আন্তর্জাতিক

রাজত্ব এখন বীরদের নয়, বাহাদুরদের

ডেস্ক রিপোর্ট: বিশ্বজুড়ে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতির পথেই হাঁটছে। বাংলাদেশ কেবল একমাত্র কিংবা ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ চলমান ধারারই অংশ মাত্র। আমাদের উপমহাদেশের তিন পৃথক রাষ্ট্রের অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নির্বাচনী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মধ্যে ব্যাপক ভিন্নতা মোটেও নেই। তিন রাষ্ট্রের গণতন্ত্র ফ্যাসিবাদী গণতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই সত্যটি এখন উন্মোচিত বা প্রকাশ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও নির্বাচনী গণতন্ত্র কমবেশি একই পথের যাত্রী।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিকৃত রুচির মানুষও আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এবং পরবর্তী নির্বাচনে পরাজিত হবার পরও প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ না করে জোরপূর্বক অবস্থান নেন। এবং কারচুপির অভিযোগ তুলে নিজেকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে তাকে জোরপূর্বক রাষ্ট্রীয় বাহিনী বের করার আয়োজন করলে তিনি অবস্থা বেগতিক টের পেয়ে দ্রুত সটকে পড়েন। আগামী নির্বাচনেও তিনি দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। এতে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিদ্যমান দশাটি অস্পষ্ট থাকেনি!

যে মুসোলিনী ইতালিতে সমাজতান্ত্রিক হিসেবে নিজের দলকে জাহির করে জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়ে চরম ফ্যাসিবাদী রূপে নিজেকে স্বৈরশাসকে পরিণত করেছিলেন। সেই মুসোলিনীকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে বিক্ষুব্ধ জনগণ হত্যা করেছিল। ঘৃণিত সেই মুসোলিনীর অনুসারী দল গত নির্বাচনে ইতালিতে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসেছে। সুইডেনেও চরম প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থি দল গত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয়েছে। জায়নবাদী ইসরায়েলি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অজস্র প্রমাণিত অভিযোগের পরও তিনি ক্ষমতায় বহাল থেকে ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অভিযোগগুলোর তদন্তও চলছে। গণহত্যা সংঘটনে অভিযোগগুলো ইতিমধ্যে ঢাকা পড়েছে।

রাশিয়ার পুতিন তো গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে দেশে রাজতান্ত্রিক শাসন কায়েম করেছেন। কোনো বিরোধী দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে না দিয়ে কঠোর হস্তে দমন করে এসেছেন। অনুগত বিরোধী দল ক’টিকে টিকিয়ে রেখেছেন গণতন্ত্রের ছদ্মবেশ ধারণের অভিপ্রায়ে। এই ছদ্মবেশ বিশ্বে বিভিন্ন তথাকথিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশে প্রচলিত রয়েছে। আমাদের দেশেও তো বটেই। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বনাম স্বতন্ত্রধারী আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নির্বাচনী লড়াই যেমন আমরা দেখেছি। তেমনি দেখেছি অনুগত বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকেও।

সরকারের সাথে সমঝোতা করে তারা আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে বিরোধী দল হিসেবে আসন নিয়েছে। ১৪ দলীয় জোটের সাথে অতীতে নির্বাচনী ঐক্য থাকলেও চলতি টার্মে সেটা উপেক্ষা করে শরিকদের অনেক নেতাকে কুপোকাৎ করে নিজেদের প্রার্থীকে জয়ী করা হয়েছে। এতে ১৪ দলের অনেক নেতা কাক্সিক্ষত সাংসদ পর্যন্ত হতে পারেননি। নাখোশ হলেও সরকারের বিরাগভাজন হয়ে দুর্ভোগ, নির্যাতনের ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে আছেন।

আমাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে এবং তামাশাপূর্ণ একতরফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হরেক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়েছে। সম্প্রতি ভারতের লোকসভা নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছেন। গত দশ বছরে মোদি সরকার দেশের এবং দেশবাসীকে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রতিশ্রুতি পালন না করলেও, তার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও সর্বাধিক আসন পেয়েছে। বাংলায় প্রবচন আছে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ধর্মকে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হিসেবে বলা হয়েছে। মোদির ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটছে।

ভারতীয়দের ইহজাগতিক সমস্যা, অনাহার, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ওই ধর্মের কলে ভুলিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপিকেই রক্ষাকর্তা রূপে বিবেচনা করেছে। ইহজাগতিক সমস্যা থেকে তারা পারলৌকিক সুখ-সুবিধা পাবার মোহে মোদিকেই পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে, তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা পায়নি। বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে নির্ভর করতে হচ্ছে জেডি ইউনাইটেডের নীতিশকুমার এবং তেলেগু দেশম পার্টির চন্দ্রবাবু নাইডুর ওপর। এবং তাদের সমর্থনে সরকার টিকে থাকবে। সমর্থন হারালে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে পড়বে।

বিশ্বে এখন আর বীরদের কদর নেই। কদর বাহাদুরদের। যারা ক্ষমতার জোরে বাহাদুরি দেখাতে সক্ষম, মানুষ তাদেরকেই আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে। বাবরি মসজিদ ভেঙে দেয়ার বাহাদুরি, সেই স্থানে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতার জোরে বিরোধীদের, অহিন্দুদের দমন পীড়নে সিদ্ধহস্ত হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের তাবৎ বাহাদুরিতে দেশটিতে হিন্দু জাগরণে ভারতীয় জনগণ তাদেরকেই আস্থায় নিয়েছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার বিপরীতে রাষ্ট্রকে দলীয় কাজে ব্যবহার করার বাহাদুরি, জুডিশিয়ালের ওপর কর্তৃত্ব করার বাহাদুরি ইত্যকার বাহাদুরিতে বলবান মোদি সরকারকেই অবদার হিসেবে ভারতীয় সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় দেখেছে।

মানুষের অসাধ্য সাধনের ইত্যকার বাহাদুরিতে বাহাদুরদেরই তারা যোগ্য বিবেচনা করে একচেটিয়া ভোট দিয়ে সরকার গঠনে ভূমিকা রেখেছিল গত দশ বছর। এবার প্রথম ধাক্কাটা এলো ওই জনগণের কাছ থেকেই। হিন্দু জাগরণে জনগণের আশা-আকাক্ষা পূরণে ব্যর্থ বিজেপি সরকারের ওপর অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ জনগণ প্রায় প্রত্যাখ্যানই করেছে। নয়তো নিরঙ্কুশ বিজয়ী বিজেপি’র এমন দশা হবে কেন! ধর্মাশ্রিত রাজনীতি কতটা অমানবিক ও ঘৃণা-বিদ্বেষের জন্ম দিতে পারে বিগত দশ বছর সেটা বিশ্বাবাসী দেখেছে।

আমাদের উপমহাদেশ খণ্ডিত হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের খড়গে। যদিও সেটা জাতিতত্বের ভুল ব্যাখ্যা ছিল। ছিল দুই প্রধান সম্প্রদায়ের বিভাজন। কংগ্রেস যদি এক জাতির আওয়াজ না তুলতো তাহলে মুসলমানেরা দ্বিজাতিতত্ত্ব হাজির করার সুযোগ পেত না। ওই তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্ব সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে স্থায়ী আসন নিয়ে বসেছে।

বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। এটা বিগত দশ বছরব্যাপী মোদি শাসনের ওপর জনগণের চপেটাঘাত নিশ্চয়। মোদি সরকার আগামী পাঁচ বছর একক আধিপত্য অতীতের ন্যায় ফলাতে পারবে না। বিজেপিকে সমর্থন চাইতে হয়েছে নীতিশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডুর কাছে। তাদের কাক্সিক্ষত চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে তারা সমর্থন প্রত্যাহার করবে এবং অতীতের সকল জোট সরকারের ন্যায় বিজেপি সরকারেরও পতন ঘটবে।

ভারতে ইতিপূর্বে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া কোনো জোট সরকার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। জওহরলাল নেহেরুর পর টানা তৃতীয়বারের ন্যায় প্রধারমন্ত্রী হবার গৌরব নরেন্দ্র মোদি অর্জন করলেও; তার ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং না থাকার দোলাচলে কখন যে হুট করে পড়ে যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। রাজা ত্রিশঙ্কুর অবস্থায় ঝুলে থাকতে হবে মোদি সরকারকে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *