সারাদেশ

অবরোধের সমর্থনে রাজধানী‌তে গণঅধিকার পরিষদের বিক্ষোভ

ডেস্ক রিপোর্ট: ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশে সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন বাতিল করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনসহ দশ দফা দাবি ঘোষণা করেছিল বিএনপি। ২০২৩ সালের ১২ জুলাই বিএনপির দশ দফার আন্দোলন এক দফায় রূপান্তরিত হয়। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষায়, ‘একটাই দাবি—জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী, ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্ববাদী এই সরকারের পদত্যাগ। এক দফা এক দাবি—অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি।’

সরকারের পদত্যাগ না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না। হয়েছেও তাই। তবে বিএনপির দাবির মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করেনি। বিএনপি নির্বাচনে যায়ওনি। আসছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিএনপিবিহীন এ নির্বাচন, স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক উত্তেজনাহীন, ম্যাড়ম্যাড়ে। যদিও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত সারাদেশে বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তবে সেটা আওয়ামী লীগে-আওয়ামী লীগে। দলটির মনোনীত প্রার্থী ছাড়াও মাঠে রয়েছেন দলের মনোনয়নবঞ্চিত একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী, এবং দুপক্ষ মিলে নির্বাচনী-উত্তেজনা না ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছেন। এটা যতটা না নির্বাচনী-উত্তাপ, তারচেয়ে বেশি সরকার-দলের নেতাদের স্বার্থের লড়াই, ক্ষমতার লড়াই; অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা নিয়ে নানামুখী আলোচনা ছিল, ইতিবাচক ছিল কিছুও; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপির অংশগ্রহণ না করা মূলত তাদের পূর্বসিদ্ধান্ত। কারণ তাদের একটাই দাবি—সরকারের পদত্যাগ এবং সংসদের বিলুপ্তি। সংসদের বিলুপ্তিতে সাংবিধানিক যে শূন্যতার বিষয়, তা নিয়ে বিএনপি সচেতন ছিল না। যৌক্তিকতার মানদণ্ডে দুর্বল থাকা সেই দাবি পূরণ হয়নি, এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার যে নির্বাচন সেটার পথেই আছে দেশ।

বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারেনি মূলত নেতৃত্ব সংকটে। একাধিক মামলায় দণ্ড নিয়ে লন্ডনে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিচারিক মামলার রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত, এবং সরকারি আনুকূল্যে কারাগারে বাইরে আছেন। তিনি অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির বাইরে। তার শারীরিক যে অবস্থা তাতে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। বিএনপির অপরাপর নেতাদের মধ্যে একাধিক উপধারার খবর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচিত। দেশের সক্রিয় রাজনীতিতে তারেক রহমানের অনুপস্থিতির পাশাপাশি তার রাজনৈতিক পরিপক্বতার অভাব দলটিকে ভোগাচ্ছে খুব। মাঠের রাজনীতিতে যারা আছেন তাদেরকে মুখাপেক্ষী থাকতে হয় লন্ডনের বার্তার জন্যে। ফলে দেশি-বিদেশি নানামুখী চাপে যখন ছিল সরকার তখন স্রেফ অপরিপক্ব রাজনীতি, তৎসৃষ্ট নেতৃত্ব সংকট, এবং সরকারের কঠোরনীতির কারণে নির্বাচন থেকে দূরে সরে গেছে বিএনপি।

গত কয়েক বছর ধরে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে ছিল বিএনপি। ২০১৩-১৪ সালের নাশকতায় নির্বাচন প্রতিরোধ করতে না পেরে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধের ডাক দিয়েছিল তারা। সেই অবরোধ ঘোষণা ছাড়াই সমাপ্ত হয়। এরমধ্যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভরাডুবি হয় দলটির। যদিও সেই নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক আছে, তবে সেই বিতর্ককে কাজে লাগাতে পারেনি দলটি। বক্তব্যে-বিবৃতিতে নির্বাচন নিয়ে নানা কথা বলেছে তারা, প্রয়োজন ছিল প্রমাণের; কিন্তু সে পথে যায়নি দলটি। বিরোধীদলের এই ব্যর্থতার সুযোগে সরকার পুরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এবার সামনে আরেক নির্বাচন, এবং সে নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়ায় এখন আওয়ামী লীগ যে ফের ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে সে নিশ্চয়তা মিলছে।

বিএনপি নির্বাচনে নাই, আছে আন্দোলনে। আন্দোলন বলতে হরতাল-অবরোধের ঘোষণা দিয়ে ঘরে বসে থাকা। গত ২৮ অক্টোবর বিশাল জনসমাগম ঘটিয়ে সরকারের কৌশলের কাছে মার খেয়ে ঘরে ফিরে গেছে বিএনপি ও সমমনা দল আর জোটগুলো। এরপর থেকে তারা যে সব কর্মসূচি দিচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত করা দূরের কথা, নিজেদেরও অংশগ্রহণ নিশ্চিত পারছে না। এখানে সরকারের কঠোর নীতি আছে সত্য, কিন্তু আন্দোলন যেখানে সরকারের দমননীতি উপেক্ষা করেই করতে হয় সেখানে তারা ব্যর্থ। আন্দোলন শুরুর পর থেকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক কেন্দ্রীয় নেতা কারাগারে, যারা বাইরে থাকতে পেরেছেন তারা গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে। গ্রেফতারের ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে বিএনপিকে। কিন্তু গ্রেফতারের ভয়ে যদি গুঁটিয়ে থাকা হয়, তবে সেটা কি কোন আন্দোলন হয়? ইতিহাস বলে, প্রতিটি সরকারই বিরোধীদের দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে, এবং তারাই সফল হয় যারা সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে থাকতে পারে। এত বড় দল বিএনপি, এত এত কর্মী-সমর্থক-নেতা, কিন্তু বিএনপি পারেনি তাদের সংগঠিত করে মাঠে দাঁড়াতে।

দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করতে যে নেতৃত্বের দরকার সেটা বিএনপির নেই। দলটিতে নানা স্তরের নেতা আছে, কর্মী-সমর্থকসহ দেশব্যাপী ব্যাপক জনসমর্থন আছে, কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ নেই। তাদের নেতা তারেক রহমান নিজেই গ্রেফতারের ভয়ে বিদেশে ‘পলাতক’। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলার রায় হয়েছে, দেশে এলেই তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হবে সত্য, কিন্তু গ্রেফতারের ভয়ে যে রাজনীতিবিদ পালিয়ে থাকেন, তার দ্বারা যে বিএনপির মতো বিশাল এক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়—এটা কে বুঝাবে তাদের?

নেতৃত্ব সংকটে কোন একটা কর্মসূচিতে থিতু হয়ে তা সফল করে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়, এটা বিএনপির রাজনীতি থেকেই প্রমাণিত। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচনের দিকে ক্রম-ধাবমান যখন দেশ তখন বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দল ও জোটগুলো পালন করছে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি। কর্মসূচি পালন বলতে পিকেটিং নেই তাদের; মিনিট-দেড় মিনিটের ঝটিকা মিছিল, বাসে চোরাগোপ্তা হামলা-আগুন, রেললাইনের ক্ষতিসাধন-আগুন। আর আছে রুটিন প্রেস রিলিজ; কর্মসূচি পালনের, কর্মসূচি সফলের। গত ২৯ অক্টোবর থেকে ৪ দফা হরতাল ও ১২ দফার অবরোধ কর্মসূচি এভাবেই তারা পালন করেছে।

বিএনপি ভালোভাবেই জানে তাদের এই কর্মসূচিতে জনসম্পৃক্ততা নেই, নেই এমনকি দলীয় নেতাদেরও সম্পৃক্ততা, তবু দলটি গত ২০ ডিসেম্বর ডাক দিয়েছে অসহযোগ আন্দোলনের। লন্ডন থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা আসার পর দলটি ঢাকায় থাকা জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ এই আন্দোলনের তথ্য জানান। অসহযোগ আন্দোলন বলতে তিনি জানান, ৭ জানুয়ারি ভোট বর্জন; ভোট গ্রহণে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকা; কর, খাজনা ও ইউটিলিটি বিলসহ সরকারের সব রকম পাওনা পরিশোধ স্থগিত রাখা; ব্যাংকে লেনদেন যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে দায়ের মামলায় আদালতে হাজিরা থেকে বিরত থাকা।

বিএনপি অসহযোগ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে দেশবাসীকে আহবান জানিয়েছে। দেশের মানুষের অংশগ্রহণ দূরের কথা দলটির নেতাকর্মীরাও এই আহবানে কীভাবে সাড়া দেবে, কারণ সবাই এরই মধ্যে দেখে ফেলেছে, নানামুখী কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতারাও মাঠে থাকে না। কেউ ইউটিলিটি বিল না দিলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে তার দুর্ভোগ তাকেই পোহাতে হবে। সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরা ভোটগ্রহণ কাজ থেকে বিরত থাকলে চাকরি চলে যেতে পারে যার মাশুল সংশ্লিষ্টকেই দিতে হবে। ব্যাংকে লেনদেন এড়িয়ে চললে কীভাবে চলবে মানুষ!

অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়ার তিন দিন শেষ হয়ে গেছে। এই ডাক মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। দলটি এর প্রচারণায় দেশব্যাপী লিফলেট বিতরণের কাজ শুরু করেছে বলে গণমাধ্যমের খবর। তবে এই লিফলেট বিতরণও যে স্রেফ প্রেস রিলিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লন্ডন থেকে তারেক রহমান হুট করে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে ফেলেছেন, আর এদিকে দেশের নেতাদের সেটার প্রচার করা ছাড়া আর পথ খোলা নাই।

বিএনপির সৌজন্যে হরতাল-অবরোধের মতো তবে অসহযোগ আন্দোলনও প্রেস রিলিজে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *