর্কে অবতীর্ণ হতে পারেন। কিন্তু ইতিহাসের অনেক তুচ্ছ ঘটনাকে তাচ্ছিল্য করার ফলে সুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে আসার নজির রয়েছে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

;

বর্জনে অসারের তর্জন গর্জন সার

ছবি: বার্তা২৪.কম

দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের একটা প্রচারণা শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন এটা ছিল কেবল সামাজিক মাধ্যমে। এখন এটা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আগে যদিও ছিল, তবে সেটার প্রভাব এতখানি বিস্তৃত ছিল না।

রুহুল কবির রিজভীর পরনের চাদর ছুড়ে ফেলা এবং এরপর পুড়ানোর ঘটনার পর এখন এটা নিয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেছেন। ঘটনা যখন এত দূর গড়িয়েছে, তখন ধারণা করা যায়, খুব সহসা এটা থামছে না। যদিও শেষ পর্যন্ত এটা চূড়ান্ত বর্জন পর্যন্ত না পৌঁছে বাগযুদ্ধ পর্যন্তই সীমিত থাকবে।

বিএনপি মুখে ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে তাদের এই ভারত-বিরোধিতা চালিয়ে যেতে হয়েছে। দলটির ধারণা এবং প্রচারণা বলছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছে ভারত বা ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থনে আওয়ামী লীগ ‘যেনতেন উপায়ে’ নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাদের ধারণা, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ টিকে আছে মূলত ভারতের সমর্থন ও সহায়তার কারণে। সবশেষ নির্বাচনে পশ্চিমা দেশগুলোর তৎপরতাকে যেভাবে উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ তাতে বিএনপির এই ধারণা আরও শক্ত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েও আমেরিকা ও ইইউভুক্ত দেশগুলো যে শেষ পর্যন্ত কঠোর হয়নি, এখানেও রয়েছে ভারতের প্রভাব। বিএনপির এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্য, যেখানে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘গত নির্বাচনে ভারত বাংলাদেশের পাশে ছিল বলে বড় বড় দেশগুলো অশুভ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।’ হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ওই সময় ভারত আমাদের পাশে ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনে ভারত আমাদের সঙ্গে ছিল। এবারও ভারত আমাদের পাশে ছিল ও আছে।’

বিএনপির বিশ্বাস আর মন্ত্রীদের বক্তব্য যখন কাছাকাছি, তখন দলটি এবার কামান দাগাচ্ছে ভারতের দিকেই। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে এখন সামনে এনেছে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা। প্রচারণায় সর্বশক্তি দেওয়ার এ প্রবণতায় মাঝে মাঝে ভ্রম হয়—ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বুঝি বাংলাদেশের ওপরই নির্ভরশীল! অথচ বাস্তবতা ঠিক উল্টো। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়ে।

বাজার ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিজের পরনের ভারতীয় পণ্য (চাদর) ছুড়ে ফেলে দিয়ে এরপর নেতাকর্মীদের মাধ্যমে আগুনে পুড়ানোর দুইদিন পর ২২ মার্চ ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ভারতীয় পণ্য বয়কটের নামে বিএনপি বাজার ব্যবস্থা অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্র করছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি নেতার (রিজভী) শাল ফেলে দিয়ে ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রদর্শন করা পাগলামি। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি বড় অংশ আসে ভারত থেকে। বিএনপির এক নেতা (আব্দুল মঈন খান) গণতন্ত্র উদ্ধারে ভারতের সহযোগিতা চায়, আবার আরেক নেতা ভারতের পণ্য বয়কটের ডাক দেয়। আসলে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেরা দিশেহারা হয়ে গেছে।’

ভারত বর্জনের প্রচারণায় যখন সংহতি জানালেন রুহুল কবির রিজভী, এর দিন তিনেক পর কিন্তু বিএনপির ইফতার মাহফিলে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের কূটনীতিকরা। গত ২৪ মার্চ রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে কূটনীতিকদের সম্মানে বিএনপি যে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে তাতে অংশ নেন ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ড. বিনয় জর্জসহ দেশটির দূতাবাসের আরও কয়েকজন। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রিজভী ইফতার মাহফিলে না থাকলেও দল কিন্তু এখানে ভারতকে বর্জন করতে পারেনি।

দলের নীতিনির্ধারণীতে রুহুল কবির রিজভী যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, তিনি দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব; এবং নিত্যকার সংবাদ সম্মেলনের বেশিরভাগ তিনিই করে থাকেন। তার হঠাৎ ভারত-বিদ্বেষ প্রকাশ্য হলেও এটা নিয়ে দলের মধ্যে যে আলোচনা হয়নি তা এর মধ্যেই প্রকাশিত। যদিও বিএনপির যাবতীয় সিদ্ধান্ত দেশে হয় না, লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশনা আসে, এবং সে অনুযায়ী সেটা প্রকাশিত হয়। রিজভীর এই ভারতীয় পণ্য বর্জনে সংহতি প্রকাশ লন্ডন থেকে আসা সিদ্ধান্ত, নাকি রিজভীর একার তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তার চাদর-নাটক যে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে দেশের রাজনীতিতে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভারত-বিরোধিতা এবং ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিষয়টি কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ১১ মার্চ বিষয়টি তুলেছেন মুশফিকুল ফজল আনসারী। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্বে থাকা মুশফিকুল ফজল আনসারী মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কাছে জানতে চান, ”মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ছে। একতরফা নির্বাচনের পর প্রতিবেশী ভারতে তৈরি পণ্য বর্জনকে উৎসাহিত করছে জনগণ। তাদের সন্দেহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এই পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?” জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘এই প্রচারণা সম্পর্কেও আমরা অবহিত। আমি অবশ্যই ভোক্তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না—সেটা বাংলাদেশ হোক বা বিশ্বের অন্য কোথাও। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করি। অবাধ, মুক্ত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিত করাসহ অভিন্ন স্বার্থে দুই দেশের সরকারের সঙ্গেই আমরা অব্যাহতভাবে কাজ করব।’ এরপরই রুহুল কবির রিজভীর এই চাদর ছুড়ে ফেলা আর আগুন দেওয়ার ঘটনা। অর্থাৎ নির্বাচনকেন্দ্রিক এই ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা, যেখানে আমাদের অতিপরিচিত ‘দেশি পণ্য, কিনে হও ধন্য’ স্লোগানের কোনো সম্পর্ক নেই; সব সম্পর্ক, সব বিরোধিতা মূলত রাজনৈতিক। রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়ালের চেষ্টা।

এই যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা, এটা যদি দেশি পণ্যের প্রসারের উদ্দেশ্যে হতো, তাহলে সমস্যা ছিল না। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আওয়াজ তোলা হয়েছে, এবং সে অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণা চলছে। এই প্রচার-প্রচারণা আবার লুফে নিয়েছে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কথা বলছেন, কথা বলছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কথা বলছেন অন্য মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও। গতকাল বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিএনপির এক নেতা (রুহুল কবির রিজভী) চাদর খুলে বলে দিয়েছেন, ভারতের পণ্য ব্যবহার করবেন না। যে নেতারা বলছেন ভারতীয় পণ্য বর্জন করেন, তাদের বউদের কয়খানা ভারতীয় শাড়ি আছে? তারা বউদের কাছ থেকে শাড়িগুলো এনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন? আমি বিএনপি নেতাদের বলব, তাদের বউরা যেন ভারতীয় শাড়ি না পরেন। যেদিন ওগুলো এনে অফিসের সামনে পোড়াবেন, সেদিন বিশ্বাস করব, আপনারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আরেক বক্তব্যে বলেছেন, ‘চিরাচরিত পাকিস্তানি কায়দায় ভারতের বিরোধিতা শুরু করেছে বিএনপি। তারা যখন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না পায়, তখনই এই একটা ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর আমলেও করেছে, এখন শেখ হাসিনার আমলেও তাই করছে।’ বলা যায়, রুহুল কবির রিজভীর একটা চাদর কেবল চাদরই থাকল না, এটা রাজনৈতিক অঙ্গনে বাগযুদ্ধের এক প্রপঞ্চ হয়ে গেছে।

মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এভাবে কোনো দেশের পণ্য কি বর্জন করা সম্ভব? আমাদের দেশে কি সম্ভব ভারতের সব পণ্য বর্জনের? যে বিএনপি নেতারা বর্জনের পক্ষে তর্জন গর্জন করছেন তারা কি বাস্তবতা টের পান না? গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর যেদিন খুলেছেন সেদিনই কি প্রমাণ হয়নি রুহুল কবির রিজভী ভারতের পণ্যের অন্যতম ভোক্তা? অন্য অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, সামান্য এক উদাহরণ দিলেও বলা যায়—যে সিএনজিচালিত অটোরিকশার দখলে রাজধানীসহ সারাদেশ, সে অটোরিকশাগুলোও আসে ভারত থেকে। ২০০২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে এই সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়, এবং এর শুরুটা করে বিএনপি সরকারই। মোটরসাইকেলসহ অন্য অনেক যানবাহন, নিত্য ভোগ্যপণ্য, ব্যবহার্য পণ্যের অনেক কিছুতেই আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাকে অস্বীকার করার উপায় নাই।

আমরা জানি, বিএনপিও জানে এসব; কিন্তু স্বীকার করছে না। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ভারত-বিরোধী প্রচারণাকে। এটাকে কি বলা যায় ‘অসারের তর্জন গর্জন সার’? কারণ রাজপথ আর রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতাহীনের গর্জনই বেশি শোনা যায়। বিএনপি এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ হয়ে আছে এই ভারতের পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা বা তর্জন গর্জন দিয়ে।

তবু বলি, এই বাকযুদ্ধে সরকার ও সরকার দল আওয়ামী লীগের বিপুল অংশগ্রহণ জরুরি নয়। জরুরি নয় মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক বাক্য খরচের। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত অন্তঃসারশূন্য যে প্রচার-প্রচারণা, সেখানে অংশ না নেওয়াটাই হতে পারে যথার্থ সিদ্ধান্ত।

;

সফুরের পুড়ে অঙ্গার হওয়া ও রাষ্ট্রের গভীর ‘ঘুম’

ছবি: বার্তা২৪.কম

দেশে অপঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে, তাতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি’ চাওয়া প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক নির্মল সেনের সেই আকাঙ্ক্ষা আজ যেন বিদ্রুপ করছে! আমরা কে যে কখন অপঘাতের এই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চলেছি তা বলা কঠিন!

রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের দীর্ঘ ঔদাসীন্যে যখনই একেকটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ছুটতে শুরু করে, তখনই তাদের কিঞ্চিৎ নিদ্রাভঙ্গ ঘটে। মিডিয়ার তৎপরতায় তাদের দৌঁড়ঝাঁপ কিছু সময় সমান্তরালে চলতে থাকে। ফের গভীর ঘুমে চলে যান তারা!

হতাশাজনক এই অবস্থায় উপনীত হয়ে প্রতিদিনই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়, কোথায় কী ঘটতে চলেছে! সংবাদপত্রের অফিসগুলোতে অপঘাতের মৃত্যুর এই হরহামেশা ব্যাপারটি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কেবল সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হয় ঘটনার ভয়াবহতা।

শুনতে খারাপ লাগলেও মানুষের প্রাণের মূল্য আজ এমনি মূল্যহীন হয়ে পড়েছে যে, নিত্যনতুন ঘটনার ডামাডোলে, আজকের ‘ক্রন্দনরোল’ দু’দিন বাদে কোথায় যে অপসৃত হয়ে যাচ্ছে, আমরা কেউ তার খোঁজ রাখি না। বাস্তবতা আমাদের এমন জায়গায় উপনীত করেছে যে, বর্তমানের এই সমাজকে ‘প্রাণহীন’, ‘মূল্যবোধহীন’ বললেও বোধহয় কম বলা হবে।

গেল সোমবার (২৫ মার্চ, ২০২৪) বিকেলে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কালঘর এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগুনে পুড়ে ছফুর নামের সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকের মৃত্যু পাষাণ হৃদয়কেও টলিয়ে দিয়েছে! এ দু’দিন ফেসবুকের পাতায় সফুরের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ছবিটি ঘুরে ফিরে আমাদের দংশন করেছে।

ফায়ার সার্ভিসের বরাতে ঘটনার বিবরণে যা জানা যাচ্ছে, হাইওয়ের গাছবাড়িয়া এলাকায় পুলিশ বালুবাহী একটি ডাম্প ট্রাককে থামার নির্দেশ দিলেও চালক নির্দেশ অমান্য করে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে থাকেন। বেপরোয়া গতির ট্রাকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে ধাক্কা দিলে অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতভাগ্য চালক নিজের সিটে বসেই নির্মম মৃত্যুকে বরণ করেন।

সফুরের মৃত্যুর শোক কেটে উঠতে না উঠতেই গতকাল (২৬ মার্চ, ২০২৪) একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যুর খবর পেলাম আমরা। খবরে প্রকাশ, মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় মঙ্গলবার ভোরে জুড়ীর পূর্ব গোয়ালবাড়ি গ্রামের মখলিছ মিয়ার বাড়িতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ওই পরিবারের ৫ জনের অপমৃত্যু ঘটে।

দুর্ঘটনা ঘটবে, এতে হতাহতও হবেন কেউ না কেউ; কিন্তু চারপাশে অপঘাতে এমন মৃত্যুর মিছিল যে রাষ্ট্রের বিভাগগুলোর ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনার কারণেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যদি পথ দুর্ঘটনার কথাই বলি, তবে বলতে হবে দেশের সড়কগুলো যেন মৃত্যুর ফাঁদ রচনা করে বসে আছে।

সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু তারও একটা মাত্রা আছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, সংশ্লিষ্ট সবার আইন মানার প্রবণতা আর কর্তৃপক্ষের কঠোর তদারকির মাধ্যমে এই মাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। আমাদের সরকারের বিপুলসংখ্যক কর্মচারী জনগণের করের অর্থে নানা ‘প্রকল্প’ সংক্রান্তে (অভিজ্ঞতা লাভ, কেনাকাটা ইত্যাদি) বিদেশ ভ্রমণ করেন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করে বিশ্বে যেসব দেশ রোলমডেল হয়েছে, সেসব দেশের অভিজ্ঞতা লাভে আমাদের ‘রাজ কর্মচারীরা’ বিদেশ সফর করেছেন কি না আমাদের জানা নেই, তবে নিশ্চয়ই করবার কথা। যদি এ ধরনের সফরে গিয়েই থাকেন তবে লব্ধ অভিজ্ঞতার কী কাজে লাগানো হয়েছে, তা আমরা জানতে চাই! সড়কে মৃত্যুর এই মিছিল বন্ধে আইনের প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মনোবৃত্তির যে বিরাট পরিবর্তন করা জরুরি আর বাংলাদেশের যে বাস্তবতা তাতে সম্পূর্ণরূপে খোলনলচে বদলে ফেলার বিকল্প কী হতে পারে, তা আমাদের জানা নেই।

তবে যুৎসই একটি শব্দ প্রয়োগ করা যেতেই পারে। তা হচ্ছে, ‘আমূল পরিবর্তন’। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট নেতারা কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ‘রাজ কর্মচারীরা’ এই রকম পরিবর্তনের প্রয়াস আদৌ কি হতে দেবেন বা ইতোপূর্বে দিয়েছেন! এর সোজাসাপটা উত্তর- ‘না’।

সোশ্যাল মিডিয়ায় গেল দু’দিনের বিস্তর মুক্ত আলোচনায় কেবলমাত্র পরিবহন ও যোগাযোগ খাত নিয়ে নাগরিকেরা যত অভিমত তুলে ধরেছেন, তা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। তবে যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার ও বর্তমান বাস্তবতা আমাদের কী পরিমাণ ঝুঁকিতে রাখে, তা নিয়ে কিছু মন্তব্য নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। অনেকের অভিমত, গাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসভর্তি সিলিন্ডারগুলো একেকটি চলন্ত বোমা।

দেশের এই চলন্ত বোমা (মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা ব্যবহার অনুপযোগী) নিয়ে কতসংখ্যক যানবাহন নিত্যদিন চলছে তার হিসাব আমাদের জানা নেই। সড়কে গাড়ির কাগজপত্রের বৈধতা দেখতে যেভাবে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়, ঠিক তেমনি করে সিলিন্ডারের উপযোগিতা দেখার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষের এমন তদারকি চোখে পড়ে না।

কিন্তু বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলবেন। তবে আমরা স্বল্পজ্ঞানে এইটুকু বুঝতে পারি, এই জায়গাটিতে যথেষ্ট উদাসীনতা বিরাজমান এবং আমরা এও শুনি, তদারকি কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে ছাড়পত্র নিতে অসুবিধা হয় না। তার মানে সুশাসনের অভাব দুর্ঘটনা রোধের প্রতিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিরুদ্ধেই করা যাবে।

আমরা জানি না, সড়কে নাগরিকদের মৃত্যুর এই মিছিল থামাতে রাষ্ট্র আদৌ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না কিংবা ‘কঠোরতর’ পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত কার্যকারিতার মুখ দেখবে কি না! তবে আপাতদৃষ্টিতে তার কোনো সুলক্ষণ চোখে পড়ছে না বিধায় আমাদের দীর্ঘশ্বাস হয়ত আরও দীর্ঘায়িতই হবে।

একইভাবে বলা যায়, অগ্নি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান গেল এক দশকেই আমরা জানতে পারছি, তাতে শিউরে না ওঠার কোনো উপায় নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের তোড়জোড়ে অগণন মানুষের প্রাণহানি ইতিহাসে লেখা হবে না।

সংশ্লিষ্টদের হেলায় বহু প্রাণ ঝরে যাওয়ায় দায়ীদের দায়মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্র হয়ত ক্ষমতাবানদেরই পাশে থাকবে। আর ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ টাইপের কিছু বচন আওড়ে রাজনীতির সরেস মানুষেরা ক্ষমতার মসনদে পালাবদল করবেন!

;

‘মুক্তিযুদ্ধ’র সমাপ্তি টানতে যে কাজ আজও বাকী

ছবি: সংগৃহীত

এই বছরের মার্চের ২৫ তারিখে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেল দোল পূর্ণিমা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত দোলের দিনে রঙের খেলায় মেতে উঠেন । বোলপুরের শান্তিনিকেতন এই দিনে রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠে। তবে এখন দোল পূর্ণিমার কথা হবে না। শুধু মনে করিয়ে দিতে এসেছি ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাত দশটা থেকে ঢাকার রাস্তায় ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নেমেছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে৷ সেই রাতে বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছিল বাংলাদেশের যেসব বড়ো বড়ো শহরে ক্যান্টনমেন্ট ছিল, সেইসব শহরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি রক্তপিপাসু সৈন্যরা। সেই বড়ো দুঃখের দিনের কিছু কথা বলতে এসেছি।

যতদিন বাঙালি জাতি স্মৃতিশক্তি হারাবে না, বিশেষ করে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছেন, যেসব পরিবার থেকে তাঁদের মা-বোনদের এই হায়েনারা ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক নির্যাতন করেছিল… হত্যা করেছিল সেইসব পরিবার কোনোদিন ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত একটা দিনকেও ভুলতে পারবেন না। এইসব পরিবারের সদস্যরা ধুঁকে ধুঁকে বেঁচেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। এঁদের সাথে যুক্ত করুন এক কোটি শরণার্থীদের যাঁরা বাধ্য হয়েছিল দেশ ত্যাগ করতে এবং দেশের ভিতরেও কোটি কোটি মানুষ নিজ বাড়িতে থাকতে না পেরে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে বের হতে পারবেন।

পাকিস্তানিরা এই দেশের মুসলমানদের সাচ্চা মুসলমান ভাবত না। তারা এঁদের ভারতের দালাল ভাবত। ওরা আমাদের দেশের মুসলমানদের নিকৃষ্ট ভাবত, আরও একটি কারণে যে তাদের দৃষ্টিতে বাঙালি মুসলিমরা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছে। তাই তাদের এতটুকু কষ্ট হয়নি, খারাপ লাগেনি, পরকালের ভয় হয়নি পাখির মতো গুলি করে মারতে আমাদের ভাইদের, বাবাদের, আমাদের সন্তানদের। এক চুকনগরে কয়েকঘন্টায় দশ সহস্রাধিক বাঙালিকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছে এই জালিমরা।

তখন বিশ্বজুড়ে চলছিল সমাজতান্ত্রিক এবং ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই। তাই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পাশে দাঁড়ালো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন না থাকলে ভারত এতবড়ো ঝুঁকি নিত কি না সন্দেহ আছে। কেননা ঠিক ঐ সময়ে আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক পাতানোর কাজে দূতিয়ালি করছিল পাকিস্তান। চীন ছিল পাকিস্তানের মিত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কও ভালো ছিল। যদিও সাধারণ মার্কিন জনগণ এই জেনোসাইডের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। তাঁদের ছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধের নির্মম অভিজ্ঞতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ভিয়েতনাম থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজছিল। মার্কিন প্রশাসনের কাজ ছিল তখন কোনো দেশের জনগণ শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাঁদের টুঁটি চেপে ধরত। না জানি এখানে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে যায়! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও মার্কিন সরকারের এই ভয় ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। ১৯৪৭ সালের অল্প কিছু সময়ের পর থেকেই বাঙালিরা নানারকম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল। তার প্রথম রক্তঝরা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে। ‘৫২ এর হাত ধরেই আসে একাত্তর।

গভীর শ্রদ্ধা জানাই ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে যেসব নীরিহ বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন। সংসদ নির্বাচনে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও পাকিস্তানি জেনারেলরা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তার বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমরা জাতিসংঘ থেকে জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। আরও ৫৩ বৎসর অপেক্ষা করতে হবে? অনেকেই আর্মেনিয়ার উদাহরণ দেখায় ওদের ওপর করা অটোমান সাম্রাজ্যের জেনোসাইডের স্বীকৃতি পেতে, তাও আংশিক, ১০০ বছর লেগেছিল। তাহলে কি আমাদের সেদিকে ঠেলে দিচ্ছে?

আপনারা সোচ্চার হন জাতিসংঘ কর্তৃক আমাদের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে। আমাদের মা-বোনদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, আমাদের ত্রিশ লক্ষ শহিদের হত্যা করেছিল, তাঁদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। ওঁরা আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। আর আমাদের কর্তব্য হলো যারা একাজ করেছিল তাদের বিচার করা। আর সেটি সম্ভব হবে যখন আমরা জেনোসাইডের স্বীকৃতি পাবো। তাই আসুন আজ থেকে গণহত্যা না বলে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে যা কিছু সংঘটিত করেছে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী, একে আমরা বলব জেনোসাইড। আর একটি কথা আপনাদের সন্তানদের, আপনাদের বংশধরদের বলে যান-কী ঘটেছিল ১৯৭১ সালে এই দেশে। কেননা জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের যুদ্ধে ওদের অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে। সেদিন হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

;

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *