আন্তর্জাতিক

কৃত্রিম মরুকরণের দিকে তিস্তার প্রবাহপথ, মহাপরিকল্পনাই মুক্তি

ডেস্ক রিপোর্ট: তিস্তা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। উত্তরাঞ্চলের অন্তত ১ কোটি মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে অন্যতম খরস্রোতা এই নদীকে ঘিরেই।

বন্যায় বুক ভরা পানি, উত্তরের সর্বনাশের জলদস্যু, খরায় মরুভূমি হয়ে লাখো মানুষকে দারিদ্রসীমার নিচে রাখাই এই নদীর বর্তমান বড় কাজ। নদী ভাঙনে উত্তরের লাখ লাখ মানুষের বসতভিটা কেড়ে নেওয়ার পিছনেও ‘বড় অপরাধী’ এই তিস্তা।

হিমালয়ের বরফগলা পানিতে সৃষ্ট এই নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ছুঁয়ে গজলডোবা দিয়ে প্রবেশ করে। দেশের উত্তরের জেলা নীলফামারী থেকে ছড়িয়ে ছুটেছে কুড়িগ্রামের দিকে। মাঝে রংপুর, লালমনিরহাট দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে গাইবান্ধার দিকে। ধারণা করা হয় দেশে তিস্তার গতিপথ ১৫১ কিলোমিটার আর এই প্রবাহপথ ২৩৭ বছরের পুরনো। দীর্ঘ প্রবাহপথে তিস্তাকে ঘিরে জন্ম হয়েছে বুড়ি তিস্তা, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র, চারাল কাঠাসহ অন্তত ২৫টি নদী। এজন্য তিস্তাকে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর  জননী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে।

বন্যায় বুক ভরা পানিতে তিস্তা

উত্তরের জেলা নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, ও গাইবান্ধা জেলা তিস্তা অববাহিকায়। এসব জেলার মানুষদের জীবনমান নির্ভর করে তিস্তাকে ঘিরে। তবে এসব অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তিস্তার যেমন অবদান আছে, তেমনি প্রতিবছরের বর্ষা মৌসুমের বন্যা ও নদী ভাঙনের আগ্রাসী রূপ সর্বস্বান্ত করেছে লাখ-লাখ মানুষকে।

বর্ষায় উজানের ৪-৬ লাখ কিউসেক পানি নিয়ে বাংলাদেশ অংশে ভয়াল রূপ ধারণ করে তিস্তা। খরা মৌসুমে তিস্তার পানি নেমে আসে মাত্র ১-২ হাজার কিউসেকে; যেখানে তিস্তার বেঁচে থাকতেই প্রয়োজন ১০-১২ হাজার কিউসেক। ভারতের গজলডোবায় একতরফা বাঁধ নির্মাণে খরা মৌসুমে তাদের বাঁধের চোয়ানো ২৫০ কিউসেক পানি মেলে এ নদীর পেটে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই নদীগর্ভ শীত মৌসুমে পরিণত হয়ে উঠে ধু-ধু বালির মরুভূমিতে। আর প্রবাহ না থাকায় বেকার হয়ে পড়ে তিস্তাকে ঘিরে জীবিকা চালানো উত্তরের ৫ জেলার ২ লাখের বেশি মানুষ।

খরা মৌসুমে তিস্তার পানি নেমে আসে মাত্র ১-২ হাজার কিউসেকে

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর তিস্তা গর্ভে বিলীন হচ্ছে ৫ জেলার হাজার হেক্টর আবাদি জমি। প্রতিবছর পায় ১ লাখ ১৩ কোটি টাকার বেশি সম্পদ নষ্ট হচ্ছে তিস্তার ভয়াবহতায়। এছাড়া গেল ১০ বছরে শুধু বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন উত্তরের অন্তত ৩ লাখ পরিবার। এর মধ্যে নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে রয়েছে প্রায় ২ লাখের বেশি পরিবার।

তবে তিস্তার বন্যা বা খরা, দুটোই যখন এ নদী অববাহিকার স্বপ্ন ভাঙার প্রতীক, হতাশার কালো মেঘ; তখন তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাণী আসে উত্তরের দুই কোটি মানুষের মাঝে।

উত্তরের ভাগ্য বদলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্পের আওতায় ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০৮ কিলোমিটার খনন করে তিস্তার গভীরতা ১০ মিটার পর্যন্ত বাড়ানোর কথা ছিল। এছাড়াও নদীতে সারাবছর নৌ চলাচলের ব্যবস্থা রাখার কথাও ছিল। বলা হয়েছিল, নদীর দুই পাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীররক্ষা বাঁধ ও চর খনন করে নির্মাণ করা হবে স্যাটেলাইট শহর। এ পরিকল্পনার আওতায় থাকবে বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধারকার্য। এছাড়াও ছিল ১ লাখ ১৩ কোটি টাকার সম্পদ উদ্ধার করে বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা। নদীর দুই পাড়ে নৌবন্দর থানা স্থাপনের পাশাপাশি কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনী জন্য ক্যাম্প নির্মাণ হবে বলেও কথা ছিল।

১ কোটি মানুষের মানুষের জীবনযাত্রার প্রাণকেন্দ্র তিস্তা

 

মহাপরিকল্পনার আওতায় বিষদ উন্নয়ন হিসেবে থাকবে নদী খনন, ভাঙন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা। থাকবে আধুনিক সেচ ব্যবস্থা। মাছ চাষ প্রকল্প স্থাপনের পাশাপাশি তিস্তাকে গড়ে তোলা হবে আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে। আর এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তিস্তায় কর্মসংস্থান হবে ৭-১০ লাখ মানুষের বলছেন বিশ্লেষকরা।

তবে ভারত-চীন ডামাডোলে তিস্তা মহাপরিকল্পনার আলোচনা-ই থমকে আছে বলে দাবি নদী গবেষক ও তিস্তা অববাহিকার মানুষদের। এছাড়া ভারতের ৬ হাজার হেক্টর জমিতে পানি সরবরাহে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণে, সময়ের সাথে মরুকরণ হচ্ছে অন্যতম খরস্রোতা এই নদীর। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলেও দেশীয় প্রযুক্তিতে তিস্তাগর্ভ খননের দাবি তিস্তা অববাহিকার বাসিন্দাদের। বৈশ্বিক আবহাওয়া রক্ষা ও উত্তরাঞ্চলকে কৃত্রিম মরুকরণের হাত থেকে রক্ষার্থে দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নই একমাত্র পথ বলছেন সকলে।

লালমনিরহাট জেলার তিস্তা অববাহিকার বাসিন্দা মিনতি রানি বলেন, ‘খালি নদী ভাঙে। এপার থাকি ওই পার যাই। হামার তো সব কাড়ি নিয়েছে তিস্তা। হামার কথা কায় শুনিবে। বাঁধ নাকি বান্দিবে। খালি শুনি, কাজ কারবার হউবে। বাঁধ না বান্ধুক, নদীটা খুড়ি দিলে তো হামার কষ্ট কমে; বানোত না ভাসি।’

তিস্তাপাড়ের আরেক বাসিন্দা ষাটোর্ধ মতিয়ার রহমান বলেন, ‘তিস্তায় দুইবার ঘর হারাইছি। জমি গেইছে ৪-৫ বিঘা। বাঁধ বাঁধিলে নাকি সেই জমি ফিরি পামো তা মরার আগে মনে হয় আর পামো না।’

তিস্তা এলাকার মাঝি মোজাম্মেল হক বলেন, ‘চোখের সামনে এই তিস্তার বহু রূপ দেখেছি। বিলীন ভাঙন আর দুর্দশা আমাদের নিত্যসঙ্গী। তবে শুনে আসছি তিস্তা মহাপরিকল্পনা হবে। এমপি-মন্ত্রী সবাই আশ্বাস দিচ্ছেন বছরের পর বছর। এটা বাস্তবায়ন হলে আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের অভাব হবে না। আমরা এটা বাস্তবায়ন চাই।’

বন্যা ও নদীভাঙনে বাস্তুহারা হতে হয় তিস্তাপাড়ের বাসিন্দাদের

নদী গবেষক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, তিস্তার বয়স অনুসারে তিস্তা তার নিজ গতিপথ ডানে-বামে হেলে তৈরি করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে জনজীবন রক্ষায় এই নদীর পরিচর্যা না থাকায় বন্যা ও খরা ভয়ঙ্কর রূপে পরিণত হয়েছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব নিজ অর্থায়নে, দেশীয় প্রযুক্তিতে তিস্তা পরিচর্যার সাথে, আন্তর্জাতিক ডামাডোল নিরসন করে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন।

এ বিষয়ে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সফিয়ার রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে প্রতিবছর যে লক্ষ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, মানুষের যে খারাপ অবস্থা সেখান থেকে সবাই রক্ষা পাবে।’

যে আবাদি জমিগুলো প্রতিবছর ভেঙে যাচ্ছে সেগুলোও রক্ষা পাবে ও পাশাপাশি লক্ষ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন করা যাবে। তিন ফসলি জমিগুলোতে যে বালি জমছে সেগুলোও ফিরে পাওয়া যাবে। এছাড়া জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে বলেও জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, ভারতের গজলডোবা বাঁধের কারণে তিস্তার খরা এখন মরুতে রূপ নিচ্ছে। আমাদের দাবি দ্রুত ভূ-রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং তা এ বছরের করতে হবে।

নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তা একটি আন্তঃদেশীয় নদী। এই নদীর একটি অংশের পরিচর্যা করলে খুব ভালো ফল পাওয়া যাবে তা নয়। তাই এর জন্য একটি অভিন্ন দেশীয় পরিচর্যা দরকার। আর এটা যতদিন না হয় ততদিন নিজ দেশীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচর্যাটা অব্যাহত রাখতে হবে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে ৪ জেলার

তিস্তা মহাপরিকল্পনার যে আলোচনা হয়েছিল তা শুধু আলোচনাতেই থেমে আছে। পরিচর্যার অভাবে দিন-দিন এ নদীর ভয়াবহ থেকে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে উত্তরের ৪ জেলার। দারিদ্রপীড়িত রংপুর আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে যাবে।

এদিকে উত্তরের মানুষদের দুঃখ তিস্তা সমস্যা সমাধানের দাবি মেনে নিয়ে ২০২৩ সালের রংপুরের এক জনসভায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নির্বাচনের পর সে প্রতিশ্রুতি কতটা এগুবে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সম্মতির অপেক্ষায় আছে চীন। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ কথা জানান বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।

সম্ভাবনার সকল দুয়ার খোলা থাকলেও উত্তরাঞ্চলের দুঃখ তিস্তা সমস্যা সমাধানের দিকে তাকিয়ে থাকা এ জনপদের কোটি মানুষের প্রতিদিনের সূর্য অস্ত যায় আট হাজার দুইশত কোটি টাকার তিস্তা মহাপরিকল্পনার সোনালি আলোর অপেক্ষায়। আর সেই স্বপ্ন নিয়ে বিদ্যমান যে সংকট রয়েছে তার কারিগরি সমাধান জানা আছে। এখন  রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ।

সম্প্রতি বার্তা২৪.কমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ’শুকনো মৌসুমে ৩২ হাজার কিউসেক পানি হলেই বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের চাহিদা মিটবে। কিন্তু বর্ষায় যে ২-৩ লক্ষ কিউসেক পানি থাকে সেটা ধরে রাখাই হচ্ছে সমাধান।

 

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *