আন্তর্জাতিক

‘একসঙ্গে ১শ’ বিল্ডিংয়ে উদ্ধার সক্ষমতাও নেই আমাদের’

ডেস্ক রিপোর্ট: ভূমিকম্পে একসঙ্গে ১০০ বিল্ডিং ধ্বসে পড়লে তা উদ্ধারের সক্ষমতাও বাংলাদেশের নেই-জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান। রোববার (৩ ডিসেম্বর ২০২৩) বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।

কেবল রাজধানী ঢাকাই নয়, গোটা দেশই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ১০০ বছরের বেশি সময় বাংলাদেশ বড় ধরণের ভূমিকম্প না হওয়ায় আমরা প্রস্তুতির জন্য সময় পাচ্ছি। এই সময় কাজে লাগিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।

বার্তা২৪.কম: গতকাল আমরা একটি মৃদু ভূমিকম্প অনুভব করেছি। বাংলাদেশের বড় ধরণের ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে কি ভবিষ্যতবাণী আছে ?

অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান: বাংলাদেশে অতীতে যেহেতু ভূমিকম্প হয়েছে ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু এটা কোথায় কখন হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। জাপান, তুরস্ক বা ইউএসএ’র পশ্চিমাঞ্চলে যেমন ঘন ঘন বড় ধরণের ভূমিকম্প হয় ওই রকম কাছাকাছি না। ভারতে বা মিয়ানমারে, নেপালে যে রকম, আমাদের সেরকম না। মাঝারি দূর্যোগ ঝুঁকিতে আমরা। একশ’ বছরে বড় ধরণের ভূমিকম্প হয় নাই আমাদের কিন্তু হবে না তা নয়। তা নির্ভর করে কোন অঞ্চলে উৎসটা আছে তার ওপর। উৎসটা কতটুকু সক্রিয় তার ওপর। গতকাল যে ভূমিকম্প হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যাবে না যে বড় একটি ভূমিকম্প হয়ে যাবে। ডিটেইল স্টাডি করে আমি একটি সম্ভাব্য প্রেডিকশন করতে পারি…যে এই এলাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে আগামীতে এমনটা হতে পারে। যে এলাকায় বড় ধরণের ভূমিকম্প হয় তার একটি রেকর্ড থাকে হিস্ট্রিতে। একটি ভূমিকম্প হয়তো ২শ’ বছর আগে হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে…

বার্তা২৪.কম: ভূমিকম্প নিয়ে বাংলাদেশে কি সেই ধরণের উল্লেখযোগ্য গবেষণা হচ্ছে?

অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান: আমাদের অনেক গবেষণা আছে। আমরা ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছি। আন্তর্জাতিক জার্নালেও আমাদের অনেক আর্টিকেল আছে।

বার্তা২৪.কম: এসব গবেষণার ফাইন্ডিংসগুলো যদি বলতেন, বিশেষ করে ঢাকা কি ধরণের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে?  

অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান: রাজধানী ঢাকা উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। ঢাকার যেহেতু বিল্ডিংগুলোর বড় অংশ যেহেতু ভূমিকম্প সহনীয় না…ভবনগুলি সেভাবে নির্মাণ করাও হয়নি, এজন্য আমাদের ঝুঁকি বেশি। হ্যাজার্ড কিন্তু অতো না। যেমন একশ’ বছরের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় নাই। ১০০ বছর আগে ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে মানিকগঞ্জের দিকে। সেই ভূমিকম্পে ঢাকার তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় নাই। এখনো অনেক ফল্টস আমরা আইডেন্টিফাই করতে পারি নাই। আর আইডেন্টিফাই না করে বললে তা অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারে। কারণ এর অনেক অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। যদি বলা হয় ঢাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি আছে, এতে নির্মাণের ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ বেড়ে যেতে পারে। আর যদি বলা হয় এমন ঝুঁকি নেই তাহলে নির্মাণ খরচ অনেক কমে গেল। একটি ফল্টস আছে বা নেই বলার তফাৎ বিস্তর। যদি বলি ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের কথা, তাহলে কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেরই সেই সক্ষমতা নেই মোকাবেলার। বিশে^র অনেক উন্নত দেশেরই নাই, এমনকি আমেরিকা-কানাডা-জাপানেরও নাই। আমি ৯ মাত্রার ভূমিকম্প কিভাবে মোকাবেলা করব?

বার্তা২৪.কম: গতকাল একটি মৃদু ভূমিকম্প আমরা অতিক্রম করলাম। যদি আরও প্রবল আকারের ভূমিকম্প হয়, তা মোকাবেলায় ঢাকা কতখানি প্রস্তুত আমরা?  

অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান: বড় ধরণের ভূমিকম্প মোকাবেলায় আমরা এতো প্রস্তুত না। তুরস্কের মতো দেশ যাদের অনেক সরঞ্জাম আছে ভূমিকম্প মোকাবেলায় তাতেও কিন্তু তারা পারলো না।ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার ভালো করেছে। ভূমিকম্পের আগে যে প্রস্তুতিগুলি তা কিন্তু তুরস্কও করতে পারেনি। বিল্ডিংগুলো দুর্বল হওয়াতে তুরস্কের ক্ষয়ক্ষতিগুলি কিন্তু বেড়ে গেছে। যদিও পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় উদ্ধার তৎপরতায় তারা ভালোই সক্ষমতা দেখিয়েছে। আমাদের কিন্তু সেই দক্ষতাটি নেই। তুরস্কে ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়…আমাদের যেহেতু ১০০ বছরে বেশি সময় বড় ধরণের ভূমিকম্প নাই, ছোট ছোট হচ্ছে..আমরা এর জন্য ধীরে ধীরে যে প্রস্তুতি নিচ্ছি এটা ওই পর্যায়ে পৌছায় নাই। যদি ইমার্জেন্সি রেসপন্স করতে হয় বড় ধরণের ভূমিকম্পের জন্য আমরা তা পারব না। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা লাগবে, সব দেশেরই লাগে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া ওই ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের সুবিধা হলো আমাদের যেহেতু একশ বছরের বেশি ভূমিকম্প হয় না আমরা একটা সুযোগ পাচ্ছি প্রিপারেশন নেওয়ার। ঝুঁকি সহনীয় ভবন নির্মাণ, দুর্বল বিল্ডিং চিহ্নিত করে রিমুভ করা ইত্যাদি।

বার্তা২৪.কম: সেই সুযোগ কতটুকু কাজে লাগাতে পারছি আমরা? 

অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান: সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছি না আমরা। এই সুযোগ কাজে লাগানো উচিত আমাদের। সুযোগগুলি কাজে লাগাতে পারলে ভূমিকম্প ঝুঁকিও কমবে। লম্বা সময়ের জন্য হ্যাজার্ডটা খুব নাই। কারণ এখন যেসব বিল্ডিং হচ্ছে তা সহনীয় ভাবে তৈরি হচ্ছে। বিল্ডিংগুলো রেজিস্ট্যান্ট হলে পরবর্তীতে ভূমিকম্পে আমাদের ঝুঁকি কমবে। তাই এটা করতে হবে জরুরি। আর ইমার্জেন্সি রেসপন্সের জন্য আমাদের প্রশিক্ষণ-সরঞ্জাম পর্যাপ্ত সংস্থান রাখা প্রয়োজন। ভূমিকম্প হয়ে গেলে পরবর্তীতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে করণীয়সহ দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। যদিও ভূমিকম্প মোকাবেলার প্রস্তুতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আমরা হয়তো আলোচনার মধ্যেই আছি। কিছু যন্ত্রপাতি হয়তো এনেছি। এই যন্ত্রপাতি দিয়ে কয়টা বিল্ডিংকে আমরা উদ্ধার করতে পারব? যদি ১০০ বিল্ডিং একসঙ্গে পড়ে যায়, তাহলেও তো আমরা এগুলোকে রেসকিউ করতে পারব না।

বার্তা২৪.কম: আপনাদের গবেষণা অনুযায়ী শুধু রাজধানী ঢাকাতে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা ভবনের সংখ্যা কত হবে?  

অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান: সাম্প্রতিক গবেষণা তথ্য আমাদের নেই। পনের বছর আগের যে তথ্য আছে তাতে আমরা বলেছি ৭৪ হাজার বিল্ডিং উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, যা এখন কয়েক লাখে পৌছেছে। এখন কিন্তু শুধু ঢাকা শহর নয়, সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিত ধরতে হবে। সারা বাংলাদেশেই কিন্তু প্রচুর বিল্ডিং হচ্ছে। ভূমিকম্পকে আগে আমরা বলতাম আর্বান ডিজাস্টার। এখন আর আর্বান না, রুর‌্যাল-আর্বান সবই হয়ে গেছে। এখন বিল্ডিং থাকা মানেই মানুষ মারা। একটা কথা আছে ‘ভূমিকম্প মানুষ মারে না, মানুষ মারে বিল্ডিং’। এখন গ্রামেও ১০ তলা বিল্ডিং দেখা যাবে। সুতরাং সারাদেশেই ঝুঁকি আছে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *